Thursday, June 19
Shadow

২১৮টি দেশের ৮৪৮টি মুদ্রা রয়েছে যার সংগ্রহে!

আশিকুর রহমান সৈকত, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয় : সময়টা ২০০৩/২০০৪ সাল। বয়স যখন ছয় কিংবা বা সাত। সেসময় মামাবাড়ি তে তার দিদার একটা

বাক্সের মধ্যে তিনটা ভারতীয় ২ পয়সা আর ৫ পয়সার কয়েন পেয়েছিল জয়। দেখতে ভিন্নরকম বলে আগ্রহ জন্মেছিল তার, নিজবাড়িতে আসার সময় নিয়ে এসেছিলো সাথে করে। এভাবেই মুদ্রা সংগ্রহের

হাতেখড়ি। বয়স বাড়ার সাথে সাথেই ক্রমেই বিদেশি মুদ্রার প্রতি আগ্রহ বাড়তে থাকে তার। ভিন্ন ভিন্ন দেশের মুদ্রা সেই দেশ বা অঞ্চলগুলোর মানুষের জীবনযাত্রা, সংস্কৃতি, তাদের পরিবেশ ইত্যাদির চমৎকার এক নিদর্শন। এই অনুভূতি তার ভেতরে তীব্রভাবে কাজ করতে থাকে। একটা সময় এমনও হয়েছে, যাকেই পেতো কাছে তাকেই বলতো, তার সংগ্রহে বিদেশি কয়েন থাকলে দেওয়ার জন্য। বলছিলাম জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়ের লোকপ্রশাসন ও সরকার পরিচালনা বিদ্যা বিভাগের স্নাতকোত্তরের শিক্ষার্থী জয় নন্দীর কথা। সময়ের ব্যবধানে এই মুহূর্তে কিশোরগঞ্জের স্নাতক পড়ুয়া এই তরুণের সংগ্রহে রয়েছে ২১৮ টি দেশ আর অঞ্চলের মুদ্রা আছে। শুধুমাত্র বিদেশি নোট আর কয়েনই রয়েছে সব মিলিয়ে ৮৪৮ টি!

এমনকি আছে দুই হাজারেরও বেশি বছর আগের মৌর্য সাম্রাজ্যের পাঞ্চমার্ক রৌপ্যমুদ্রা। তার সংগ্রহের তালিকায় আরও রয়েছে বিভিন্ন বিলুপ্ত দেশ ও সাম্রাজ্যের মুদ্রা, বিভিন্ন দেশের শতবর্ষী ব্যাংকনোট, ঔপনিবেশিক অঞ্চলের মুদ্রা, ব্রিটিশ আর্মড ফোর্সের ক্যান্টিনে ব্যবহার করার জন্য ইস্যুকৃত নোট ইত্যাদি। এছাড়া রাণী দ্বিতীয় এলিজাবেথ এর ছবিযুক্ত বিভিন্ন দেশের নোট, অড ডিনোমিনেশন বা অদ্ভুত মূল্যমানের নোট। আর এর বাইরেও বাংলাদেশের নোট, কয়েন আছে অনেক ধরনের। বাংলাদেশের সব গভর্নর এর স্বাক্ষরিত ব্যাংকনোট, পলিমার(প্লাস্টিক) আছে তার সংগ্রহে।

অনেক দেশ বা অঞ্চল যার নাম সচারাচর শোনা যায় না এমন দেশের মুদ্রাও জয়ের সংগ্রহে আছে।যেমন: সাওটোম এন্ড প্রিন্সিপে, মাল্টা, বিয়াফ্রা, জার্সি, গুয়ের্নসি, তাতারস্তান, কাতাঙ্গা, স্ট্রেইট সেটেলমেন্ট, মালয়, ব্রিটিশ বোর্নিও, আইল অব ম্যান, আরুবা, নিউ ক্যালেডোনিয়া ইত্যাদি দেশের মুদ্রা আছে তার কাছে।

আবার অনেক দেশ আগে ছিল কিন্তু এখন সেগুলোর অস্তিত্ব নেই; এগুলো বিলুপ্ত দেশ বা ডেড কান্ট্রি নামে পরিচিত। যেমন: সোভিয়েত ইউনিয়ন, যুগোস্লাভিয়া, বিয়াফ্রা, অস্ট্রো-হাঙ্গেরিয়ান সাম্রাজ্য, জায়ারে ইত্যাদি দেশ ও অঞ্চলের মুদ্রা আছে জয় নন্দীর কাছে। সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যে ১৫ টা দেশ হয়েছে, সেগুলোর প্রতিটার ব্যাংকনোট আছে তার সংগ্রহে। এছাড়া সে আমেরিকার বিভিন্ন স্টেটে প্রচলিত ভিন্ন ভিন্ন ধরণের কোয়ার্টার ডলার সংগ্রহ করেছে।

আবার কলোনিয়াল কারেন্সি বা ঔপনিবেশিক অঞ্চলের মুদ্রা তার পছন্দের বিষয়। তাই বিভিন্ন ঔপনিবেশিক অঞ্চলের মুদ্রা তার সংগ্রহে আছে। যেমন: ব্রিটিশ ইন্ডিয়া, ব্রিটিশ মালয়, ব্রিটিশ হংকং, মালয়, ব্রিটিশ বোর্নিও, স্ট্রেইট সেটেলমেন্ট, পর্তুগিজ গিনি, পর্তুগিজ তিমুর, পর্তুগিজ মোজাম্বিক, স্প্যানিশ কিউবা ইত্যাদি।

