
এম এন আলী শিপলু, খুলনা :চলতি মৌসুমে দ্বিগুণ মূল্য দিয়েও শ্রমিক সংকটে পড়েছেন খুলনার বিভিন্ন উপজেলার কৃষকরা। ঝড়-বৃষ্টির শঙ্কায় বাড়তি পারিশ্রমিক দিতে না পারায় শেষাবধি পরিবারের লোকজন নিয়ে ধান কেটেও লোকসানের ঘানি টানছেন কৃষকরা।
দিগন্তজোড়া সোনালি ধান, চোখ যেদিকে যায় শুধু হলুদ আর সবুজের মিতালি। তেরখাদা উপজেলার মাঠজুড়ে এখন এমনই চিত্র। কৃষকের স্বপ্নের সোনার ধান পেকেছে, কিন্তু মৌসুমের শুরুতেই দেখা দিয়েছে শ্রমিক সংকট। এতে করে বোরো চাষিদের মাঝে হতাশা ছড়িয়ে পড়েছে। শ্রমিক মিললেও জনপ্রতি ৮শ’ টাকা। সঙ্গে দু’বেলা খাবার। এতে গৃহস্থের খরচ পড়ছে এক হাজারের উপরে। বাজারে ধান বিক্রি হচ্ছে ১ হাজার থেকে ১ হাজার ৩০ টাকা।
ডুমুরিয়া উপজেলা কৃষি অফিস সূত্রে জানা যায়, বিল ডাকাতিয়া, রংপুরসহ কয়েকটি বিলের জমি অনাবাদি থাকলেও উপজেলার ৪২টি ব্লকে ইরি-বোরো ধান উৎপাদন হয়েছে।
তবে কৃষকের নিজস্ব উদ্যোগে বাড়তি খরচে জমির পানি সেচ দিয়ে বাইরে ফেলে ধান চাষ করেছে কৃষকরা। আবওহাওয়া অনুকূলে থাকায় বাম্পার ফলন হওয়ায় লক্ষমাত্রা অর্জিত হবে। অতিবৃষ্টির কারণে চাষাবাদ বিলম্বিত হলেও ফলনও হয়েছে বেশ। এবার ১ লাখ ৫০ হাজার ৩৮ মেট্টিক টন ধান ঘরে তুলতে পারবে কৃষকরা। বর্তমানে কৃষকদের ধান কাটার ধূম পড়েছে।
ধান কাটার শেষ মুহূর্তে মাধবকাটি, থুকড়াসহ কয়েকটি বিলের পাকা ধানে দেখা দিয়েছে ব্লাস্ট রোগের আক্রমণ। তারপর শুরু হয়েছে ঝড় বৃষ্টি। বছরের খোরাক ঘরে তুলতে ব্যস্ত কৃষকরা। পুরোদমে ধান কাটা চললেও শ্রমিক সংকট এবং পারিশ্রমিক দ্বিগুণ হওয়ায় কৃষকরা পড়েছে মহাবিপাকে। ৩ বার থাকা খাওয়া প্রতিজন ১ হাজার থেকে ১১’শ টাকা দিতে হচ্ছে। অনেকেই পরিবারের মহিলা লোকজন নিয়ে ধান কেটে ঘরে তোলার চেষ্টা করছেন।
ডুমুরিয়া উপজেলার শাহপুর গ্রামের জাফর ইকবাল আকুঞ্জী জানান, তিনি ৩ একর জমিতে ধান লাগিয়েছেন। গত এক সপ্তাহ ধওে ৯-১০জন শ্রমিক নিয়ে ধান কাটছেন। ৩ বার খাওয়া প্রতিদিন ১ হাজার টাকা করে পারিশ্রমিক। কিন্তু দুঃখের বিষয় একজন শ্রমিক দিনে ১ মণ ধান কাটতে পারছে না। যার মূল্য ১২’শ টাকা। এতে উৎপাদন খরচ বেড়ে লোকসান টানতে হচ্ছে।
