
কোনো দেশের উন্নয়ন শুধুমাত্র অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বা অবকাঠামোগত অগ্রগতির মাধ্যমে মাপা যায় না। একটি রাষ্ট্রকে প্রকৃত অর্থে উন্নত করে তোলে তার রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা, সামাজিক সাম্য এবং আইনের শাসনের প্রতি অবিচল অঙ্গীকার। কারণ, অর্থনৈতিক উন্নয়নের মূল ভিত গড়ে ওঠে তখনই, যখন একটি দেশের মানুষ নিরাপদে, ন্যায়ভিত্তিক পরিবেশে এবং সামাজিক সম্প্রীতির মধ্যে বসবাস করতে পারে।
রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার প্রয়োজনীয়তা
রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা হলো উন্নয়নের অন্যতম প্রধান পূর্বশর্ত। স্থিতিশীল রাজনীতি মানে কেবল সরকার পরিবর্তন নয়, বরং ক্ষমতায় যেই থাকুক না কেন, দীর্ঘমেয়াদে রাষ্ট্রের উন্নয়ন পরিকল্পনা অব্যাহত থাকা। রাজনৈতিক অস্থিরতা, দলীয় সহিংসতা কিংবা হরতাল-অবরোধের মতো পরিস্থিতি অর্থনীতিকে অচল করে দেয়, বিনিয়োগ নিরুৎসাহিত করে এবং সাধারণ মানুষের জীবনকে দুর্বিষহ করে তোলে। উদাহরণস্বরূপ, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার কয়েকটি দেশ রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা বজায় রেখে দ্রুত অর্থনৈতিক উন্নতি অর্জন করেছে। বিপরীতে যেখানে রাজনৈতিক সংঘাত স্থায়ী রূপ নিয়েছে, সেখানকার অর্থনীতি ক্রমশ পিছিয়ে পড়েছে। তাই গণতান্ত্রিক চর্চার মাধ্যমে রাজনৈতিক দলগুলোর পরস্পরের প্রতি সহনশীলতা ও দায়িত্বশীলতা বাড়ানো জরুরি।
সামাজিক সম্প্রীতি ও সাম্য
একটি দেশের উন্নয়ন কেবলমাত্র শহরভিত্তিক বা নির্দিষ্ট শ্রেণির মানুষকে ঘিরে ঘটলে তা টেকসই হয় না। উন্নয়নকে সবার মাঝে ছড়িয়ে দিতে হলে সামাজিক সম্প্রীতি ও সাম্যের ভিত্তি গড়ে তুলতে হয়। সমাজে বৈষম্য, দারিদ্র্য, নারী-পুরুষের বৈষম্য কিংবা জাতিগত-ধর্মীয় বিভাজন থাকলে তা উন্নয়নকে বাধাগ্রস্ত করে। সামাজিক শান্তি বজায় না থাকলে কোনো বিনিয়োগই নিরাপদ নয়, কোনো শিল্পায়নই দীর্ঘস্থায়ী হয় না। তাই শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কর্মসংস্থান এবং নারী ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা রাষ্ট্রের অন্যতম কর্তব্য।
আইনের শাসনের অপরিহার্যতা
উন্নয়নকে সঠিক পথে এগিয়ে নিতে হলে অবশ্যই আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করতে হবে। আইন সবার জন্য সমানভাবে কার্যকর না হলে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠিত হয় না, আর অন্যায় ও দুর্নীতি মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। দুর্নীতি একটি রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক অগ্রগতিকে ধ্বংস করে দেয় এবং বৈষম্য বাড়ায়। বিনিয়োগকারীরা তখন নিরাপত্তাহীনতায় ভুগে নতুন শিল্প স্থাপন থেকে বিরত থাকে। তাই প্রশাসন ও বিচার বিভাগের স্বাধীনতা, সুশাসন এবং আইনের নিরপেক্ষ প্রয়োগ উন্নয়নের অবিচ্ছেদ্য অংশ।
সমন্বিত দৃষ্টিভঙ্গির প্রয়োজন
একটি দেশের উন্নয়ন তখনই গতি পায়, যখন রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা, সামাজিক সম্প্রীতি এবং আইনের শাসন একে অপরকে পরিপূরক করে এগিয়ে যায়। যদি কোনো রাষ্ট্রে রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব প্রবল হয়, তবে আইন দুর্বল হয়ে পড়ে; আবার আইন দুর্বল হলে সমাজে অবিচার বাড়ে। এই চক্র থেকে বের হয়ে আসতে হলে রাষ্ট্রের প্রতিটি অঙ্গকে দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করতে হবে।
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপট
বাংলাদেশ আজ উন্নয়নের পথে অগ্রসর হলেও রাজনৈতিক অস্থিরতা, সামাজিক বৈষম্য ও দুর্নীতি এখনও বড় চ্যালেঞ্জ। আমাদের সামনে এখন প্রধান কাজ হলো গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি সুদৃঢ় করা, আইনের শাসন নিশ্চিত করা এবং সামাজিক বৈষম্য কমানো। এ লক্ষ্য অর্জন করতে হলে রাজনৈতিক দলগুলোকে সমঝোতার সংস্কৃতি গড়ে তুলতে হবে, দুর্নীতিকে শূন্য সহনশীলতার নীতিতে দমন করতে হবে এবং সাধারণ মানুষের জন্য শিক্ষা ও কর্মসংস্থানের সুযোগ আরও বাড়াতে হবে।
উপসংহার
রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা, সামাজিক সম্প্রীতি ও আইনের শাসন ছাড়া কোনো দেশের উন্নয়ন দীর্ঘস্থায়ী হতে পারে না। এ তিনটি স্তম্ভই একটি জাতির টেকসই উন্নয়নের মূল ভিত্তি। তাই উন্নত বাংলাদেশ গড়তে হলে এখনই প্রয়োজন দায়িত্বশীল রাজনীতি, সমঅধিকারভিত্তিক সমাজব্যবস্থা এবং দুর্নীতিমুক্ত, ন্যায়ভিত্তিক আইনশৃঙ্খলা ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা।
………………………
স্বপন বিশ্বাস
সাংবাদিক ও কবি
শালিখা মাগুরা