রাণী দ্বিতীয় এলিজাবেথ এর ছবিযুক্ত মুদ্রা জয় নন্দীর পছন্দের থিম। তার কাছে ব্রিটেন, আইল অব ম্যান, মালয়, ব্রিটিশ বোর্নিও, সেন্ট হেলেনা, ইস্ট ক্যারিবিয়ান স্টেটস (৮ টি দেশ ও অঞ্চলের সমন্বয়), ব্রিটিশ ক্যারিবিয়ান টেরিটোরি, ক্যায়মেন আইসল্যান্ড, জিব্রাল্টার, বাহামাস, জার্সি, ফিজি, বারমুডা, ত্রিনিদাদ এন্ড টোবাগো, অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, নিউজিল্যান্ড ইত্যাদি দেশ ও অঞ্চলের এলিজাবেথ এর ছবিযুক্ত মুদ্রা আছে। এছাড়া বিভিন্ন দেশের পলিমার নোট ও বাইমেটাল কয়েন (দুই ধাতুর কয়েন) আছে জয়ের সংগ্রহে।

শুরুতে সেভাবে সহযোগিতা না পেলেও একটা সময়ের পরে বেশ সহযোগিতা পাচ্ছেন জয় বিশেষত পরিবার থেকে। আরও সুনির্দিষ্ট করে বললে, জয়ের মা, বাবা ও বড় বোন অর্থনৈতিক দিক থেকে বিশাল একটা সাপোর্ট দেয়। এছাড়াও বড়ভাই, জেঠিসহ কয়েকজন আত্মীয়, বন্ধুবান্ধবী, ভার্সিটির সিনিয়র- জুনিয়রদের থেকে সহযোগিতা পেয়েছেন; পাশাপাশি তারা অনুপ্রেরণাও যুগিয়ে যাচ্ছেন।

প্রতিবন্ধকতা কেমন ছিলো, এ সম্পর্কে জয় নন্দী বলেন, প্রতিবন্ধকতা আগেও ছিলো, এখনও রয়েছে, আর আগামীতেও থাকবে। যখন শুরু করি, তখন সত্যি বলতে কেউই গুরুত্ব দিতো না। শৈশবে সাপোর্ট না পাওয়া একটা প্রতিবন্ধকতা; যদিও এটা কাটিয়ে উঠেছি আরও অনেক বছর আগেই।তারপর বলা যায়, এই ছাত্রাবস্থায় অনেক কিছু চাইলেও সংগ্রহ করা যায় না। কারণ অনেক কিছুই কিনে সংগ্রহ করতে হয়। সেখানে আবার কিছু কিছু জিনিসের দাম বেশ ব্যয়বহুল। তবে সেগুলোর আশা করিও না এখন। ভবিষ্যতে যখন সামর্থ্য হবে, তখন সেগুলো সংগ্রহ করবো।

ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা সম্পর্কে তিনি জানান, ভবিষ্যতে আমার একটা ব্যক্তিগত মুদ্রা সংগ্রহশালা করার ইচ্ছা আছে। তবে বড় নাকি ছোট, সেটা আমি নিজেও বলতে পারছি না। সেটা সময়ের হাতে ছেড়ে দিলাম। আমি শুধু আমার পরিকল্পনামাফিক এগিয়ে যাবো। সেই সাথে মুদ্রা সংগ্রহের এই ইতিবাচকশখকে আগামী প্রজন্মের মাঝে ছড়িয়ে দেওয়ার জন্যও আমি কাজ করবো।

জয় নন্দীর আরেকটি ইচ্ছে হলো নতুন সংগ্রাহক তৈরি করা। কারণ, মুদ্রা বা অন্যান্য জিনিস সংগ্রহ করা একটা সুস্থ অভ্যাস। আমাদের সমাজের কিশোর-কিশোরী, তরুণ-তরুণীদের উল্লেখযোগ্য একটা অংশ নেতিবাচক দিকে এগিয়ে যাওয়ার প্রবণতা লক্ষ করা যায়। চুরি-ছিনতাই, মাদক ইত্যাদির মতো বদঅভ্যাস থেকে বেরিয়ে আসা অত্যন্ত জরুরি। তাই তাদের মধ্যে সুস্থ বিষয়ের বীজ রোপণ করতে হবে। জয় নন্দী মনে করেন, মুদ্রা সংগ্রহ এক্ষেত্রে একটা ইতিবাচক মাধ্যম হিসেবে ভূমিকা রাখতে পারে। তার মতে, একটা সময় সে বেঁচে থাকবে না, কিন্তু তার সংগ্রহশালা থাকবে। সেখানে প্রজন্মের পর প্রজন্ম আসবে। নতুন প্রজন্ম জাতীয় ও বৈশ্বিক ইতিহাস, ঐতিহ্য, কৃষ্টি সম্পর্কে জানতে পারবে এখান থেকে। কেউ কেউ আগ্রহী হয়ে মুদ্রা সংগ্রহ শুরু করবে। তখনই জয় সার্থক হবে, জয়ের সংগ্রহের সার্থকতা হবে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *