
ফাউন্ডেশনের শিক্ষা অভিযাত্রা
দুর্গম রুমার পাহাড়ে যেখানে শিশুরা একসময় জুম চাষে যেত, সেখানে আজ তারা বই হাতে স্বপ্ন দেখে শিক্ষার সর্বোচ্চ শিখরের।
আতিকুর রহমান, বাকৃবি
এক পাহাড়ি সকাল, এক নতুন শুরু
ভোরের আলোয় বান্দরবানের পাহাড় ঘেরা রুমা উপজেলা। মেঘের ভাঁজে ভাঁজে লুকিয়ে আছে ঠান্ডা ঝিরিপাড়া এলাকায় ক্ষুদ্র একটি ঘর যেখানে নতুন আলোরা স্বপ্ন দেখছে অনন্য এক
যাত্রার। এখানকার বাতাসে এখন এক ভিন্ন শব্দ ভেসে আসে, “অ, আ, ক, খ…”। যে হাতগুলো একসময় শস্য রোপণের জন্য পাহাড়ি ঢালে মাটি খুঁড়ত, আজ সেই ছোট হাতেই ধরা পড়েছে
খাতা-কলম। নয় বছরের ছেলেটি নমুংসিং মারমা, আগে প্রতিদিন বাবার সঙ্গে জুম চাষে যেত। পাহাড়ের চূড়ায় ঘাম ঝরিয়ে দিন কাটাত। কিন্তু এখন তার সকাল শুরু হয় স্কুলে গিয়ে, বানান শেখে আর একটু
একটু করে শিক্ষিত হওয়ার স্বপ্নে। সে বলে, “আগে বুঝতাম না এই পাহাড়ের বাইরেও কিছু আছে। এখন মনে হয়, একদিন আমি শহরে যাবো, সেখানে গিয়ে বড় স্কুলে পড়বো।” এই নমুংসিংদের মতো আরও ১৪টি শিশুর জীবনে আলো এনে দিয়েছে একটি ছোট্ট উদ্যোগ ”ফিউচার ফ্লেয়ার ফাউন্ডেশনের ঠান্ডা ঝিরিপাড়া স্কুল।”
যাত্রা শুরু এক জানুয়ারির সকালে ২০২৫ সালের ১ জানুয়ারি। বছরের প্রথম দিনটি শুধু নতুন ক্যালেন্ডারের নয়, শিক্ষার জ্যোতি নিয়ে নতুন জীবনের শুরু হয়ে দাঁড়ায় ঠান্ডা ঝিরিপাড়ার শিশুদের জন্য। স্থানীয় এক প্রতিনিধি অংসাহ্লা মারমা জানালেন, এখানে কোনো প্রাথমিক বিদ্যালয় নেই, শিশুরা শিক্ষা থেকে বঞ্চিত। ফিউচার ফ্লেয়ার ফাউন্ডেশন (FFF), যাদের মূল লক্ষ্য সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের জন্য
শিক্ষা বিস্তার করা, তখনই সিদ্ধান্ত নেয় “এই বাচ্চাদের অন্তত প্রাথমিক শিক্ষা পেতে হবে, এদেরও অধিকার আছে শেখার।” দুর্গম পাহাড়ের বুকেই শুরু হয় তাদের প্রথম ফ্রি
এডুকেশন সেন্টার। রুমা সদর ইউনিয়নের ৯ নম্বর ওয়ার্ডে, পাহাড় ঘেরা ঠান্ডা ঝিরিপাড়ায়। টিনের তৈরি ছোট একটি ভবন, তারই ভেতর প্রতিদিনের পাঠচক্র। এর বাইরেও এফএফএফের
একটি স্কুল আছে পাশাপাশি দুটি স্কুল প্রতিষ্ঠার প্রক্রিয় চলমান।
পাহাড়ে আলো জ্বালানোর চেষ্টা
বর্তমানে ১৪ জন ছাত্রছাত্রী এই স্কুলে পড়ছে। এফএফএফের অর্থায়নে ও তত্বাবধানে
নিয়োজিত একজন স্থানীয় শিক্ষক ক্লাস নেন পাশাপাশি শিশুদের জন্য শিক্ষাসামগ্রী নিশ্চিত
করেন। এখন দ্বিতীয় শ্রেণি পর্যন্ত পড়ানো হচ্ছে, পরবর্তীতে চতুর্থ শেণি পর্যন্ত নেওয়ার
পরিকল্পনা রয়েছে। ছোট ছোট শিশুরা আগে জুম চাষে যেত, কারণ অভিভাবকেরা শিশুদের একা
