
লাবনী আক্তার শিমলা
মাছ প্রোটিন, কোলাজেন, আয়রন, ফলিক অ্যাসিড ও ওমেগা ফ্যাটি অ্যাসিডের অন্যতম উৎকৃষ্ট উৎস। ভৌগোলিক কারণে নদী-নালা, খাল-বিলঘেরা বাংলাদেশ যুগে যুগে বাঙালির খাদ্যসংস্কৃতিতে মাছকে বিশেষ স্থানে বসিয়েছে। সেই আনন্দ ও প্রাচুর্যের প্রতিফলনই আমাদের চিরচেনা প্রবাদ “মাছে ভাতে বাঙালি”। কিন্তু প্রকৃতির সেই উদার উপহার আজ মারাত্মক হুমকির মুখে। দেশে বিদ্যমান প্রায় ২৬০ প্রজাতির স্বাদু পানির মাছ ও ৪৭৫ প্রজাতির সামুদ্রিক মাছের একটি বড় অংশই বর্তমানে বিলুপ্তপ্রায়।
আইইউসিএন বাংলাদেশের তালিকা অনুযায়ী খরকি, নান্দিলা, শোল বা বাক্কা, বাঘাইড়, ভাঙ্গান বাটা, কালো পাবদা, চেনুয়া, মহাশোল, আইড়, বাইম, ফলি, টাকি, বালিয়া, গজারসহ শতাধিক দেশীয় মাছের প্রজাতি গভীর সংকটে। গত কয়েক দশকে এই বিলুপ্তির হার বেড়েছে বহুগুণে। এর জন্য দায়ী অপরিকল্পিত খাল-বিল ভরাট, নদীর গতিপথ পরিবর্তন, কৃষিজমি সম্প্রসারণ, শিল্পকারখানার বর্জ্য, অতিরিক্ত কীটনাশক ব্যবহার, জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে লবণাক্ত পানি বৃদ্ধি এবং মা মাছ ধরা যা মাছের প্রজনন চক্রকে ভেঙে দিচ্ছে। দক্ষিণাঞ্চলে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির কারণে লবণাক্ত পানি প্রবেশ করে স্বাদু পানির বাস্তুসংস্থান দুর্বল করে ফেলছে, যা মাছের স্বাভাবিক বংশবৃদ্ধিকে বাধাগ্রস্ত করছে।
একসময় মাছ উৎপাদন ও রপ্তানিতে বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক অঙ্গনে গুরুত্বপূর্ণ অবস্থান দখল করেছিল। কিন্তু জনসংখ্যা বৃদ্ধি ও উৎপাদন কমে যাওয়ায় রপ্তানি আয়ও কমেছে। পাশাপাশি বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে হাজারো মৎস্যজীবী পরিবারের জীবিকা, হুমকির মুখে পড়েছে প্রাকৃতিক পরিবেশের ভারসাম্য।
যদিও সরকার মৎস্য সংরক্ষণ আইন, জাতীয় মৎস্য নীতিমালা ২০১৪, জাতীয় জলাভূমি নীতিমালা প্রণয়ন করেছে তবে যথাযথ প্রয়োগ ও কার্যকর মনিটরিংয়ের অভাবে এসব উদ্যোগ কাঙ্ক্ষিত ফল দিচ্ছে না। সরকার ও বেসরকারি পর্যায়ে নদী ড্রেজিং, জিনগত বৈশিষ্ট্য সংরক্ষণ, বিভিন্ন সংরক্ষণ প্রকল্প শুরু হলেও বাস্তবায়ন দুর্বল হওয়ায় সমস্যার স্থায়ী সমাধান সম্ভব হচ্ছে না।
অতএব, এখনই নিতে হবে ফলপ্রসূ ও সমন্বিত উদ্যোগ।যেমন: খাল-বিল দখলমুক্ত করা,নদী ও জলাশয়ের নিয়মিত ড্রেজিং,প্রাকৃতিক জলাধারের সংযোগ পুনঃস্থাপন,কারেন্ট জাল ও বিষ প্রয়োগ বন্ধ,প্রজনন মৌসুমে কঠোর নজরদারি, শিল্পবর্জ্য পরিশোধন বাধ্যতামূলক করা,কৃষিতে কীটনাশকের ব্যবহার কমিয়ে জৈব পদ্ধতিতে আগ্রহ বাড়ানো,বিপন্ন প্রজাতির কৃত্রিম প্রজনন ও হ্যাচারিতে সংরক্ষণ,পোনা অবমুক্তকরণ ও দেশীয় প্রজাতি চাষে ভর্তুকি ও প্রশিক্ষণ প্রদান।
এই দায়িত্ব শুধুমাত্র সরকারের ওপর ছেড়ে দিলে হবে না। মৎস্য বিভাগ, পরিবেশ মন্ত্রণালয়, স্থানীয় প্রশাসন ও জনগণ সবাইকে পরিবেশ রক্ষায় সচেতন ভূমিকা রাখতে হবে, যেন আমরা নিজেরাই নিজেদের জলসম্পদ নষ্ট না করি।
তবে আশার খবরও রয়েছে। বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের (বিএফআরআই) কৃত্রিম প্রজনন প্রযুক্তির মাধ্যমে মেনি, ভেদা, মৃগেলসহ বহু দেশীয় মাছ আবার ফিরতে শুরু করেছে। সিলেট, কুমিল্লা, ময়মনসিংহের পুকুরে আবার দেখা মিলছে হারিয়ে যাওয়া মাছের। রাজশাহী, বগুড়া ও চট্টগ্রামের হ্যাচারিগুলোতে কৈ, শোল, গজার, বাটা সহ আরও অনেক প্রজাতি সফলভাবে উৎপাদিত হচ্ছে।
সর্বোপরি, দেশীয় মাছের পুনর্জাগরণই আমাদের লক্ষ্য হওয়া উচিত। মাছের প্রাকৃতিক আবাসস্থল রক্ষা করা এবং হারিয়ে যাওয়া প্রজাতিকে ফিরিয়ে আনা–এটাই হবে বাঙালির খাদ্যসংস্কৃতি, জীববৈচিত্র্য ও ঐতিহ্য রক্ষার সবচেয়ে বড় সাফল্য। মাছে ভাতে বাঙালি এই পরিচয় যেন চিরদিন অটুট থাকে।
লাবনী আক্তার শিমলা
শিক্ষার্থী, গণিত বিভাগ
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়
