Sunday, November 16
Shadow

মনিরামপুরের অনন্য মানবিক উদ্যোগ ‘আমাদের অ্যাম্বুলেন্স’: বিনামূল্যে মৃতদেহ পরিবহনে দেশজুড়ে মানবতার উদাহরণ

জেমস আব্দুর রহিম রানা, যশোর:

মৃত্যুর মুহূর্ত মানুষের জীবনের এক গভীরতম শোকের সময়। এ সময় পরিবারের মানসিক বিপর্যয় যেমন তীব্র হয়, তেমনি দুরত্ব ও অর্থনৈতিক সীমাবদ্ধতা মৃতদেহ পরিবহনের মতো মৌলিক প্রয়োজনকেও কঠিন করে তোলে। এই কঠিন বাস্তবতার মাঝেই মনিরামপুর উপজেলায় জন্ম নিয়েছে এক অনন্য মানবিক উদ্যোগ—‘আমাদের অ্যাম্বুলেন্স’। এটি এমন একটি সেবা, যা সম্পূর্ণ বিনামূল্যে বাংলাদেশের যেকোনো প্রান্ত থেকে মৃতদেহ পরিবহন করে মনিরামপুরে পৌঁছে দেয়। সেবা গ্রহণকারী পরিবারকে এক টাকাও বহন করতে হয় না। পদ্মা সেতু, মধুমতী উড়ালসেতু থেকে শুরু করে এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে—যে কোনো সেতু বা মহাসড়কের টোলও বহন করে থাকে কর্তৃপক্ষ।

২০২৪ সালের ১ জুন থেকে শুরু হওয়া এই মানবিক উদ্যোগটির উদ্যোক্তা মনিরামপুরের কৃতি সন্তান, করোনা যুদ্ধে অসামান্য অবদানের জন্য জাতীয় স্বর্ণপদকপ্রাপ্ত মানবিক ডাক্তার মেহেদী হাসান। প্রাণঘাতী মহামারির সময় তিনি প্রত্যক্ষ করেছেন—একটি পরিবারের জন্য মরদেহ পরিবহন কতটা দুঃসহ হতে পারে। কোথাও অ্যাম্বুলেন্স নেই, কোথাও অতিরিক্ত ভাড়া দাবি করা হচ্ছে, আবার কোথাও পরিবারের আর্থিক সামর্থ্য সীমিত হওয়ায় মরদেহ আনারই উপায় নেই। সেই বাস্তবতা থেকেই মানুষের শেষ যাত্রায় মানবিক সহায়তার ব্রত নিয়ে গড়ে ওঠে ‘আমাদের অ্যাম্বুলেন্স’। পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব নেন মোঃ শাহ্ জালাল, যিনি নিবেদিতভাবে সেবাটি পরিচালনা করছেন দিন-রাত।

দেশের যেকোনো প্রান্তে কেউ মারা গেলেই ফোন পেলে অ্যাম্বুলেন্সটি রওনা দেয়। দীর্ঘ পথের টোল, জ্বালানি, কর্মীদের ভাতা—সবই কর্তৃপক্ষ বহন করে। মৃতদেহ পরিবারকে পৌঁছে দিয়ে কর্মীরা নীরবে আবার ফিরে আসে মনিরামপুরে। এই সেবাটি যে কত পরিবারকে আর্থিক ও মানসিক বিপর্যয় থেকে রক্ষা করেছে, তার প্রমাণ মিলেছে অসংখ্য মানুষের মন্তব্যে। কেউ বলেছেন, “এই সেবা না থাকলে আমরা হয়তো মরদেহ বাড়ি আনতেই পারতাম না।” আবার কেউ বলেছেন, “এটি কেবল অ্যাম্বুলেন্স নয়, মানবতার প্রতীক।”

এই মানবিক উদ্যোগ নিয়ে কথা বলেছেন জাতীয় দৈনিক নাগরিক ভাবনা পত্রিকার নির্বাহী সম্পাদক ও যশোরের ঐতিহ্যবাহী প্রতিষ্ঠান বিনিময় ট্রেডার্স-এর স্বত্বাধিকারী সাইমুম রেজা পিয়াস। তিনি দীর্ঘ সময় ধরে মানবসেবামূলক উদ্যোগের সঙ্গে যুক্ত, পাশাপাশি সামাজিক-নাগরিক দায়িত্ববোধ নিয়ে লেখালেখি করেন। ‘আমাদের অ্যাম্বুলেন্স’ বিষয়ে তার বক্তব্যে উঠে আসে মানবতার প্রতি এক গভীর শ্রদ্ধা।

তিনি বলেছেন, “এ ধরনের সেবা শুধু মনিরামপুর নয়, পুরো বাংলাদেশের জন্য একটা গর্বের বিষয়। যখন বাণিজ্যিক অ্যাম্বুলেন্সগুলো দূরত্ব অনুযায়ী অতিরিক্ত ভাড়া দাবি করে, তখন কেউ যদি সম্পূর্ণ বিনামূল্যে—এমনকি সেতুর টোল পর্যন্ত বহন করে মৃতদেহ পৌঁছে দেয়—এটি নিঃসন্দেহে মানবতার সর্বোচ্চ রূপ।”

