মাহবুবুজ্জামান সেতু, নওগাঁ প্রতিনিধিঃ নওগাঁর মান্দা উপজেলার ভালাইন ইউনিয়নের লক্ষ্মীরামপুর গ্রামের ১৩০ বছর বয়সী তফের আলী মণ্ডলের মানবেতর জীবনযাপন হৃদয় ছুঁয়ে গেছে অনেকের। হাড় জিরজিরে শরীর, নেই চলার শক্তি, নেই মাথা গোঁজার মতো একটি উপযুক্ত ঠাঁই। সরকারি জমিতে মরিচাধরা টিনের বেড়া ও ছাউনি দিয়ে বানানো একটি জরাজীর্ণ ঘরে দিন কাটছে তার।
১১ সন্তানের জনক হলেও, শেষ বয়সে কারো আশ্রয় পাননি তফের মণ্ডল। স্ত্রী বহু আগেই মারা গেছেন। সন্তানেরাও নিজেদের মতো জীবনযাপন করছেন। একসময় ছোট ছেলে আইনাল হকের বাড়িতে থাকলেও, পুত্রবধূর অসহযোগিতার কারণে সেখান থেকেও বিতাড়িত হন তিনি। এখন একটি রাস্তার পাশে অন্ধকার, স্যাঁতসেঁতে ঘরে একা জীবন কাটাচ্ছেন শতবর্ষী এই মানুষটি।
সম্প্রতি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তার করুণ অবস্থার ভিডিও ও ছবি ভাইরাল হলে বিষয়টি নজরে আসে মান্দা উপজেলা বিএনপির সভাপতি ও দলটির কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য এম.এ মতীনের।
গত শনিবার (৩০ আগস্ট) এম.এ মতীন সরেজমিনে গিয়ে বৃদ্ধ তফের মণ্ডলের অবস্থা দেখে আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন। পরদিন (৩১ আগস্ট) তিনি আনুষ্ঠানিকভাবে তফের মণ্ডলের জন্য একটি পাকাঘর নির্মাণের কাজের উদ্বোধন করেন। একইসঙ্গে এই বিএনপি নেতা ঘোষণা দেন, যতদিন বেঁচে থাকবেন, ততদিন তফের আলীর খাবার, চিকিৎসা এবং যাবতীয় খরচ তিনি নিজেই বহন করবেন।
এ প্রসঙ্গে তফের আলী বলেন,’প্রতিদিন ভ্যানে চড়ে পাশের বাজারে গিয়ে খেতে হয়। আর না খেয়েই দিন কাটে। মৃত্যুর প্রহর গুনছি। হঠাৎ বিএনপির মতীন স্যার এসে আমার দুরবস্থা দেখে ঘর করে দিচ্ছেন, খাওয়ার ব্যবস্থা করছেন, এমনকি চিকিৎসাও করিয়ে দেবেন বলেছেন—এই বয়সে এমন সহায়তা সত্যিই কল্পনাও করিনি।’
ভালাইন ইউনিয়ন বিএনপির সভাপতি আবুল কালাম আজাদ বলেন,‘সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সংবাদটি দেখে এম.এ মতীন ভাই নিজ উদ্যোগে মানবিক সহায়তার হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন। এটি আমাদের জন্য গর্বের বিষয়।’
এ বিষয়ে এম.এ মতীন বলেন,‘ফেসবুক ও সংবাদমাধ্যমে বৃদ্ধ তফের মণ্ডলের দুঃখজনক জীবনের খবর দেখে আমি মর্মাহত হই। আমি মনে করি, মানবতার ডাকে সাড়া দেওয়া একজন মানুষ ও নাগরিক হিসেবে আমার দায়িত্ব। যতদিন বেঁচে থাকবেন, তার পাশে থাকার প্রতিশ্রুতি দিচ্ছি।’
তফের মণ্ডলের জীবনের এই করুণ অধ্যায়ে সবচেয়ে কষ্টদায়ক দিক হচ্ছে, তার নিজের সন্তানেরাও যেন মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন। ৮ ছেলে, ৩ মেয়ে থাকলেও কেউ তার খোঁজ রাখেন না। সন্তানদের বিরুদ্ধে তফের আলী আদালতেও মামলা করেছেন, যাতে অন্তত দু’বেলা খাবার ও থাকার জায়গা নিশ্চিত হয়।
ছেলে আইনাল হক বলেন,‘বাবার অভিযোগ ঠিক না। আমাদের নিজেরই কষ্টের সংসার। ঘরে ৩টি রুম—একটিতে আমি, একটিতে আত্মীয়রা আসে, আরেকটিতে ছাগল থাকে। বাবার থাকার মতো আলাদা ঘর নেই। খেত-খামারের জিনিস রাখার জায়গাও দরকার।’
স্থানীয়রা বলছেন, শতায়ু তফের মণ্ডলের এই অবহেলিত জীবন আমাদের সমাজের চিত্র স্পষ্ট করে তোলে—যেখানে একসময় যারা পরিবারের জন্য জীবন কাটিয়ে দেন, তারা বৃদ্ধ বয়সে হয়ে পড়েন সবচেয়ে অবহেলিত। তবে এম.এ মতীনের মতো মানুষের সহানুভূতি ও উদ্যোগই হতে পারে এই অন্ধকারে একটুকরো আশার আলো।