বরুনা গ্রামের জহুরা বেগম (৫৫) ও আবেলা বেগম (৩৫) জানান, তারা দেড় বিঘা জমিতে ধান চাষ করেছেন। অর্থাভাবে তারা দুই ‘জা’ ধান কাটতে নেমে পড়েছেন। পাশে ধান কাটছেন বরুনা গ্রামের ৯ম শ্রেণির স্কুল ছাত্র ইয়ামিন বিশ্বাস। দুই বিঘা ১৫ কাঠা জমিতে ধান চাষ করেছেন। তারা জানান, চড়া মূল্যে কিষাণ নিয়ে ধান কাটলে খরচ বেশি পড়ে যাচ্ছে। তাই নিজেরা ধান কাটছি।
থুকড়া গ্রামের বর্গা চাষী মিন্টু বিশ্বাস জানান, ধান চাষ করেও অর্ধেক ধান জমির মালিককে দিতে হচ্ছে। উৎপাদন খরচ ও কাটা খরচ হিসেব করলে ধানের দাম ডাবল পড়ে যাচ্ছে।
ধান কাটা শ্রমিক কয়রা উপজেলার আঃ মান্নান ঢালী (৫৫) ও শাহিনুর ঢালী (৩৫) জানান, এখন ধান কাটার পুরোগণ চলছে। কুষকের তুলনায় কিষাণ অনেক কম। বাজার মূল্য অনুপাতে শ্রমের মূল্য বেশি না নিলে সংসার চালাতে পারিনা।
জেলার আরেক উপজেলা তেরখাদার কৃষি অফিসের তথ্য মতে, এ বছর তেরখাদাতে ৮ হাজার ৯৪৯ হেক্টর জমিতে বোরো ধানের চাষ হয়েছে। উচ্চ ফলনশীল জাত যেমন- হীরা ২, ৯ ধান, সুবর্ণ ৩, ১২ ও নতুন জাত গোল কাজল ধানের চাষ করা হয়েছে।
উপজেলার ছয়টি ইউনিয়নের কৃষকরা উপজেলা কৃষি অধিদপ্তরের পরামর্শ মেনে উন্নত জাতের ধান চাষ করেছেন। ফলে ভালো ফলন হয়েছে। ইতোমধ্যে আগাম ধান পাকা ও কাটা শুরু করেছে। কয়েক দিনের মধ্যেই পুরো ফসল প্রস্তুত হয়ে যাবে ঘরে তোলার জন্য। তবে সমস্যা দেখা দিয়েছে ধানকাটার শ্রমিক সংকটে। বর্ধিত মজুরির পরও মিলছে না পর্যাপ্ত শ্রমিক। দিনে ৮০০ টাকা পর্যন্ত মজুরি দিলেও শ্রমিক পাওয়া যাচ্ছে না। এমনকি অন্যান্য জেলা থেকেও এবার তেমনভাবে শ্রমিক আসেনি। ফলে অনেক কৃষক বাধ্য হয়ে পরিবারের সদস্যদের নিয়ে ধান কাটতে শুরু করেছেন।
বারাসাত ইউনিয়নের ইখড়ি এলাকার কৃষক জলিল বলেন, এ বছর হীরা-২ জাতের ধান চাষ করেছি, ফলনও ভালো হয়েছে। কিন্তু ধানকাটার শ্রমিক পাচ্ছি না।
সদর ইউনিয়নের পানতিতা এলাকার কৃষক রুয়েল মোল্লা বলেন, পাকা ধান মাঠে পড়ে আছে, কিন্তু শ্রমিক নেই। তাপমাত্রা এত বেশি যে কাজ করা কঠিন। ঝড়-বৃষ্টির আগে ধান ঘরে তুলতে পারব কি না তা নিয়েই এখন দুশ্চিন্তায় আছি।
উপজেলার কৃষি কর্মকর্তা কৃষিবিদ শিউলি মজুমদার বলেন, আবহাওয়া অনুকূলে থাকায় এবার বোরো ধানের ফলন ভালো হয়েছে। বিশেষ করে নতুন জাতের ধানের বাম্পার ফলন আশা করা হচ্ছে। শ্রমিক সংকট কিছু এলাকায় থাকলেও মেশিনের মাধ্যমে ধানকাটার ব্যবস্থা করা হচ্ছে। তিনি আশা প্রকাশ করেন, যন্ত্রের সাহায্যে দ্রুত ধান কেটে কৃষকরা ফসল ঘরে তুলতে পারবেন।