Monday, July 21
Shadow

পুরোনো রূপে ফিরছে কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ

মুসাদ্দিকুল ইসলাম তানভীর: কিছুদিন আগে শেষে হয়েছে মাধ্যমিক স্কুল সার্টিফিকেট (এসএসসি) পরীক্ষা। অপেক্ষা এখন স্কুলের গন্ডি পেরিয়ে কলেজ জীবনে প্রবেশের। স্বপ্ন আর প্রত্যাশিত সফলতা অর্জনে এখানেও পাড়ি হয় দীর্ঘ পথ আর প্রতিযোগিতার। সেই গল্পে ময়মনসিংহ অঞ্চলের শিক্ষার্থীদের কাছে অন্যতম প্রত্যাশিত প্রতিষ্ঠান ‘কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ’ (কেবি কলেজ)। বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় (বাকৃবি) চত্বরে অবস্থিত কলেজটি ময়মনসিংহ ও এর আশেপাশের জেলাগুলোর শিক্ষার্থীদের কাছে অত্যন্ত পরিচিত ও সনামধন্য একটি কলেজ।

মাঝে দীর্ঘদিন কলেজ ব্যবস্থাপনা ও প্রশাসনিক জটিলতায় দিন দিন পিছিয়ে পড়েছিল কলেজটি। তবে কলেজটির অধ্যক্ষ ড. মো. আতাউর রহমান পুনরায় সপদে যোগদানের পর সেই জটিলতা কেটে গিয়েছে। অতীতের সকল ব্যর্থতা ফেলে এখন আবারও সামনে এগিয়ে যেতে চায় কলেজটি। পুরোনো ঐতিহ্য আর সফলতা ছাপিয়ে যেতে এখন তারা বধ্য পরিকর।

বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রবেশমুখে পা রাখলেই প্রথমেই চোখে পড়বে কেবি কলেজের সুদৃশ্য ফটকটি। তিন একর জায়গা জুড়ে অবস্থিত কলেজটিতে বিজ্ঞান ও ব্যবসা শিক্ষা বিভাগে শিক্ষার্থীরা অধ্যয়ন করে। ২০২৫ সালের উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় কেবি কলেজ থেকে ৭৮৩ জন শিক্ষার্থী অংশগ্রহণ করছেন। পরীক্ষার্থীদের জন্য কলেজের পক্ষ থেকে সম্পূর্ণ বিনা মূল্যে তিন মাস অতিরিক্ত ক্লাস ও মডেল টেস্ট কার্যক্রম চালু রখা হয়, যা প্রতিষ্ঠানের একাডেমিক কার্যক্রমে একটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ। এছাড়াও পূর্ণাঙ্গ কলেজ হিসেবে এবছর মানবিক শাখা খোলারও পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। অর্জনের ঝুলিতে কলেজটির রয়েছে গৌরবময় ইতিহাস। ২০০৭ সালে ঢাকা বোর্ডে সেরা দশ এবং ২০০৮ সালে সেরা ১৪ অবস্থানে থাকার গৌরব অর্জন করে কেবি কলেজ। কলেজটি ওই সময়ে দেশের শীর্ষস্থানীয় কলেজসমূহকে পিছনে ফেলে সর্বোচ্চ জিপিএ-৫.০০ অর্জনেরও রেকর্ড করে। এছাড়া বুয়েট, মেডিকেল এবং বিভিন্ন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে সর্বোচ্চ চান্সপ্রাপ্তির রেকর্ডও কলেজের অর্জনে যুক্ত হয়। ২০২৪ সালে কৃষি গুচ্ছ ভর্তি পরীক্ষায় প্রথম স্থান অর্জন করে কেবি কলেজের শিক্ষার্থী জাইমুন ইসলাম। এছাড়া ৪৪তম বিসিএসে প্রশাসন ক্যাডারে প্রথম স্থান অর্জন করেন কলেজটির প্রাক্তন শিক্ষার্থী ফরহাদ হোসেন।

তবে প্রশাসনিক জটিলতা ও রাজনৈতিক কারণে ২০১৬ থেকে ২০২৪ পর্যন্ত একরকম থমকে ছিল কলেজটি। তবে উচ্চ আদালতের রায়ে গত বছরের ২ সেপ্টেম্বর পুনরায় দায়িত্বে ফিরে আবারও কলেজকে এগিয়ে নিতে কাজ শুরু করেছেন কলেজটির অধ্যক্ষ ড. মো আতাউর রহমান। 

জানা যায়, ভিন্ন রাজনৈতিক মতাদর্শের জন্য ড. আতাউর রহমানকে ২০১৬ সালে সাময়িক ও ২০১৯ সালে কলেজের অধ্যক্ষ পদ থেকে বহিষ্কার করা হয়। এরপর বহিষ্কারাদেশ বিরুদ্ধে আইনি লড়াইয়ে যান তিনি। অভিযোগ আছে, তৎকালীন ফ্যাসিস্ট আমলের দুই শিক্ষামন্ত্রী, আইনমন্ত্রী এবং এটর্নি জেনারেলসহ উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তাদের ব্যবহার করে অন্যায়ভাবে মামলাটি প্রভাবিত করে দীর্ঘায়িত করা হয়েছে। দীর্ঘ আট বছর তাঁর বিরুদ্ধে মামলা পরিচালনা করার ক্ষেত্রে কলেজের কতিপয় শিক্ষকের বিরুদ্ধে নানা দুর্নীতির অভিযোগ ওঠে। এডভোকেটের বিলের অসংখ্য ভুয়া ভাউচার দাখিল, মামলা সংক্রান্ত বিভিন্ন ব্যক্তিকে ঘুষ প্রদানের কথা বলে নানা অনিয়মের মাধ্যমে তাঁর মামলার ক্ষেত্রে স্বাভাবিকের তুলনায় বহুগুণ অর্থ ব্যয় হয়। যার পরিমাণ প্রায় ৩৩ লাখ টাকা বলে অভিযোগ রয়েছে। 

কলেজের অধ্যক্ষ ড. মো. আতাউর রহমান বলেন, ২০০৬ সালে যোগদানের পর পুরাতন ক্যাম্পাস হতে কলেজটিকে তিন একর জায়গা নিয়ে নতুন ক্যাম্পাসে স্থানান্তর করি এবং নবনির্মিত নতুন ভবনে শিক্ষার আলো ছড়িয়ে দেয়ার জন্য কলেজে শাখা সম্প্রসারণসহ ব্যবসায় শিক্ষা শাখাও চালু করা হয়। এবছর মানবিক শাখাও চালু হবে। শিক্ষার্থীদের জন্য যা যা করা প্রয়োজন, কলেজ কর্তৃপক্ষ অত্যন্ত আন্তরিকতার সাথে তা করছে। কলেজের অবকাঠামো উন্নয়ন, নতুন ল্যাব প্রতিষ্ঠা, লাইব্রেরি প্রতিষ্ঠা, নিয়মিত ক্লাস পরীক্ষার তদারকিসহ গ্রুপ ডিসকাসন কার্যক্রম, লেকচার সিট প্রদান, পরিকল্পিত ক্লাস রুটিন, মাল্টিমিডিয়া ক্লাসের সর্বোচ্চ প্রয়োগ, কাউন্সিলিং কার্যক্রম গতিশীল করাসহ নানাবিধ কার্যকর পদক্ষেপ শিক্ষকগণের সহযোগিতায় বাস্তবায়ন করা হয়েছে। শিক্ষকগণকে নিয়ে নিয়মিত মিটিং করার মাধ্যমে বিভিন্ন কমিটি সমূহের প্রতিটি কাজের অগ্রগতি পর্যালোচনা করা হয়। এছাড়াও দীর্ঘদিন ধরে বন্ধ থাকা বিজ্ঞান ক্লাব, ভাষা ক্লাব, বিতর্ক ক্লাব, রেডক্রিসেন্ট এর কার্যক্রম পুনরায় চালু করার পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। একাডেমিক কার্যক্রমকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে কলেজের ক্লাস-পরীক্ষা ব্যবস্থাপনা, শিক্ষার্থী উপস্থিতি, ক্লাসে মানসম্মত পাঠদানের ক্ষেত্রে অত্যন্ত কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে।  বিগত আট বছরে কলেজে শিক্ষার্থী উপস্থিতি ছিল বড় চ্যালেঞ্জ। যেখানে ২০ থেকে ৩০ শতাংশ শিক্ষার্থী কলেজে উপস্থিত হত, সেটি এখন কলেজের সকল ক্লাসসমূহে ৯০ শতাংশে উন্নীত হয়েছে। কলেজের শিক্ষকদের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় প্রি-টেস্ট পরীক্ষার পর টেস্ট প্রস্তুতি বিশেষ ক্লাস ও পরীক্ষা এবং টেস্টের পর চূড়ান্ত পরীক্ষার বিশেষ মডেল টেস্ট কার্যক্রমের যে পরিকল্পনা গ্রহণ করেছিলাম, তা বাস্তবায়িত হয়েছে।

