
জেমস আব্দুর রহিম রানা, যশোর:
এক টুকরো রুটির জন্য জীবন দিতে হলো তেরো বছরের নিষ্পাপ কিশোরী মাহমুদা সিদ্দিকাকে। যে মেয়েটির মা–বাবার স্নেহে বড় হয়ে ওঠার কথা ছিল, তাকে নির্মমভাবে প্রাণ দিতে হলো তারই বাবার হাতে। যশোরের মনিরামপুরের রোহিতা বাজারে ঘটে যাওয়া এই হত্যাকাণ্ডে কেঁপে উঠেছে সমগ্র অঞ্চল, কেঁপে উঠেছে মানুষের বিবেক। পুলিশ জানায়, ৮ সেপ্টেম্বর দুপুরে স্থানীয় একটি দোকান থেকে রুটি চুরির অভিযোগ ওঠে মাহমুদার বিরুদ্ধে। ক্ষুধার তাড়নায় চুরি করা সেই রুটি মুহূর্তেই কাল হয়ে দাঁড়ায় তার জীবনে। দোকানদার বিষয়টি জানালে প্রথমে জনসমক্ষে মা শাহিনুর আক্তারের হাতে জুতা পেটা খেতে হয় মেয়েটিকে। অপমানের আঁচ বুকে নিয়ে ঘরে ফিরলেও মুক্তি মেলেনি। বাবা মাওলানা আয়নুল হকও ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠেন। মারের চোটে মেয়েটি যখন কান্না থামাতে না পেরে হাঁপাতে থাকে, তখন বাবা নিজের হাতেই তার গলা টিপে ধরে—সেখানেই শেষ হয়ে যায় ছোট্ট মাহমুদার নিঃশ্বাস।
হত্যার পর শুরু হয় আরও বিভৎস অধ্যায়। আয়নুল হক মরদেহ লুকাতে প্রথমে পাশের ঝোপে ফেলে রাখেন। পরে রাতের আঁধারে এশার নামাজ শেষে সাবেক ইউপি চেয়ারম্যানের পুকুরে ছুঁড়ে ফেলেন। শিশুটির পায়জামা হাতে রয়ে গেলে সেটি ওড়নার সঙ্গে পানিতে ফেলে দেন। ভোরের আলো ফুটতেই স্থানীয়রা দেখতে পান পুকুরে ভেসে উঠেছে এক কিশোরীর বিবস্ত্র মরদেহ। চারপাশে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে, কান্নায় ভেঙে পড়ে গ্রাম। খবর পেয়ে পুলিশ এসে মরদেহ উদ্ধার করে। প্রথমে ময়নাতদন্তে ধর্ষণের আলামত থাকার কথা উল্লেখ করা হলে এলাকায় চাঞ্চল্য তৈরি হয়। মা শাহিনুর আক্তার থানায় ধর্ষণের পর হত্যার মামলা দায়ের করেন। কিন্তু তদন্তে পুলিশ নিশ্চিত হয়, এটি কোনো ধর্ষণ নয়, বরং নিষ্ঠুর বাবার হাতে ঘটানো হত্যাকাণ্ড।
ঘটনার পর থেকে আয়নুল হক পালিয়ে যান। পুলিশ নানা কৌশল অবলম্বন করে অবশেষে তাকে ফাঁদে ফেলে। স্ত্রীকে থানায় ডেকে এনে স্বামীকে হাজির করতে বলা হয়। শাহিনুর আক্তার তাকে বুঝিয়ে ঘরে ফিরিয়ে আনেন। সেখান থেকে থানায় নেওয়া হলে আয়নুল হক ভেঙে পড়ে এবং আদালতে স্বীকার করেন, ক্ষুদ্র রুটি চুরির অভিযোগে তিনি নিজেই মেয়েকে শ্বাসরোধে হত্যা করেছেন।
এলাকার মানুষ স্তম্ভিত। একজন ইমাম, যিনি প্রতিদিন নামাজ পড়াতেন, ধর্মের দাওয়াত দিতেন, তিনি-ই হয়ে উঠলেন নিজের সন্তানের ঘাতক। মানুষের প্রশ্ন—ক্ষুধার জ্বালায় রুটি চুরি করা মেয়ের অপরাধ এত বড় ছিল যে তাকে জীবন দিয়েই এর খেসারত দিতে হলো? সহপাঠীরা বলছে, মাহমুদা ছিল প্রাণবন্ত, হাসিখুশি মেয়ে, সবার সঙ্গে মিশতে ভালোবাসত। অথচ তার শেষ পরিণতি হলো পৈশাচিক বাবার হাতে নির্মম মৃত্যু। পুকুরে ভেসে ওঠা মরদেহের দৃশ্য স্থানীয়দের চোখে জল এনেছে, এখনও কেউ ভুলতে পারছে না।
শিশু অধিকার কর্মীরা বলছেন, এটি শুধু পারিবারিক ট্র্যাজেডি নয়, আমাদের সমাজের নগ্ন বাস্তবতা। শিশুদের ছোটখাটো ভুল ক্ষমা না করে সহিংসতা দিয়ে দমন করার সংস্কৃতি আজ ভয়াবহ রূপ নিচ্ছে। এই সহিংসতা সীমা অতিক্রম করলে তার পরিণতি হয় প্রাণহানি। একজন বাবা যখন সন্তানের আশ্রয় না হয়ে মৃত্যুদূত হয়ে ওঠেন, তখন সমাজ কোন পথে যাচ্ছে? ধর্মীয় দায়িত্ব পালন করা এক ইমাম যখন সহানুভূতির বদলে নিজের সন্তানকে হত্যা করেন, তখন মানুষের বিবেক কোথায় দাঁড়িয়ে থাকে?
মনিরামপুর থানার ওসি বাবলুর রহমান খান জানান, প্রথম থেকেই ঘটনাটির ভেতরে অসঙ্গতি ধরা পড়েছিল। ধৈর্য ধরে তদন্ত করায় প্রকৃত সত্য উদঘাটন করা সম্ভব হয়েছে। আয়নুল হক স্বীকার করেছেন তিনিই মেয়েকে হত্যা করেছেন। মাহমুদার মৃত্যু আজ দারিদ্র্য, ক্ষুধা আর অমানবিকতার নির্মম প্রশ্ন উত্থাপন করছে। সমাজের সবচেয়ে নিরাপদ আশ্রয় পরিবারই যখন শিশুদের জন্য মৃত্যুফাঁদে পরিণত হয়, তখন রাষ্ট্র ও সমাজের দায় এড়ানো যায় না।
মাহমুদার লাশ ভেসে উঠেছিল পুকুরে, কিন্তু তার মৃত্যুর অনুরণন আজও ভেসে বেড়াচ্ছে মানুষের মননে। ক্ষুধা, দারিদ্র্য, সহিংসতা আর অমানবিকতা মিলেই কেড়ে নিলো এক নিষ্পাপ কিশোরীর জীবন। এই মৃত্যুর দায় শুধু এক বাবার নয়, পুরো সমাজের বিবেকের ওপরও বর্তায়। প্রশ্ন জাগে—আজ যদি আমরা চোখ ফিরিয়ে নিই, আগামীকাল আরও কত মাহমুদা অন্ধকারে হারিয়ে যাবে?
