Sunday, July 20
Shadow

অটিজম স্পেকট্রাম ডিজঅর্ডার প্রধানত বিকাশজনিত সমস্যা : কারণ ও প্রতিকার

অটিজমকে অনেকেই মানসিক রোগ ভেবে ভুল করেন। যে সমস্যার কারণে আক্রান্ত ব্যক্তি আর দশজন মানুষের সাথে স্বাভাবিক যোগাযোগ ও সামাজিক সম্পর্ক স্থাপনে ব্যর্থ হয় তাই অটিজম। রোগটি হলে শিশুদের মানসিক ও শারীরিক বিকাশকে বাঁধাগ্রস্থ করে। এ রোগ সম্পর্কে অধিকাংশ মানুষই অসচেতন।সুইস মনোবিজ্ঞানী অয়গেন বøয়লার ১৯১১ সালে সর্বপ্রথম অটিজমকে
এক প্রকার মানসিক রোগ হিসেবে চিহ্নিত করেন। এরপর থেকেই মুলত রোগটি নিয়ে অধিকতর গবেষণা শুরু করা হয়।রোগটি সম্পর্কে মানুষকে আরো জানানোর লক্ষ্যে এবং অটিজম শিশুদের মূল্যায়নের লক্ষ্যে বিশ^ব্যাপী সর্বপ্রথম ২০০৮ সালে ২ এপ্রিল বিশ^ অটিজম সচেতনতা দিবস হিসেবে ঘোষণা করা হয় এবং প্রতি বছর ২ এপ্রিল বিশ^ অটিজম দিবস হিসেবে পালন করা হয়।

প্রকার ভেদ
অটিজম বেশ কয়েক প্রকারের ভাগ করা হয়ে থাকে। যেগুলো হলো-ক্ল্যাসিক অটিস্টিক ডিজঅর্ডার, অ্যাসপার্জার্স সিনড্রোম, চাইল্ডহুড ডিসইন্টিগ্রেটেড ডিজঅর্ডার, এটিপিক্যাল অটিজম।তবে বেশিরভাগ সময় ক্ল্যাসিক অটিস্টিক ডিজঅর্ডার এবং অ্যাসপার্জার্স সিনড্রোমে আক্রান্ত হতে দেখা যাবে। ক্ল্যাসিক অটিস্টিক ডিজঅর্ডার সাধারণত শিশুর ৩ বছর হওয়ার পূর্বের এটি দেখা যায়। এটি মুলত শিশুর বিকাশে বাঁধা দেয় বা অনেকগুলো প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে। যেমন: শিশু দেরিতে কথা বলা, জানা ও বোঝার সমস্যা ইত্যাদি। ক্ল্যাসিক অটিস্টিক ডিজঅর্ডারকে আবার আর্লি ইনফ্যান্টাইল অটিজমও বলা হয়ে থাকে। অ্যাসপার্জার্স সিনড্রোমে আক্রান্ত শিশুরা কথা বলতে পারলেও এরা কারো সাথে মিশতে পছন্দ করে না বা মিশতে পারে না। এ রোগে আক্রান্ত শিশুরা যেকোন একটি কাজে খুব বেশী পারদর্শী হয়ে থাকে। কিন্তু অন্য কোনো কাজে বা বিষয়ে আবার একেবারেই অপারগ এবং কিছুই বুঝে উঠতে পারে না।

কখন ও কাদের হয়?
রোগটি সাধারণত শিশুর ১-৫ বছর বয়সের মধ্যে বেশি দেখা যায়। রোগটি বেশির ভাগই দেখা যায় ছেলেদের মধ্যে। মেয়েদের তুলনায় ছেলেদের মধ্যেই রোগটির প্রকোপতা বেশি। এ সময়ে অটিজম আক্রান্ত শিশুদের মধ্যে এ রোগ ছাড়াও খিঁচুনি (মূগী), বুদ্ধির ঘাটতি, অতিচঞ্চলতা বা হাইপার অ্যাক্টিভিটি, হাতের কাজ করতে না পারা, দাঁতের সম্যা, খাবার চিবিয়ে খেতে না পারা, হজমের সম্যা ইত্যাদি বিভিন্ন সমস্যা থাকতে পারে।