বিগত সময়ের দুর্নীতির বিষয়ে অধ্যক্ষ জানান, কলেজে যোগদানের পর কখনোই অন্যায়ের সাথে আপোষ করিনি। স্থানীয় এলাকাবাসীর দেয়া প্রবল বাধা মোকাবেলা করে কলেজের চারপাশে নিরাপত্তা প্রাচীর নির্মাণ করা হয়, যা কলেজটিকে একটি একটি স্বতন্ত্র ও দৃষ্টিনন্দন ক্যাম্পাসে পরিণত করে। এছাড়াও কলেজের সবগুলো একাডেমিক ভবন, প্রধান গেইট, ক্যাম্পাসের শিক্ষার্থীদের চলাচলের জন্য পূর্ব গেইট, যাতায়াতের জন্য বাস ক্রয়, খেলা উপযোগী মাঠ তৈরি, শহীদ মিনার, আধুনিক ল্যাব তৈরি, লাইব্রেরী প্রতিষ্ঠাসহ কলেজের সকল ভৌত সুবিধাসমূহ নিশ্চিত করা হয়েছে সব চাপ মোকাবেলা করেই। শিক্ষকদের কল্যাণে শতভাগ বেতন-ভাতা, বাড়ি ভাড়া প্রদান, আপগ্রেডেশন নীতিমালা প্রনয়ণ, অবসরকালীন পেনশন, গ্র্যাচুইটি প্রদানসহ অন্যান্য সুবিধা নিশ্চিত করা হয়েছে, যা বাংলাদেশের অধিকাংশ কলেজেই নেই। এরপরও ফ্যাসিবাদী আমলে আমার প্রতি অবিচার করা হয়েছে, কলেজে দুর্নীতি ও লুটপাট হয়েছে, কলেজের এফডিআর ভেঙে অর্থ আত্মসাৎ হয়েছে, যার অনুসন্ধানে তদন্ত কমিটির কাজ চলমান রয়েছে। শুধু তাই নয় খুব নগন্য সংখ্যক ফ্যাসিবাদী ও তার দোসররা ঈর্ষাপরায়ন হয়ে নিজ স্বার্থ হাসিলের জন্য বিভিন্ন ষড়যন্ত্র করার জন্য এখনও সক্রিয় রয়েছেন। সকল ষড়যন্ত্রকারীদেরকে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়ে আরও দুর্বার গতিতে কলেজকে এগিয়ে নিতে আমরা প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। 

একাডেমিক কার্যক্রমের ক্ষেত্রে উভয় বর্ষে সর্বোচ্চ শ্রম দিয়ে এবং নানাবিধ পরিকল্পনায় বাস্তবায়নের মাধ্যমে কলেজের রেজাল্ট সর্বোচ্চ পর্যায়ে নিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে সকল শিক্ষককে দৃঢ়সংকল্পবদ্ধ করেন কলেজ প্রধান।

লেখক: শিক্ষার্থী, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *