
লেটের আলোচিত শাপলা হলিডে হোম এখন আতঙ্ক আর কলঙ্কের প্রতীক। স্থানীয়রা যাকে ‘নানা ভাই’ নামে চেনেন, সেই ফয়জুল খান আলমের অপকর্মে ভরা এই রিসোর্ট পরিণত হয়েছে নেশা, ব্ল্যাকমেইল ও অসামাজিক কার্যকলাপের আঁতুড়ঘরে।
নাম শুনলেই মনে হবে কেউ পরিবারের জ্যেষ্ঠ সদস্য, কিন্তু সিলেটের ‘নানা ভাই’ নামে পরিচিত আলমের আসল পরিচয় এখন অনেকের কাছেই ভয়ংকর। তরুণীদের নেশায় বুঁদ করে, অশ্লীল ছবি ও ভিডিও ধারণ করে ফাঁদ পাততেন তিনি। তারপর সেই কনটেন্ট ব্যবহার করে শুরু করতেন ভয়াবহ ব্ল্যাকমেইল।
একবার কেউ তার ফাঁদে পড়লে রেহাই ছিল না—প্রতিমাসে দিতে হতো মোটা অঙ্কের টাকা। না দিলে ভিডিও ছড়িয়ে দেয়ার হুমকি ছিল তার পেছনে।
শাপলা হলিডে হোম: এক রিসোর্ট, শত অপকর্ম
শহরের এয়ারপোর্ট সড়কের পাশে অবস্থিত শাপলা হলিডে হোম নামের রিসোর্টটি মূলত তিনতলা পর্যন্ত ভাড়া নিয়ে গড়ে তুলেছিলেন আলম। ওপরে পরিবার নিয়ে বসবাস করতেন সাধারণ লোকজন। নিচের তিনতলাকে তিনি ব্যবহার করতেন নেশা, অসামাজিক কর্মকাণ্ড এবং ব্ল্যাকমেইলের হেডকোয়ার্টার হিসেবে।
প্রথমে এলাকার মানুষ বুঝে উঠতে পারেননি শাপলায় কী হচ্ছে। কিন্তু থার্টি ফার্স্ট নাইট, পহেলা বৈশাখ কিংবা নানা উপলক্ষে রাতভর চলা পার্টি ও ভিআইপিদের আনাগোনা দেখে স্থানীয়দের সন্দেহ স্পষ্ট হয়ে ওঠে।
তরুণীদের দিয়ে ফাঁদ, ভিডিও করে ব্ল্যাকমেইল
সিলেটে পড়তে আসা বিভিন্ন জেলার তরুণীদের নেশায় আসক্ত করে আলম ব্যবহার করতেন তার অসৎ কাজে। ইয়াবা, মদ দিয়ে তরুণীদের বুঁদ করে তিনি তাদের দিয়ে অতিথিদের মনোরঞ্জন করাতেন। আর সেই সময় গোপনে ভিডিও ধারণ করতেন।
এই ভিডিও দিয়েই ব্যবসায়ী, ভিআইপি ও সরকারি কর্মকর্তাদের ব্ল্যাকমেইল করতেন তিনি। একাধিক ব্যবসায়ী জানিয়েছেন, এমন ভিডিও আলম তাদের দেখিয়েছেন এবং চাঁদা দাবি করেছেন।
এমনকি যারা চাঁদা দিতে অপারগ হতেন, তাদের হুমকি দেয়া হতো—“সব ভিডিও ছড়িয়ে দিচ্ছি”।
হামলার ঘটনায় ফাঁস হলো ‘নানা ভাই’র আসল রূপ
গত ১৫ এপ্রিল গোলাপগঞ্জের মুহিনুর রহমান ও তার বন্ধু আসাদের ওপর হামলার ঘটনা ছিল এই কেলেঙ্কারির সূত্রপাত। মামলা করার পর শাপলার গোপন কর্মকাণ্ড প্রকাশ পেতে শুরু করে।
মুহিন জানান, তাকে রিসোর্টে আটকে রেখে নির্যাতন করা হয় এবং তখনই আলম ও তার ভাই তাজুল তাকে ভিডিও দেখিয়ে ভয় দেখায়। দাবি করে, “তাদের ওপর ‘লেবেলে’র হাত রয়েছে”, তারা ধরাছোঁয়ার বাইরে।
স্থানীয়দের স্বস্তি, তদন্তে নেমেছে পুলিশ
মামলার পর থেকে শাপলা হলিডে হোমে একাধিকবার পুলিশি অভিযান চালানো হয়েছে। তবে এখনও ধরা পড়েনি আলম বা তার সিন্ডিকেটের কেউ।
পুলিশ জানিয়েছে, তারা আলম এবং তার সন্ত্রাসী বাহিনীকে ধরতে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। এদিকে এলাকাবাসীর মধ্যে কিছুটা স্বস্তি ফিরেছে, কারণ ক’দিন ধরেই পলাতক রয়েছে আলম ও তার ভাই তাজুল।
‘নানা ভাই’র অপকর্মে আতঙ্কে পরিবারগুলো
শাপলা হলিডে হোমের ওপরতলায় যেসব পরিবার ফ্ল্যাটে বসবাস করতেন, তারা এখন চরম আতঙ্কে। অনেকেই বাসা ছেড়ে চলে যাচ্ছেন। স্থানীয়রা বলছেন, “এই রিসোর্টে কি হয়, সবাই জানে। কিন্তু ভয়ে মুখ খুলতে পারত না কেউ। এখন সব প্রকাশ্যে আসছে।”
সিন্ডিকেট, সন্ত্রাস আর মাদক—সবই ছিল এক ছাতার নিচে
আলমের ভাই তাজুল, স্থানীয় স্বেচ্ছাসেবক লীগের এক ক্যাডার, ছিলেন তার সন্ত্রাসী বাহিনীর প্রধান। আলোচিত ক্যাডার পীযূষের ঘনিষ্ঠ বলে পরিচিত তাজুল শাপলার আশেপাশেই থাকত সশস্ত্র অবস্থানে।
স্থানীয়রা জানিয়েছেন, এ রিসোর্টে ঢাকার কিছু কলগার্ল, এমনকি মিডিয়ার কয়েকজন নামজাদা তরুণীও এসেছেন নানা ভাইয়ের ডাকে। এতে করে আলম হয়ে উঠেছিলেন ভিআইপিদের কাছে ‘বিশ্বস্ত ঠিকানা’, যা ব্যবহার করে তিনি নিজের অপরাধ সাম্রাজ্য মজবুত করেন।
সিলেটের শাপলা হলিডে হোমের কেলেঙ্কারি শুধু একটি ব্যক্তির নয়—এটি গোটা সমাজে অপরাধ কীভাবে প্রভাব বিস্তার করতে পারে, তার এক নগ্ন চিত্র। তদন্ত সঠিকভাবে হলে এবং আলম-তাজুলদের আইনের আওতায় আনা গেলে এ অঞ্চলে কিছুটা হলেও স্বস্তি ফিরবে বলে মনে করছেন সচেতন নাগরিকরা।