
কথায় আছে– গণতন্ত্রের শিকড় যতটা গভীর, স্থানীয় সরকার ততটাই শক্তিশালী। বাংলাদেশের রাজনৈতিক ব্যবস্থায় স্থানীয় সরকার নির্বাচন একটি গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভ হিসেবে বিবেচিত। এটি দেশের গণতন্ত্রকে তৃণমূল পর্যায়ে ছড়িয়ে দেয়ার একটি অপরিহার্য মাধ্যম। স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলো যেমন– ইউনিয়ন পরিষদ, উপজেলা পরিষদ, পৌরসভা, এবং সিটি কর্পোরেশন। এরা জনগণের সবচেয়ে কাছাকাছি থেকে তাদের চাহিদা পূরণ এবং স্থানীয় উন্নয়নে কাজ করে। এই নির্বাচনগুলো শুধু স্থানীয় নেতৃত্ব নির্বাচনের মাধ্যমই নয়, বরং জনগণের রাজনৈতিক অংশগ্রহণ নিশ্চিত করারও একটি সুযোগ। তবে, বর্তমান প্রেক্ষাপটে এই নির্বাচনগুলোর স্বচ্ছতা, নিরপেক্ষতা, এবং কার্যকারিতা নিয়ে নানা প্রশ্ন উঠেছে, যা গণতন্ত্রের শিকড়ের গভীরতা নিয়ে নতুন করে ভাবতে বাধ্য করে।
একটি দেশে স্থানীয় সরকার কতটা গুরুত্বপূর্ণ?
কেন্দ্রীয় সরকার কখনোই ন্যায্যতার ভিত্তিতে একটি দেশের তৃণমূল পর্যায়ে কাজ করতে পারে না। তার জন্য প্রত্যন্ত অঞ্চলের মানুষের অধিকার নিশ্চিত করা কষ্টসাধ্য হয়ে পড়ে । কিন্তু স্থানীয় সরকার কেন্দ্রীয় সরকারের সাথে সমঝোতা করে প্রত্যন্ত অঞ্চলের মানুষের সকল ধরনের অধিকার, সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে অনেকটাই সফল হয়। কারণ এখানে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের তাদের স্থানীয় এলাকার সম্পর্কে সুষ্ঠু জ্ঞান থাকে। এবং এলাকাবাসী তাদের সমস্যাগুলো স্থানীয় প্রতিনিধির কাছে সহজেই উপস্থাপন করতে পারে। কোন দেশের সামগ্রিক সফলতার জন্য স্থানীয় অঞ্চলের সফলতা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। স্থানীয় সরকারের সফলতা মাধ্যমে জাতীয় পর্যায়ে সফলতা নিশ্চিত হয়। আর স্থানীয় সরকার নির্বাচনের মাধ্যমে একটি দেশের নাগরিকের সবচেয়ে বড় সফলতা হলো তাদের মাঝে রাজনৈতিক সচেতনতা বৃদ্ধি পায় গণতান্ত্রিক অধিকার নিশ্চিত হয় । যা গঠনমূলক কেন্দ্রীয় সরকার নির্বাচনে প্রভাব ফেলে।
কিন্তু এখানে গণতন্ত্রের শিকড় কতটা গভীর?
জুলাই পরবর্তী নতুন বাংলাদেশে স্থানীয় সরকার নির্বাচনে গণতন্ত্র কি সত্যি বাস্তবায়ন হবে?? আমরা জুলাই আন্দোলন পূর্ববর্তী সময়ে দেখেছি বাংলাদেশের স্থানীয় সরকার নির্বাচনগুলো নানা চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হয়েছে। এই চ্যালেঞ্জগুলো গণতন্ত্রের মূল ভিত্তিকে দুর্বল করছে। তখন ছিল অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের অভাব। প্রধান বিরোধীদল নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতেন না, এবং ক্ষমতাসীন দল একতরফা নির্বাচন করে সরকার নির্বাচিত করত। যা গণতন্ত্র কখনোই সাপোর্ট করে না। তাছাড়া নির্বাচনকালীন সময়ে সহিংসতা, জাল ভোট, রাত ভোট, কেন্দ্র দখল, এবং কারচুপির অভিযোগ অহরহ ছিল। এসব অনিয়ম ভোটারদের মধ্যে ভয় ও হতাশা সৃষ্টি করে। এই কারণে ভোটে অংশগ্রহণ সামান্য ছিল। তবুও দেখা যেত ভোটকেন্দ্রে ভোট ফুলফিল হয়েছে। কিন্তু এসব ভোট দিলো কে? প্রশ্নের আড়ালে বাস্তবতা স্পষ্ট।
এতসব দুর্নীতির মধ্যেও প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ভূমিকা লক্ষণীয় ছিল না। অভিযোগ আসে তারা ক্ষমতাসীন দলের হয়ে কাজ করতো। অর্থ ও পেশিশক্তির প্রভাব খাটিয়ে ক্ষমতাশীল দলের প্রার্থীরা অন্যায় এবং নিয়ম বহির্ভূত সকল কর্মকান্ড প্রকাশ্যে চালিয়ে যেত। তখন প্রার্থীর ব্যক্তিগত যোগ্যতা বা জনপ্রিয়তার চেয়ে দলীয় পরিচয় বেশি গুরুত্ব পেয়েছে।
এত এত চ্যালেঞ্জের ভিড়ে আমার একটাই প্রশ্ন জাগে, বাংলাদেশের গণতন্ত্রের শিকড় আগে তো গভীর ছিল না, কিন্তু জুলাই বিপ্লব পরবর্তী বাংলাদেশে কি গণতন্ত্রের শিকড় গভীর হবে? এটা নিয়ে আমার খুব কনসার্ন হয়। কারণ বর্তমানে দেশে কেন্দ্রীয় জায়গায় গণতন্ত্রের কিছুটা চর্চা হলেও স্থানীয় পর্যায়ে একটি নির্দিষ্ট গোষ্ঠীর অগণতান্ত্রিক কার্যকলাপে এদেশের ভবিষ্যৎ গণতন্ত্রের উপর প্রশ্নবিদ্ধ করে। তাদের অন্যায় কার্যক্রম গুলো মানুষের ভোগান্তির ভিতরে ফেলে দিয়েছে।
এখন স্থানীয় সরকার নির্বাচন যদি অবাধ, নিরপেক্ষ, এবং শান্তিপূর্ণ না হয়, তাহলে তৃণমূল পর্যায়ে গণতন্ত্রের চর্চা ব্যাহত হবে। এর ফলে জনগণের মধ্যে রাজনৈতিক ব্যবস্থার প্রতি অনাস্থা তৈরি হবে। যখন মানুষ দেখবে যে তাদের ভোট অর্থহীন, তখন তারা রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণ থেকে দূরে সরে যাবে। এটি দীর্ঘমেয়াদে দেশের গণতান্ত্রিক কাঠামোকে দুর্বল করে। যা জুলাই আন্দোলন পরবর্তী বাংলাদেশের জন্য কখনোই কাম্য নয়।
স্থানীয় সরকার নির্বাচনকে সত্যিকার অর্থে গণতন্ত্রের প্রাণকেন্দ্রে পরিণত করতে হলে কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করা জরুরি। যেমন নির্বাচন কমিশনকে সম্পূর্ণ স্বাধীন ও নিরপেক্ষভাবে কাজ করতে দিতে হবে। তাদের উচিত সকল প্রার্থীর জন্য সমান সুযোগ নিশ্চিত করা এবং অনিয়মের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা। প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোকে স্থানীয় সরকার নির্বাচনে পূর্ণ অংশগ্রহণের জন্য উৎসাহিত করতে হবে এবং তাদের কর্মীদের সহিংসতা ও অনিয়ম থেকে বিরত রাখতে হবে।
এছাড়া নির্বাচনকালীন সময়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে কঠোরভাবে নিরপেক্ষ ভূমিকা পালন করতে হবে। আর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ রোলপ্লে করতে হবে গণমাধ্যমকে। গণমাধ্যমকে নির্বাচনের অনিয়ম ও সহিংসতার খবর সাহসের সাথে প্রকাশ করতে হবে এবং ভোটারদের সচেতন করতে হবে। যাতে তারা অর্থ বা পেশিশক্তির প্রভাবে প্রভাবিত না হয়ে যোগ্য প্রার্থীকে ভোট দিতে পারে।
বাংলাদেশের স্থানীয় সরকার নির্বাচন দেশের গণতন্ত্রের গভীরতা পরিমাপের একটি গুরুত্বপূর্ণ মাপকাঠি। যদি এই নির্বাচনগুলো অবাধ, নিরপেক্ষ, এবং শান্তিপূর্ণ হয়, তাহলে এটি দেশের গণতান্ত্রিক কাঠামোকে শক্তিশালী করবে এবং জনগণের আস্থা ফিরিয়ে আনবে। এর জন্য আমাদের সকলের সহযোগিতা প্রয়োজন। নতুন বাংলাদেশ বিনির্মাণের প্রত্যয় আমাদের সকলের একান্ত কাম্য।
আজিজুল ইসলাম নাফিজ
শিক্ষার্থী, শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউট
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা।
azizulislamnafij@gmail.com
