
লেখক: আসাদুল্লাহ আল গালিব: “আগে সকালে চা হাতে নিয়ে পেপার না পড়লে দিনটাই শুরু হতো না। এখন তো ছেলে আমার মোবাইলে হেডলাইন দেখে!” — ঢাকার পুরান ঢাকার ৬৫ বছরের অবসরপ্রাপ্ত ব্যাংক কর্মকর্তা আব্দুল হামিদের এই কথার মাঝে যেন ধরা পড়ে যাচ্ছে মুদ্রিত সংবাদপত্রের এক টুকরো অতীত। একসময় যা ছিল প্রতিটি ঘরের নিত্য প্রয়োজন, সময়ের আবর্তে তা আজ স্মৃতি ও অভ্যাসের গহীনে হারিয়ে যাওয়ার পথে।
কিন্তু প্রশ্ন উঠছে—মুদ্রিত সংবাদপত্র (Print Media) কি সত্যিই হারিয়ে যাচ্ছে? নাকি এটি কেবল একটি রূপান্তরের সময় পার করছে?
ঐতিহাসিক গৌরবের পথচলা
বাংলাদেশসহ উপমহাদেশে সংবাদপত্র ছিল কেবল সংবাদ পরিবেশনের মাধ্যম নয়, বরং সামাজিক পরিবর্তনের হাতিয়ার। ১৮১৮ সালে প্রকাশিত ‘সমাচার দর্পণ’ থেকে শুরু করে ‘ইত্তেফাক’, ‘দৈনিক আজাদ’ কিংবা ’১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সময়ের পত্রিকাগুলো ছিল স্বাধীনতার কণ্ঠস্বর। সেসময় সংবাদপত্র মানেই ছিল জনগণের ভাষা, আন্দোলনের অস্ত্র এবং ইতিহাসের নির্ভরযোগ্য দলিল।
কিন্তু সময়ের স্রোতে সেই গৌরবের পাতাগুলো যেন ধীরে ধীরে হলুদ হয়ে আসছে।
সংকটের তথ্য-উপাত্ত
বাংলাদেশ সংবাদপত্র পরিষদের (BSPAB) তথ্য বলছে, ২০১৫ সালে দেশে নিবন্ধিত পত্রিকার সংখ্যা ছিল প্রায় ৬০০টি, যা ২০২৪ সালে কমে দাঁড়িয়েছে ৪২০-তে। এর মধ্যে প্রায় ৭০টি পত্রিকা এখন কেবলমাত্র অনলাইন ভার্সনে সক্রিয়। শুধু ২০২৩ সালেই ঢাকার বাইরের ৩০টিরও বেশি পত্রিকা মুদ্রণ বন্ধ করে দিয়েছে।
বিশ্বমঞ্চেও চিত্র একই। Statista-র তথ্যমতে, ২০১৮ থেকে ২০২৩ সালের মধ্যে বিশ্বব্যাপী প্রিন্ট বিজ্ঞাপনের রাজস্ব কমেছে ৫৬%। USA Today, The Independent (UK), La Presse (Canada)—সবকটিই প্রিন্ট সংস্করণ বন্ধ করে সম্পূর্ণ ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে স্থানান্তরিত হয়েছে।
নতুন প্রজন্মের অভ্যাস ও প্রযুক্তির প্রভাব
নজরুল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষার্থী শরিফ বলেন,
“মোবাইলে স্ক্রল করে হেডলাইন দেখে নেওয়া আর পৃষ্ঠা উল্টে বিস্তারিত প্রতিবেদন পড়ার মধ্যে যে পার্থক্য আছে সেটা এখন আর কেউ বোঝে না। আমরা ব্যস্ত ক্লাস, অ্যাসাইনমেন্ট, সোশ্যাল মিডিয়া নিয়ে। মোবাইলেই যখন সব পাওয়া যায়, তখন পত্রিকা হাতে নেওয়ার অভ্যাস কমে যাওয়া স্বাভাবিক।”
তরুণ সাংবাদিক ইকবাল মাহমুদ বলেন,
“মুদ্রিত পত্রিকার একটা আলাদা গন্ধ, আস্থা, বিশ্বাসযোগ্যতা আছে। কিন্তু তরুণরা এখন তথ্য চায় দ্রুত, সংক্ষিপ্ত আর ভিজ্যুয়াল ফরম্যাটে। প্রিন্ট পত্রিকার সময়সাপেক্ষ প্রক্রিয়া সেখানে পিছিয়ে পড়ছে। তবে অনলাইন নিউজে যখন গুজব, ভুয়া সংবাদ ছড়িয়ে পড়ে তখন মানুষ আবার ফিরে তাকায় মুদ্রিত কাগজের দিকে। তাই হারিয়ে যাওয়া নয়, বরং রূপান্তরই প্রিন্ট পত্রিকার সামনে বড় চ্যালেঞ্জ।”
পাঠকগোষ্ঠীর পরিবর্তন ও দুই প্রজন্মের ব্যবধান
২০২৩ সালের বিডিনিউজ২৪-এর এক জরিপ অনুযায়ী, বাংলাদেশে ১৮–৩০ বছর বয়সী ৭৫% তরুণ খবর সংগ্রহ করেন স্মার্টফোন ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম থেকে। অন্যদিকে ৪০ ঊর্ধ্ব বয়সী সরকারি কর্মকর্তা, শিক্ষক, অবসরপ্রাপ্ত কর্মচারীদের বড় একটি অংশ এখনো মুদ্রিত পত্রিকা হাতে নিয়েই দিন শুরু করেন।
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী তানভীর হাসান বলেন,
“আমার মা এখনো পত্রিকার কাটিং রেখে দেন। মাঝে মাঝে আমি সেগুলো পড়ি। তখন মনে হয়, সব খবর মোবাইল স্ক্রিনে ধরা যায় না। কাগজের গন্ধ আর শব্দে একটা আলাদা অনুভূতি আছে।”
প্রিন্ট মিডিয়ার গুরুত্ব ও রূপান্তরের সম্ভাবনা
ড. শামীমা হক, মিডিয়া গবেষক, বলেন—
“প্রিন্ট পত্রিকা এখন গবেষণার জন্য গুরুত্বপূর্ণ দলিল। অনলাইনে সংবাদ হারিয়ে যায়, কিন্তু মুদ্রিত সংবাদ থেকে যায় স্থায়ী প্রমাণ হিসেবে।”
সাংবাদিক শরিফুল ইসলাম বলেন,
“আজকের অনলাইন সাংবাদিকতায় তথ্য পরিবেশনের গতি বেশি, কিন্তু সেখানে গভীরতা, যাচাই ও বিশ্লেষণের জায়গা অনুপস্থিত। অন্যদিকে প্রিন্ট মিডিয়ায় এখনো গবেষণাভিত্তিক, অনুসন্ধানী ও ব্যালেন্সড রিপোর্টিংয়ের যে চর্চা রয়েছে, সেটিই সংবাদকে দীর্ঘস্থায়ী করে তোলে।”
বিশ্বের নামী পত্রিকাগুলোও রূপান্তরের পথে। যেমন—
- The Independent (UK): ২০১৬ সালে প্রিন্ট সংস্করণ বন্ধ করে পুরোপুরি ডিজিটাল হয়ে যায়।
- La Presse (Canada): ২০১৮ সালে ডিজিটাল-ফার্স্ট মডেলে রূপান্তরিত।
- Hindustan Times (India): শহরভিত্তিক প্রিন্ট সংস্করণ কমিয়ে অনলাইন সংস্করণ জোরদার করেছে।
টিকে থাকার পথ: পরিবর্তনের সাথে অভিযোজন
বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, মুদ্রিত সংবাদপত্র রাতারাতি হারিয়ে যাবে না। বরং টিকে থাকার জন্য পত্রিকাগুলোকে হতে হবে আরও বুদ্ধিমান ও অভিযোজিত। হতে পারে সপ্তাহে এক-দুদিনের বিশেষায়িত প্রিন্ট এডিশন, যেখানে থাকবে গভীর বিশ্লেষণ, অনুসন্ধানী প্রতিবেদন ও মতামত, যা অনলাইন নিউজে তাৎক্ষণিকভাবে পাওয়া যায় না।
একইসাথে ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মকে শক্তিশালী করতে হবে মাল্টিমিডিয়া কনটেন্ট, ফ্যাক্টচেকিং, এবং পাঠকের সাথে ইন্টারঅ্যাকটিভ উপস্থাপনার মাধ্যমে।
উপসংহার: হারিয়ে যাওয়া নয়, নতুন অভিযোজনের গল্প
মুদ্রিত সংবাদপত্রের ভবিষ্যৎ নিয়ে তাই হতাশ হওয়ার সময় এখনো আসেনি। এটি হারিয়ে যাওয়ার পথে নয়, বরং প্রযুক্তির সাথে তাল মিলিয়ে অভিযোজিত হয়ে নতুন আঙ্গিকে টিকে থাকার লড়াই করছে।
যারা কাগজে ছাপা অক্ষরের সৌন্দর্য বোঝেন, বিশ্বাস করেন সংবাদপত্রের দলিলিক শক্তিতে—তাঁদের কাছে প্রিন্ট মিডিয়া সবসময়ই থাকবে ভরসার জায়গা হয়ে।
মুদ্রিত পত্রিকার সামনে তাই এখন সবচেয়ে বড় সময়—রূপান্তরের সময়। যেখান থেকে শুরু হতে পারে নতুন এক অধ্যায়।
আসাদুল্লাহ আল গালিব
জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়,ময়মনসিংহ