
স্বপন বিশ্বাস
ফল প্রকাশের দিনটি একজন শিক্ষার্থীর জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্তগুলোর একটি। কিন্তু সেই দিনের আনন্দ যদি কয়েক সপ্তাহ পরে পুনঃমূল্যায়নের ঢেউয়ে বদলে যায়, তাহলে প্রশ্ন উঠতেই পারে—মূল মূল্যায়ন কি তাহলে ভুলে ভরা? এবারের এসএসসি পরীক্ষার পুনঃমূল্যায়নের পর ফলাফলের যে নাটকীয় পরিবর্তন দেখা গেছে, তা শিক্ষা ব্যবস্থার বিশ্বাসযোগ্যতার ওপর বড় ধরনের আঘাত হেনেছে।
প্রতি বছরই এসএসসি পরীক্ষার ফল প্রকাশের পর শিক্ষার্থীদের একাংশ ফল পুনঃমূল্যায়নের জন্য আবেদন করে। কিন্তু চলতি বছর সেই সংখ্যা ও পরিবর্তনের হার দুটোই যেন নতুন রেকর্ড গড়েছে। শিক্ষা বোর্ডের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৫ সালে মোট ১ লাখ ৫ হাজার ৮৭২টি খাতা পুনঃমূল্যায়নের জন্য আবেদন করা হয়। এর মধ্যে প্রায় ৩৫ শতাংশ খাতায় নম্বর পরিবর্তন হয়েছে—যা গত বছরের ২১ শতাংশের তুলনায় অনেক বেশি।
পরিসংখ্যান বলছে, ৫,২১৪ জন শিক্ষার্থী ফেল থেকে পাস করেছে এবং ২৬,৭৫০ জন শিক্ষার্থীর গ্রেড উন্নতি হয়েছে। অর্থাৎ প্রায় এক-তৃতীয়াংশ আবেদনকারী প্রথম ফলাফলের তুলনায় ভিন্ন ফল পেয়েছে। এই বিপুল পরিবর্তন শিক্ষা বোর্ডের মূল মূল্যায়ন পদ্ধতি ও পরীক্ষকদের দক্ষতা নিয়ে বড় প্রশ্ন তুলে দিয়েছে।
শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের অভিযোগ, খাতা মূল্যায়নে অসতর্কতা, নম্বর গণনায় ভুল, এমনকি পরীক্ষকদের মনোযোগের অভাবও এর পেছনে দায়ী। ঢাকার এক অভিভাবক ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, “আমার ছেলের ফল পুনঃমূল্যায়নের পর দুই গ্রেড বেড়েছে। তাহলে প্রথমবার নম্বর কম দেওয়া হলো কেন?”
এমন পরিস্থিতি শুধু শিক্ষার্থীর জন্য নয়, পুরো পরীক্ষাব্যবস্থার জন্যই নেতিবাচক। কারণ, পরীক্ষার প্রতি আস্থা হারালে শিক্ষা ব্যবস্থার ভেতরে যে আস্থাহীনতা তৈরি হবে, তা দীর্ঘমেয়াদে ভয়াবহ প্রভাব ফেলতে পারে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, এই সংকট মোকাবিলায় কয়েকটি পদক্ষেপ জরুরি—
১. প্রযুক্তিনির্ভর মূল্যায়ন ব্যবস্থা চালু: মার্কিং সিস্টেমকে ডিজিটালাইজ করে মানবিক ত্রুটি কমানো।
২. বহুমুখী যাচাই-বাছাই: ফল প্রকাশের আগে অন্তত দুই দফা খাতা যাচাই।
৩. পরীক্ষকদের প্রশিক্ষণ: আধুনিক মূল্যায়ন পদ্ধতি ও নৈতিক মানদণ্ডে প্রশিক্ষণ নিশ্চিত করা।
শিক্ষা বোর্ডের কর্মকর্তারা মানবিক ত্রুটি স্বীকার করলেও দাবি করছেন, তারা ইতিমধ্যেই ডাবল চেকিং পদ্ধতি ও প্রযুক্তি ব্যবহার শুরু করেছে। তবে বাস্তবে এর প্রভাব কেমন হবে, তা সময়ই বলে দেবে।
পুনঃমূল্যায়নে ফলাফলের এমন নাটকীয় পরিবর্তন আমাদের মনে করিয়ে দেয়—শুধু পরীক্ষা নেওয়াই দায়িত্ব নয়, বরং সঠিক ও ন্যায্য মূল্যায়ন নিশ্চিত করাই শিক্ষা ব্যবস্থার আসল চ্যালেঞ্জ।
স্বপন বিশ্বাস
সাংবাদিক কবি ও প্রধান শিক্ষক
শালিখা মাগুরা