কারণ
অটিজম কেন হয়, তা এখনো সুনির্দিষ্টভাবে কারণ খুঁজে পাওয়া যায় নি। তবে কিছু কিছু বিষয়কে অটিজমের কারণ হিসেবে দেখা যায়।  বিশেষ করে জেনেটিক পরিবেশগত কারণ যেমন: কারো বংশে অটিজমের সমস্যা থাকা, গর্ভাবস্থায় অধিক দুশ্চিন্তা করা, পর্যাপ্ত ঘুম না হওয়া, অতিরিক্ত ঔষধ সেবন, গর্ভাবস্থায় অ্যালকোহল সেবন, ও ধুমপান
 গর্ভকালীন সংক্রমণ যেমন ঃ মাম্পস, রুবেলা, মিসেলস ইত্যাদি হওয়া
 গর্ভাবস্থায় অতিরিক্ত স্থুলতা ও ডায়াবেটিস রোগ হওয়া
 গর্ভাবস্থায় গ্যাস্ট্রোইনটেস্টাইনাল সমস্যা, অবসেসিভ কম্পালসিভ
ডিজঅর্ডার, মনোযোগ ঘাটতি, বাইপোলার ডিজঅর্ডার, সিজোফ্লেনিয়া, এডিএইচডি, পরিবারের অন্যদের সাথে গর্ভাবস্থায় সম্পর্ক ঘাটতি
 কম ওজনে শিশুর জন্ম নেওয়া, গর্ভাবস্থায় বিষাক্ত সিসাযুক্ত স্থানে বসবাসে শ্বাস-প্রশ্বাস নেওয়া
 প্রসবকালীন সময়ে জটিলতা, মা ও শিশুর অপুষ্টি জনিত সমস্যা ইত্যাদি কারণেও রোগটি হতে পারে।
লক্ষ্য করা যায় শহরে, শিক্ষিত, ধনী পরিবারে অটিজমে আক্রান্ত শিশুর সংখ্যা তুলনামূলক বেশি।

লক্ষণ
 অটিজমে আক্রান্ত শিশুর প্রধান সমস্যা হলো ভাষা, এ রোগে আক্রান্তদের মধ্যে ভাষা আয়ত্ব করতে সমস্যা হয়
 শিশু অযথা হাসে, কোনো ভয় বা বিপদ বোঝে না, ব্যথা পেলে কাঁদে না
 শিশুর মধ্যে অল্পমাত্রায় হলেও বুদ্ধিবৃত্তিক প্রতিবন্ধকতা দেখা দেওয়া, সেই সাথে কারো মাঝে শারিরিক বৃদ্ধির ঘাটতি দেখা দেওয়া

 দুই বছরের মধ্যে শিশু অর্থপূর্ণ শব্দ দিয়ে কথা বলতে না পারা, কথা বলতে জড়তা সৃষ্টি হওয়া
 শিশু চোখে চোখ রাখতে না পারা, নাম ধরে ডাকলে সাড়া না দেওয়া, হঠাৎ উত্তেজিত হয়ে ওঠা
 শিশুর মানসিক অস্থিরতা বেশি থাকা, সেই সাথে বিষন্নতা, উদ্বিগ্নতা ও মনোযোগের ঘাটতি দেখা দেওয়া
 এ রোগে আক্রান্ত শিশুরা দেখা, শোনা, শব্দ, গন্ধ স্বাদ, আলো, স্পর্শের প্রতি অনেক সংবেদনশীল বা প্রতিক্রিয়াহীন
 অন্যান্য সমবয়সী কিংবা বড়দের সাথে মিশতে না পারা, আদর অসহ্য করা, কারো প্রতি আগ্রহ না থাকা, এবং পরিবেশ অনুযায়ী মুখ অঙ্গভঙ্গি পরিবর্তন করতে না পারা
 সবসময় একা একা এমনকি ঘরের একটি নির্দিষ্ট স্থানে নিজের মত একা থাকা
 অন্যের সাথে পছন্দের বস্তু কিংবা খেলনা ভাগাভাগি না করা
 অন্যের থেকে শোনা কথা বারবার বলতে থাকা এবং বারবার একই আচরণ করতে থাকা
 নিজেকে আঘাত করায় প্রবণতা এবং পরিস্থিতির গুরুত্ব বুঝতে না পারা
 একটি নিজস্ব রুটিনমাফিক চলতে পছন্দ করা রুটিনের পরিবর্তন একেবারেই সহ্য না করা।


চিকিৎসা
বাংলাদেশে অটিজম সম্পর্কে ধারণা খুবই কম। যে কারণে শুরুতে রোগ নির্ণয় দূরু হয়ে পড়ে। ফলে চিকিৎসাও বিলম্বিত হয়। দ্রত রোগটি নির্ণয় করে বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী চিকিৎসা গ্রহণ করলে অন্যান্য শিশুদের মত উন্নতি করতে পারে। সবার আগে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের শরণাপন্ন হওয়া এবং দ্রত চিকিৎসা শুরু করা। যোগাযোগ ও আচরণগত থেরাপি, এপ্লায়েড বিহেভিয়ার অ্যানালাইসিস, অকুপেশনাল ও স্পীচ থেরাপি, সেন্সরী ইন্টিগ্রেশন থেরাপির মাধ্যমে অটিজম ও এর জটিলতার চিকিৎসা সম্ভব।


প্রতিরোধ
 পারিবারিক ও সামাজিক সচেতনতা অধিক প্রয়োজন
 গর্ভাবস্থায় যথাযথ চিকিৎসা করা, চিকিৎসকের পরামর্শবিহীন ছাড়া ঔষুধ সেবন না করা
 মায়ের মদ্যপান ও ধুমপান পরিহার করা
 বেশি বয়সে বাচ্চা না নেওয়া, এক্ষেত্রে পিতার বয়সকে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে
 নেওয়ার আগে রুবেলা ভ্যাকসিন নেওয়া

 বাচ্চাকে নিয়মিত বুকের দুধ সেবন করানো
 মায়ের ওজন বৃদ্ধি ও স্বাস্থ্য পরিচর্যা একান্ত প্রয়োজন
 ফিনাইল কিটোনোরিয়া ও সিলিয়াক রোগ দ্রত নির্ণয় করে চিকিৎসা গ্রহণ করা
 বাবা-মায়ের সিজোফ্রেনিয়া মুড ডিজঅর্ডার থাকলে বাচ্চার মধ্যে অটিজম সমস্যা দেখা যায়
 দূষণমুক্ত পরিবেশ পরিহার করা, কারণ বিভিন্ন দূষণ অটিজম সৃষ্টির জন্য দায়ী
 অটিজম আক্রান্ত ব্যক্তিকে শ্রদ্ধা, স্নেহ ও সম্মান করতে হবে। দেশের উন্নয়নে সর্বক্ষেত্রে অন্তর্ভূক্তি করতে হবে।
আসুন আমরা সবাই অটিজম সম্পর্কে সচেতন হই, গর্ভবতী মায়ের প্রতি বিশেষ যত্নবান হই। সে সাথে পরিবার, সমাজ এবং রাষ্ট্রের সর্বক্ষেত্রে অটিজম আক্রান্ত শিশুদের প্রতি সমবেদনা ও ভালোবাসা সৃষ্টি
করি। তাদের সুস্থ করে দেশের সম্পদে পরিণত করি।

মোঃ হুমায়ুন কবীর, হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসক, রেনেসাঁ হোমিও মেডিকেয়ার, ২৫/৩, নবাব কাঁটারা, নিমতলী, চাঁনখারপুল, ঢাকা- ১০০০

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *