
স্বপন বিশ্বাস
বাংলাদেশের উন্নয়নযাত্রা আজ নানা খাতে দৃশ্যমান হলেও শিক্ষা ব্যবস্থা এখনো এক গভীর সংকটের মুখে দাঁড়িয়ে। প্রাথমিক থেকে উচ্চশিক্ষা—সব স্তরেই রয়েছে কাঠামোগত দুর্বলতা, নীতি অসঙ্গতি, শিক্ষক সংকট, মানহীন পাঠ্যক্রম ও দুর্বল অবকাঠামো। অথচ শিক্ষা শুধু জ্ঞানার্জনের মাধ্যম নয়; এটি জাতি গঠনের সবচেয়ে শক্তিশালী অস্ত্র। এই অস্ত্র ভোঁতা হলে উন্নয়নের গতি স্থবির হয়ে পড়ে।
বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থার সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো গুণগত মানের অভাব। পরিসংখ্যান বলছে, প্রাথমিক স্তরে ভর্তি হার প্রায় শতভাগ হলেও শেখার ফলাফল সন্তোষজনক নয়। অনেক শিক্ষার্থী প্রাথমিক শিক্ষা শেষ করেও পড়া বোঝা ও গাণিতিক দক্ষতায় পিছিয়ে থাকে। এর পেছনে দায়ী অদক্ষ শিক্ষক নিয়োগ, প্রশিক্ষণের ঘাটতি এবং পরীক্ষানির্ভর মূল্যায়ন পদ্ধতি। শুধু পাশ করানো নয়—শিক্ষার্থীকে বাস্তব জীবনে কাজে লাগবে এমন জ্ঞান ও দক্ষতা দেওয়া এখন সময়ের দাবি।
আরেকটি বড় সংকট নীতিগত অস্থিরতা। ঘন ঘন শিক্ষানীতি পরিবর্তন, সিলেবাসের অসঙ্গতি, বিতর্কিত বই ছাপানো—এসবের ফলে শিক্ষক-শিক্ষার্থী উভয়ের মধ্যেই বিভ্রান্তি তৈরি হয়। শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও জাতীয় শিক্ষাক্রম বোর্ডের মধ্যে সমন্বয়ের অভাব প্রকট। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে দুর্নীতি ও রাজনৈতিক প্রভাব, যা শিক্ষক নিয়োগ থেকে শুরু করে প্রকল্প বাস্তবায়ন—সবখানেই বিদ্যমান।
এ অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য প্রথম প্রয়োজন নিবিড় নজরদারি। শিক্ষাক্ষেত্রে স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে একটি স্বাধীন তদারকি সংস্থা থাকা জরুরি, যারা রাজনৈতিক চাপমুক্ত থেকে পাঠ্যক্রম, শিক্ষক প্রশিক্ষণ, অবকাঠামো উন্নয়ন এবং বাজেটের সঠিক ব্যবহার নিশ্চিত করবে। এই সংস্থা নিয়মিতভাবে শিক্ষার মান মূল্যায়ন করবে এবং ফলাফল জনসম্মুখে প্রকাশ করবে।
দ্বিতীয়ত, জবাবদিহিতা প্রতিষ্ঠা করা অপরিহার্য। শিক্ষা মন্ত্রণালয়, স্থানীয় শিক্ষা অফিস, বিদ্যালয় পরিচালনা কমিটি—সব পর্যায়ে জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে হবে। শিক্ষক-অভিভাবক-শিক্ষার্থীর জন্য আলাদা অভিযোগ গ্রহণের ব্যবস্থা থাকতে হবে, যাতে দ্রুত সমাধান সম্ভব হয়। প্রকল্প ব্যয়ে অনিয়ম ধরা পড়লে কঠোর শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে।
পাশাপাশি শিক্ষকদের পেশাগত মর্যাদা ও প্রশিক্ষণ বৃদ্ধি করতে হবে। প্রশিক্ষিত, উদ্যমী ও প্রযুক্তি-সক্ষম শিক্ষক ছাড়া শিক্ষার মানোন্নয়ন সম্ভব নয়। সরকারি বিদ্যালয়ের অবকাঠামো ও সুযোগ-সুবিধা সমানভাবে উন্নত করতে হবে, যাতে শহর-গ্রামের ব্যবধান কমে আসে।
সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো দীর্ঘমেয়াদি স্থিতিশীল নীতি। রাজনৈতিক দল পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে শিক্ষানীতি পাল্টে গেলে ধারাবাহিকতা নষ্ট হয়। শিক্ষা হতে হবে জাতীয় ঐকমত্যের জায়গা—যেখানে দল-মত নির্বিশেষে একটি অভিন্ন রূপরেখা মেনে চলা হবে।
শিক্ষা ব্যবস্থার ভঙ্গুর অবস্থা শুধু প্রজন্ম নয়—সমগ্র জাতির ভবিষ্যৎকে ঝুঁকির মুখে ফেলছে। তাই এখনই সময় সাহসী সিদ্ধান্ত নেওয়ার, যেখানে নজরদারি ও জবাবদিহিতা হবে শিক্ষার সংস্কারের মূল ভিত্তি। উন্নত বাংলাদেশ গড়তে হলে শিক্ষার মজবুত ভিত্তি গড়ে তোলা ছাড়া বিকল্প নেই।