বাড়িতে রেখে জুম চাষের কাজে যেতে পারতেন না। বর্তমানে তারা সকালে বই নিয়ে স্কুলে যায়,
বিকেলে খেলে, নিজেদের নিয়ে স্বপ্ন দেখে। এই পরিবর্তনটা শুধু শিক্ষা নয়, এক মানসিক
মুক্তির গল্পও বটে। স্থানীয় প্রতিনিধি অংসাহ্লা মারমা বলেন, “আমরা কখনও ভাবিনি
আমাদের পাড়ায় স্কুল হবে। এখন আমাদের শিশুরা বাংলা পড়ে, গল্প বলে, হাসে-এটাই তো
আমাদের স্বপ্ন।”
চ্যালেঞ্জের গল্প
এই স্কুলের পথে পৌঁছাতে হলে রুমা থেকে নদীপথে যেতে হয় প্রায় দুই ঘণ্টা, তারপর ২০–২৫
মিনিট খাড়া পাহাড় বেয়ে হাঁটতে হয়। যেখানে নেটওয়ার্ক পাওয়া যায় না, সেখানেই ফিউচার
ফ্লেয়ার ফাউন্ডেশন পৌঁছে দিয়েছে শিক্ষা। অর্থের অভাব, দুর্গম যোগাযোগ, আর টিকে
থাকার লড়াই, সবকিছুই এই চেষ্টার প্রতিফিলন। কিন্তু তবুও ফাউন্ডেশনটি থেমে নেই। তারা
চেষ্টা করছে কিভাবে স্থানীয় প্রশাসন, দাতা সংস্থা কিংবা ব্যক্তি উদ্যোগের মাধ্যমে এই
উদ্যোগকে টেকসই করা যায়।
প্রতিষ্ঠাতাদের ভাবনা
ফিউচার ফ্লেয়ার ফাউন্ডেশনের সভাপতি মো মাহির দাইয়ান বলেন, “আমরা জানি, পাহাড়ে
স্কুল চালানো সহজ কাজ নয়। কিন্তু এই শিশুদের মুখে যখন দেখি শেখার আগ্রহ, তখন মনে
হয় প্রতিটি কষ্টই সার্থক। আমরা চাই তাদের জীবনে শিক্ষা হোক ভবিষ্যতের আলো।”
সংস্থার সিইও জয়িতা বিশ্বাস ত্রয়ী বলেন, “এই স্কুল শুধু পড়ার জায়গা নয় বরং এটা
একধরনের আশ্রয়। আমরা চাই এখানে শিশুরা শিখুক, খেলুক, বড় স্বপ্ন দেখুক। আগামীতে
কোয়ালিটি এডুকেশন, এক্সট্রা কারিকুলার কার্যক্রম, এমনকি মানসিক বিকাশের দিকেও
আমাদের লক্ষ্য থাকবে।”
স্বপ্নের পথে হাঁটছে ঠান্ডা ঝিরিপাড়া
এখনও স্কুলটির সামনে কোনো বোর্ড নেই, নেই বড় কোনো দালান বা খেলার মাঠ। তবুও
সকালবেলা বাচ্চারা যখন টিনের দরজা ঠেলে ভেতরে ঢোকে, তাদের চোখে যে আনন্দের চমক
তা যেন পাহাড়ের রোদকে হার মানায়। পুরো এলাকা এখন যেনো সেই আলোয় ভরপুর। বাবা-
মায়েরা চান, তাদের সন্তান একদিন বড় স্কুলে পড়ুক, শহরে চাকরি পাক, বা শিক্ষক হোক।
রাঙে মারমা, লাল পানজাবি পরা সেই ছোট্ট ছেলে, ক্লাস শেষে বলে, “আমাদের স্কুলটা ছোট,
কিন্তু স্বপ্নটা অনেক বড়।”
ফিউচার ফ্লেয়ার ফাউন্ডেশন হয়তো এখনো ছোট পরিসরে কাজ করছে, কিন্তু তাদের এই
উদ্যোগ প্রমাণ করছে বাংলাদেশের সবচেয়ে দুর্গম পাহাড়েও শিক্ষা পৌঁছানো সম্ভব, যদি
কেউ বিশ্বাস করে, “শিক্ষার আলো পাহাড়ের ওপারেও জ্বলে।”
আতিকুর রহমান
বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, মংমনসিংহ-2202