তিনি আরও বলেন, “আমার সাংবাদিকতা জীবনে বহু সামাজিক উদ্যোগের খবর লিখেছি, কিন্তু ‘আমাদের অ্যাম্বুলেন্স’-এর মতো নির্মোহ, নিঃস্বার্থ সেবা খুব কমই দেখেছি। মানুষের সবচেয়ে অসহায় মুহূর্তে পাশে দাঁড়ানোই প্রকৃত সামাজিক দায়িত্ব। এই সেবাটি সেই দায়িত্বকে এক নতুন উচ্চতায় নিয়ে গেছে।”

সাইমুম রেজা পিয়াস মনে করেন, এমন উদ্যোগগুলো সমাজের মূল্যবোধ টিকিয়ে রাখে। তার মতে— “একটা উপজেলায় এমন সেবা চালু থাকা মানে মানবিকতার নতুন ইতিহাস লেখা। দেশের সব উপজেলা যদি এমন উদ্যোগ নেয়, তাহলে অসংখ্য পরিবার দুঃসময়ে আশার আলো খুঁজে পাবে। আমি ব্যক্তিগতভাবেও মনে করি—এটাই সমাজের প্রতি প্রকৃত অবদান।”

তিনি উদ্যোক্তা ডা. মেহেদী হাসান ও পরিচালক শাহ্ জালালের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে বলেন,

“মানুষের শেষ যাত্রাটুকুও যে এত সম্মানের সঙ্গে সম্পন্ন হতে পারে—তারা সেটিরই উদাহরণ। অর্থ নয়, মানুষকে অগ্রাধিকার দেওয়া—এটাই এই সেবার শক্তি।”

সেবাটির পরিচালক মোঃ শাহ্ জালাল জানান, দিন-রাত যেকোনো সময় ফোন পেলে তারা প্রস্তুত থাকেন। রাত তিনটা হোক বা ভোর পাঁচটা—যে কোনো সময় অ্যাম্বুলেন্স বেরিয়ে পড়ে। তিনি বলেন, “আমি আমার দায়িত্ব মনে করে কাজটা করি। পরিবার যখন কান্নায় ভেঙে পড়ে, তখন অন্তত পরিবহনের চিন্তা যেন না করতে হয়—এটাই দেখতে চাই।” তিনি আরও জানান, সেবাটির মাসিক ব্যয় যথেষ্ট হলেও কখনো কোনো পরিবারকে খরচ নিতে হয়নি। তাই সমাজের মানবিক মানুষরা পাশে দাঁড়ালে এই উদ্যোগ আরও বিস্তৃত হবে।

মনিরামপুরবাসী এই সেবাকে উপজেলাবাসীর গর্ব বলে মনে করছেন। অনেকে বিশ্বাস করেন, এটি মানবিকতার চিরায়ত রূপ দেখিয়েছে। স্থানীয়রা জানান, এটি শুধু একটি অ্যাম্বুলেন্স নয়, বরং নিরাপত্তা, সম্মান ও ভরসার প্রতীক। তারা মনে করেন, এমন উদ্যোগ সমাজে সহমর্মিতা বাড়ায়, মানুষকে উদার করে।

জাতীয় পর্যায়ে মানবিক উদ্যোগগুলোর মাঝে ‘আমাদের অ্যাম্বুলেন্স’ এখন আলোচিত নাম। দেশের অন্যত্র সাধারণত বাণিজ্যিক সেবাই চালু থাকে। কিন্তু মনিরামপুরের এই সেবা প্রমাণ করেছে—একটি উপজেলার একটি উদ্যোগও জাতীয়ভাবে উদাহরণ হতে পারে। অনেকেই আশা করছেন, দেশের বিভিন্ন জেলায়ও এমন সেবা ছড়িয়ে পড়বে, যাতে দরিদ্র ও মধ্যবিত্ত পরিবারগুলি দুঃসময়েও মর্যাদা ও সম্মান নিয়ে তাদের প্রিয়জনকে বাড়িতে আনতে পারে।

প্রতিবছর হাজারো মানুষ মৃত্যুবরণ করেন, আর দূরত্বের কারণে মরদেহ আনার খরচ অনেক পরিবারের জন্য অসহনীয় হয়ে পড়ে। এক্ষেত্রে ‘আমাদের অ্যাম্বুলেন্স’ তাদের বোঝা লাঘব করছে। এটি শুধু সেবা নয়, বরং মানবতার ধারক-বাহক। সমাজে যখন নানা কারণে ভিন্নতা ও বিভেদ বাড়ছে, তখন এই উদ্যোগ মানুষকে আবারও স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে—মানুষ মানুষের জন্য।

মনিরামপুরের মানুষ বিশ্বাস করেন, ‘আমাদের অ্যাম্বুলেন্স’ মানবতার এক নতুন অধ্যায় শুরু করেছে। আর সাইমুম রেজা পিয়াসের মতো ব্যক্তিত্বরা যখন এ উদ্যোগকে স্বীকৃতি দেন, তখন তা শুধু উৎসাহই নয়, বরং দেশের অন্যান্য সমাজসেবামূলক সংগঠনের জন্যও এক অনুপ্রেরণা হয়ে ওঠে।

তাই বলা যায়—মনিরামপুরের ‘আমাদের অ্যাম্বুলেন্স’ শুধু মৃতদেহ বহন করে না; এটি বহন করছে মানুষের প্রতি ভালোবাসা, সহমর্মিতা, দায়িত্ববোধ ও সামাজিক নৈতিকতার এক উজ্জ্বল বার্তা। আশা করা যায়, এই আলো দেশের অন্য প্রান্তেও ছড়িয়ে পড়বে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *