Tuesday, September 16
Shadow

ভ্রান্তির সমীকরণ

সাবরিনা তাহসিন

একটা সামান্য ভুল! ভুল তো মানুষ মাত্রই হয়।না জএনে কিছউ করা মানে ভুল। সব কিছু জেনে ভুল করলে সেটা ভুলের মাত্রা ছাড়িয়ে অন্যায়ে রূপ নেয়। অন্যায়ের প্রভাবে জন্ম নেয় ক্ষোভ ,ঘৃণা ,আক্রোশ । ফাটল ধরিয়ে দেয় সম্পর্কে।বন্ধুত্বের দেওয়ালে ভাঙ্গন ধরে।

অলক ও বীণার বন্ধুত্ব অনেকদিনের। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে পরিচয়।সেই বন্ধুত্বে কোনো কমতি ছিলো না। আলাপচারিতার ফাঁকফোঁকরে হাসি-ঠাট্টা ,তামাশা সবটাই চলতো।প্রযুক্তির সুবাদে আধুনিকত্বের ছোঁয়ায় প্রতিদিনই চলতো কথার আদান-প্রদান।বীণার মিসডকল ভোরবেলার পাখি হয়ে অলকের ঘুম ভাঙ্গায়।বীণা অলককে মানুষ হিসেবে যতোটুকু জানে , সব দিক থেকে ঠিকঠাক। কিন্তু , অলকের একটাই বদভ্যাস।কারণে -অকারণে সিগারেট না ধরালে চলেই না।বীণা অলককে ধূমপানের সুফল-কুফল সম্পর্কে বুঝায়।অলককে অনেকবার ধূমপান করতে বারণ করে।কিন্তু ,বারণ মানে কে!

দেখতে দেখতে কীভাবে যেন দেড় বছর কেটে যায়।দেড় বছর অনেক দীর্ঘ সময়।কিন্তু মজার ব্যাপার হলো ,বীণা অলক কেউই কাউকে সামনাসামনি দেখে নি। তাই তারা ঠিক করলো ,একদিন দেখা করবে।রৌদ্রোকজ্জ্বল দুপুরে নির্ধারিত সময় বীণা পার্কে এলো বীণা অলকের জন্য পার্কের বেঞ্চিতে বসে অপেক্ষায় রত।হালকা ঝিরিঝিরি হাওয়ায় গাছের পাতায় দোল লাগে।ফেরিওয়ালার হাঁক-ডাক ,মাঠে চলে ক্রিকেট ক্লাবের অনুশীলন, পাতার ফাঁকে ফাঁকে পাখির কিচিরমিচির সব মিলিয়ে কতোটা সুন্দর মনোরম পরিবেশ।

ইতিমধ্যে অলক পার্কে এসে হাজির। পরষ্পরকে চিনতে বেশি বেগ পেতে হয় নি। প্রথম সাক্ষাতে বীণার ভিতর কিছুটা সংকোচবোধ কাজ করে।কিন্তু অলকের রসাত্মক কৌতুকে সেই সংকোচ কেটে যায় সহজেই। মৃদুমন্দ সমীরণ বেগ বয়ে যায়। পাশাপাশি বসে দু’জনের কথা হয় কিছুক্ষণ। কথায় থাকে স্মৃতিচারণ, নানা রঙের কল্পনা ,কতক হাস্যরস মেশানো বাক্যালাপ।কথাবার্তার এক পর্যায়ে অলক পকেট থেকে সিগারেট বের করে।আগুন ধরায় সিগারেটে।বিষয়টা লক্ষ্য করে বীণা। অলক জ্বলন্ত সিগারেট মুখে নিতে যাবে এমন সময় ,বীণার তীক্ষ্ণ দৃষ্টি দেখে আধ-পোড়া সিগারেট ফেলে দেয়।সিগারেটের ধূম্রচ্ছটায় মনোরম প্রাকৃতিক পরিবেশে কিছুটা ছন্দপতন ঘটে।

এক ফাঁকে অলক বীণাকে বলে, ” চলো ,পাশের ক্যাফেতে কিছু খাওয়া যাক।” বীণা অলকের প্রস্তাবে সম্মতি জানায়, ” মন্দ হয় না।অনেকক্ষণ পেটে কিছু পড়ে নি।খিদেও পেয়েছে।”ক্যাফেতে মেন্যুর তালিকায় ফুচকা-চটপটি।অলক দুই প্লেট ফুচকার অর্ডার দেয়।টেবিলে দুই প্লেট ফুচকা।ক্যাফেতে হালকা ভলিওমে চলে রেডিও। চিরকুট ব্যান্ডের ভোকাল সুমির কন্ঠ ভেসে আসে।জমজমাট পরিবেশ।খাওয়ার সময়ও হয় কথার ফুলঝুরি।ক্যাফের সাইনবোর্ডে বড় করে লেখা ” ধূমপান করা নিষেধ ।”

বীণা অলককে সাইনবোর্ডের লেখা দেখিয়ে বলে ,” দেখেছো ,ধূমপান স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। আমার কথা তো শুনো না।”

স্মিত হেসে অলক বলে, “কথাটা সত্য।কিন্তু আমারই বা কী দোষ!ধূমপান আমাদের বংশানুক্রমিক ধারায় চলে আসছে। “

বীণা এ কথা শুনে মনে মনে বলে ,বংশানুক্রমিক ধারা।কী অদ্ভুত কথা! খাওয়া-দাওয়া পর্ব শেষে অলকই বিল দেয়।

অনেকটা দেরী হয়ে গেছে।বাড়ী যেতে হবে।অনেকটা পথ হাঁটতে হাঁটতে দু’জনেই ক্লান্ত। অলক একটা রিকশা নেয়।হুডতোলা রিকশায় অলকের পাশে বসে বীণা।রিকশা চলতে থাকে।বীণার খোলাচুল বাতাসে উড়তে থাকে।একমুহূর্তে অলকের কী মনে হয় কে জানে ? অলক বীণার নরম কোমল হাত ধরতে চায়।অলক বলে ,” তোমার হাতটা ধরা যাবে ?”বীণা জবাবে বলে,” কেন নয় ,নিশ্চয়ই ধরা যাবে।”অলক বীণার হাত শক্ত করে ধরে।বীণার মধ্যে একটা শিহরণ জাগে।আচমকা অলক বীণার কপোলে উষ্ণ চুম্বনের চিহ্ন এঁকে দেয়।চমক ,বিস্ময়ের ঘোর লাগে বীণার মধ্যে।বীণার লাজুক চোখের দৃষ্টিতে অলক নিজেকে সংবরণ করে।একটা মোড়ে এসে বীণা বাড়ির উদ্দেশ্যে পা বাড়ায়।পিছনে ফিরে বলে ,”আবার হবে তো দেখা।”অলক বিনয়ের সাথে বলে ,” যখনই বলবে,তখনই আসবো,ঘুরবো একসাথে।”

একসময় বীণা রহস্যটা জানার জন্য অলককে ফোন দেয়।প্রথমে মান-অভিমানের খেলা চলে।বীণা অলকের খবরাখবর জানতে চায়। অলক পরিহাসের সুরে বীণাকে বলে,” ভালো থাকতে দিলে কই ?”তারপর ক্ষণিকের নীরবতা।বীণার কন্ঠ ধরে আসে।চোখ ভরে যায় অশ্রুতে।

(রোমান্টিক ছোটগল্প)

দু’জনেই হাসিমুখে বিদায় নেয়।এরপর হাসি-আনন্দেই কাটে দিন। কিন্তু আনন্দের মুহূর্তটা যে সাময়িক ক্ষণের, সেটা কী কেউ জানতো!একদিন ঘূর্ণিবায়ুর মতো অমৃতার প্রসঙ্গ এলো। অলক বীণাকে জানায়, অমৃতার সাথে অলকের পরিচয় নয় বছরের। এর আগে অলক বীণাকে অমৃতার বিষয়ে কিছুই বলে নি। অমৃতার সআথএ বীণার কথা হয়।বীণা অমৃতাকে একদিন মুখ ফসকে অলকের সাথে দেখা করার প্রসঙ্গটা বলে দেয়। এটা শুনে অমৃতার বড় রাগ হয়।অলক বীণার কাছে অমৃতাকে এসব বলার কারণ জানতে চায়।বীণা অলককে সমস্তটা জানায়। অলক একটু রাগ করে বটে ,কিন্তউ পরক্ষণে শআনঅতভাবে বলে ,” অমৃতার কাছে ক্ষমা চাও।”বীণা অমৃতার কাছে ক্ষমা চেয়ে মেসেজ দেয়, কিন্তু অমৃতা রাগে,ক্ষোভে-দুঃখে সেটাও দেখে নি।বীণা-অলকের বন্ধুত্বে চিড় ধরে।কথা বন্ধ থাকে অনেকদিন।মধুর বন্ধুত্বের দূরত্ব বেড়ে যায়।বীণার মনে অনেক প্রশ্ন জাগে, কী এমন ঘটলো-যার জন্য কথা বলা বন্ধ! কিংবা সবকিছুই হচ্ছে ,কিন্তু আগের মতো প্রাণবন্তভাব নেই।কেমন যেন নিস্তেজ।অলকের সাথে অমৃতার তো শুধুই নয় বছরের পরিচয় আর বন্ধুত্ব। শুধুই বন্ধুত্ব! নাকি এর থেকেও বেশি কিছু–এরকম অনেক ভাবনা দানা বাঁধে বীণার মনে।বীণা যখন এরকম অনেক ভাবনার সমুদ্রে ভাসমান, তখন মানব নামের এক ছেলে দেবদূতের মতোই যেন হাজির হয়।মানবের সাথে বীণার পরিচয়সূত্রে জানা যায় ,মানব অমৃতার এক সময়কার বন্ধু।মানব অমৃতাকে নয় বছর ধরে জানে। মানব বীণার কাছে অমৃতার বর্তমান পরিস্থিতি জানতে চায়। বীণা মানবকে অলক-অমৃতার সম্পর্কের বিষয়ে জানায়।তারপর মানব বীণাকে অলক-অমৃতার ছবি দেখায়।বীণা সেই ছবি দেখে স্তম্ভিত হয়।পরক্ষণে বীণা আবিষ্কার করে, অমৃতা বীণার স্কুল জীবনের সহপাঠী।আনন্দ-বেদনার মুহূর্তটা পাশাপাশি চলতে থাকে। 

অশ্রুভেজা কন্ঠে বীণা অলককে জিজ্ঞেস করে, “অমৃতার বিষয়টি আগে বলো নি কেন? তোমাদের মধ্যে কী শুধুই বন্ধুত্ব নাকি আরও কিছু ?”অলক বীণাকে কান্না থামাতে অনুরোধ করে।অলক বীণাকে বলে ,” তুমি আমার অনেক ভালো বন্ধু।তোমাকে আমি বিশ্বাস করি।আসলে তোমার সাথে আমার যখন পরিচয় হয় ,তখন অমৃতার সাথে বিচ্ছেদ ছিলো।তাই অমৃতার সম্পর্কের বিষয়টা বলা হয় নি।”

বীণা বলে,” তুমি বলেছিলে ঘৃণা,অবহেলায় কখনও আমাকে দূরে ঠেলে দিবে না।”

অলক বলে,” দুই পরিবারের সম্মতিতে অমৃতার সাথে আমার আংটি বিনিময় হয়।কিছুদিনের মধ্যে আমরা জীবনসঙ্গী হবো।সত্য গোপন করাটা আমার উচিত হয় নি।এখন সবকিছুর জন্য নিজেকে বড় অপরাধী মনে হচ্ছে।” 

বীণাকে স্বান্তনা দিয়ে বলে,”আমি তোমার মনের অবস্থাটা বুঝতে পারছি।তুমি যেমন আমার ভালো বন্ধু ছিলে, তেমনি ভালো বন্ধু রবে।যখন ইচ্ছা হয় ,আমার সাথে যোগাযোগ করবে।”

বীণা ফোন রাখে।বীণার মধ্যেও শূন্যতা ও অসহায়বোধ কাজ করে।বীণার সুর কেটে যায়।হৃদয় ফেঁটে চৌচির হয়।বীণার হৃদয়ে হাহাকার ধ্বণিত হয়।অলক নামের যে বন্ধুকে সে এতোটা বিশ্বাস করতো ,সেই বন্ধু এরকম সত্য গোপন করলো!অমৃতার অবহেলা ,অলকের রূঢ় ব্যবহার, সত্য গোপন সবকিছুই বীণাকে অসহনীয় যন্ত্রণায় কাতর করে তোলে।এখন প্রতিটা মুহূর্ত একরাশ শূন্যতার মধ্যে কাটে। এতোটা আঘাত কাটিয়ে উঠা কষ্টকর। বীণার তো কোনও দোষ ছিলো না।বীণা তো কিছুই জানতো না।তাই সে ভুল করেছে। আর বীণা সেই ভুল স্বীকারও করেছে।কিন্তু অলক তো সবটা জানতো।তবুও সে একবারও বীণাকে জানায় নি।সত্য গোপন করেছে। সত্য গোপন করাটা তো ভুল করার থেকেও বড় অপরাধ। এই অপরাধের কারণেই অমৃতার মনে অলকের প্রতি সন্দেহ জন্মে।অনামিকার আংটিতে ঝড় উঠে।একটা ভ্রম সুন্দর পরিবেশকে ঘোলাটে করে তোলে।অবিশ্বাসের ঘূর্ণিবাতাস বয়ে যায়।যার প্রভাব এসে পড়ে অলক, অমৃতা ,বীণার জীবনে।বীণার স্মৃতিতে বাজে পুরোনো দিনের ঝংকার।কিন্তু অলক, অমৃতার কী বীণার কথা মনে পড়ে কোনোদিন? নাকি ঘৃণায়,আক্রোশে চাপা থাকবে সব? বন্ধুত্ব কী এতোদিন ঠুনকো?তবুও বীণা আশা করে,”আবার হবে তো দেখা। “

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *