Thursday, September 18
Shadow

অমর প্রেম

সুমন বিপ্লব

আমাকে একটি কবিতা দিও।” একটি মেয়েলি কন্ঠ ভেসে এলো কাজলের কানে। সে লজ্জায় পিছনে তাকাতে পারিনি। মনে মনে সে ভাবে কে এই মেয়েটা ? কি করে জানলো সে যে কবিতা লেখে ? মাত্র ৪ দিন সিলেটের আকিলপুর গ্রামে কাজের লোক হয়ে এসেছে। এ গ্রামের সাবেক মেম্বর মুক্তার আলী তাকে শাহজামাল (র.) মাজার থেকে নিয়ে এসেছেন। আকিলপুর আসার ৪র্থ দিন সন্ধ্যায় আনফর চাচা তাকে নিয়ে পাড়ায় এলো একটি বাড়িতে। তাদের বসতে দেওয়া হলো। একজন বয়স্ক লোককে চিনতে পানতে পারল। তিনি পূর্বের দিন কাজল যখন রানাদের বাড়িতে ছড়া পড়ে ছিল তিনি তখন বসে বসে ছড়াগুলো তিনি মনোযোগ সহকারে শুনেছিলেন। তিনি দুটি মেয়েকে দেখিয়ে বললেন,

: এই আমার বড় মেয়ে নাম করুনা। শিক্ষকতা করে। ছোট মেয়ে হেনা। ৮ম শ্রেণিতে পড়ে।

কাজল মনে মনে ভাবল তার মত একজন সামান্য কাজের লোককে কেন তার মেয়েদের সাথে পরিচয় করে দিচ্ছে। চাচা একসময় বললেন,

: তোমার কবিতাগুলো কও।

কাজল একে একে ৪টি নিজের লেখা ছড়া বলল। করুনা খাতায় লিখে ফেলল। হেনার একটি ছড়া দেখালো। সে ভুল গুলি ঠিক করল। হেনাকে নিয়ে একটি ছড়া লিখলো। তা শুনে সবাই খুব খুশি হল।

: শোন বাবা, আমার মেয়েরা লেখালেখি করে তুমি সময় পেলে চলে আসবে। আজ থেকে তুমি আমার এক ছেলে।

কাজল অবাক হয়ে গেল কারণ তার মত একজন ছেলের সাথে তার শিক্ষিত মেয়েদের সাথে কেন পরিচয় করে দিল।

কয়েক দিন পর মুক্তার আলী তাকে একটি কলম ও খাতা কিনে দিলেন। ছড়া লিখে ওদের দেখাতো। ওরা মনোযোগ সহকারে পড়তো। তার উৎসাহে ওরাও একসময় ছড়া লেখা শুরু করে। তারা ছড়া লিখে অপেক্ষা করত কখন কাজল আসবে তাদের ছড়া ঠিক করে দিবে। একসময় তাদের লেখা পত্রিকায় প্রকাশের ব্যবস্থা করে দেয়। তারা আরো উৎসাহ পেতে থাকে। হেনা কাজল ছাড়া ভাবতে পারে না। একদিন না এলে হেনা ভাত খেতে পারে না। তার মাথায় একটাই কাজল তার জীবন থেকে চলে গেলে বড় লেখক হতে পারবে না। কাজল যখনই আসত তখনই কিছু না কিছু খাওয়াতে না পারলে হেনা মনে শান্তি পেত না। কাজল মনে মনে ভাবে কোন নারী তাকে এমন ভাবে হৃদয়ে ঠাই দিবে কখনো তো আশাই করিনি। একদিন হেনার ঘাড়ে ব্যথা হল। কাজল সিলেট শহরে। হেনা কান্না কাটি করছে তার পিতা ডাক্তারের কাছে নিতে যাচ্ছে কিন্তু যাবে না। তার বিশ্বাস কাজল ঘাড়ে হাত বুলালে সেরে যাবে। কাজল সিলেট থেকে এসে আগে হেনাদের বাড়ি যায়। বাড়ি আসতেই হেনার বাবা বললেন,

: তুমি কোথায় ছিলে ?

: সিলেট।

: তাড়া-তাড়ি ঘরে যাও। হেনার ঘাড়ে ব্যথা।

কাজল ঘরে গিয়ে হেনার ঘাড়ে কিছুক্ষণ ম্যাসেজ করে দিয়ে ডাক্তারের কাছে যেতে বললে তখন গেল। কাজল মনে মনে ভাবে তার মধ্যে কি পেয়েছে। হেনা যখন শিক্ষকের কাছে পড়ে কাজল পাশে বসে থাকতো। মনে মনে ভাবত ওকে যদি পড়াতে পারত। প্রতি সপ্তাহে বিভিন্ন পত্রিকায় তার লেখা প্রকাশ পেতে থাকে। সাথে সাথে তার খ্যাতি পেতে থাকে। দিন দিন কাজলের প্রতি ভালবাসা বাড়তে থাকে। প্রায় তারা শুধু দুই জন ঘন্টার পর ঘন্টা বসে আলোচনা করত। মাঝে মাঝে তার বোনেরা চা নিয়ে আসত হেনা তখন দশম শ্রেণিতে ওরা ঘরে বসে কথা বলছে পরিবারের কেউ কিছু মনে করে না। ওদের ছিল পবিত্র প্রেম। কাজল তার শরীরে কখনো হাত দেই নি। ইচ্ছে করলে দিতে পারত হয়ত হেনা কিছুই মনে করত না। কিন্তু সে তার প্রেমকে অপবিত্র করতে চাই নি। সিলেটে ছড়া পরিষদ থেকে ছড়া উৎসব হবে। ছড়াকার সুফিয়ান আমেদ চৌদুরী আকিলপুর থেকে ওদের নিয়ে যেতে বলেছিলেন। গ্রামের বেশ কয়েক জনকে নিয়ে ছড়া উৎসবে যায়। ঘোষক একে একে ছড়াকারদের নাম ঘোষণা করতেই সবাই মাইকের সামনে গিয়ে ছড়া বলছে। এক সময় হেনার নাম বলতেই সামনের সবাই চিৎকার দিয়ে উঠল,

: এই সেই হেনা ?

হেনা লজ্জা পেল। মনে মনে ভীষণ আনন্দিত হল তার পরিচিতি ও খ্যাতির কথা জানতে পেরে কাজলের প্রতি ভালবাসা আরো গভীর হল। এতদিন গ্রামের সবাই জানত তাদের প্রেমের কথা এই ছড়া উৎসবের পর শহরের লেখকরাও বুঝতে পারল তাদের প্রেমের কথা। ঢাকার পত্রিকায় তার লেখা প্রকাশ পাওয়া শুরু করল। আর ঢাকার লেখকরা তাদের প্রেমের কথা জেনে গেল। তাদের নিয়ে এতো আলোচনা, সমালোচনা হত কিন্তু হেনার পরিবারের কেউ কিছুই মনে করত না। সে এস. এস. সি পাশ করে সিলেট শহরের আম্বরখানায় একটি কলেজে ভর্তি হল। হেনা কাজলকে জানালো শহর থেকে কিছু বিজ্ঞানের সেরা ছাত্রদের হাতের লেখা নোটের ব্যবস্থা করতে। মিহির ও জাকির নামে দুজন ছাত্রের নিকট থেকে নোট নিয়ে আসে। হেনাদের ঘরে বসে কথা বলছে এক সময় বলল,

: আমি একটা সমস্যার পড়েছি।

: কিসের সমস্যা ?

: ইংরেজির জন্য একটি কোচিং – এ ভর্তি হয়েছি। এখানে ৩৫ জন ছাত্র-ছাত্রী পড়ে। এখন টেনস পড়াচ্ছে কিন্তু আমি গ্রামের স্কুলে শিখিনি। আমি ছাড়া সবাই শহরের। তারা সবাই পারে। আমার  জন্য প্রথমে যেতে পারছে না। এখন কি করি।

কাজল রাতে এসে গ্রামার নিয়ে বসল। পড়তে পড়তে রাত তিনটায় ঘুমালো। একাই চেষ্টা করে শিখে ফেলল। পরদিন হেনাকে জানালো সে শেখাতে পারবে। পরদিন সকাল ৬টায় পড়ানো শুরু করল। মনে মনে ভাবে সে যখন ৮ম শ্রেণিতে পড়তো সেই সময় ভাবতো হেনাকে পড়ানো। সে যখন কলেজে তখন পড়ানোর সুযোগ এলো। ওদের সম্পর্ক আরো গাঢ় হল। কেউ কাউকে না দেখে থাকতে পারত না। ১৯৯৫ সালে ড. মঞ্জুশ্রী একাডেমির পাঠাগার বিভাগের কার্যক্রম শুরু হলে হেনা তাকে অনেক সাহায্য করত। তারা তখনো জানে না প্রেমের শেষ কোথায় ?

লেখক: প্রতিষ্ঠাতা

আলী আকবর স্মৃতি পাঠাগার

শাহ্পুর, ডুমুরিয়া, খুলনা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *