
স্বপন বিশ্বাস
আজ ২৭ আগস্ট, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের মৃত্যুদিন। ১৯৭৬ সালের এই দিনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় মসজিদের পাশে তাঁকে চিরনিদ্রায় শায়িত করা হয়। বাঙালি জাতির ইতিহাসে এই দিনটি শুধু এক কবির মৃত্যুদিন নয়, বরং বিদ্রোহ, সাম্য ও মানবতার এক অমর কণ্ঠস্বরের অবসান ঘটার দিন। তবে তাঁর সৃষ্টির আলো আজও আমাদের পথ দেখায়, আমাদের চেতনা জাগিয়ে রাখে।১৮৯৯ সালের ২৪ মে পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান জেলার চুরুলিয়া গ্রামে জন্ম নেন নজরুল ইসলাম।
দারিদ্র্য ও সংগ্রামের মধ্য দিয়েই তাঁর শৈশব কেটেছিল। কখনো মুয়াজ্জিন, কখনো লেটো দলে গানের অভিনেতা, আবার কখনো সেনা হিসেবে প্রথম বিশ্বযুদ্ধে অংশ নেওয়া—জীবনের বহুমুখী অভিজ্ঞতা তাঁকে গড়ে তুলেছিল বাস্তববাদী ও সংগ্রামী মানুষ হিসেবে। এই জীবনের প্রতিটি রং তিনি তাঁর কবিতা, গান, গল্প, উপন্যাস ও নাটকে ফুটিয়ে তুলেছিলেন।নজরুল সাহিত্য জীবনে প্রবেশ করেন সাংবাদিকতা ও কবিতা লেখার মাধ্যমে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শেষে যখন তিনি কলকাতায় ফিরে আসেন, তখন তাঁর হাতে জন্ম নেয় ‘বিদ্রোহী’ কবিতা। এই কবিতার মাধ্যমে তিনি ঘোষণা করেন, “আমি চির বিদ্রোহী বীর”—যা একসময় শুধু কবিতার পঙ্ক্তি নয়, হয়ে ওঠে জাতির মুক্তির শ্লোগান।
তাঁর রচনায় শোষণ, অন্যায়, অবিচার ও সাম্রাজ্যবাদবিরোধী জ্বলন্ত প্রতিবাদ ফুটে উঠেছিল। ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসন তাঁকে একাধিকবার কারাবন্দি করলেও তাঁর কলম থেমে থাকেনি। কারাগারের ভেতর থেকেও তিনি লিখেছেন অগ্নিঝরা কবিতা ও গান।তবে নজরুল শুধু বিদ্রোহের কবি নন, তিনি মানবতার কবি। ধর্ম-বর্ণ-গোত্র নির্বিশেষে মানুষের ঐক্য ও সাম্যের বার্তা তাঁর সৃষ্টির মূল সুর। তিনি বলেছিলেন, “আমার মনের মানুষ মুসলমান নয়, হিন্দু নয়, খ্রিষ্টান নয়—সে মানুষ।” এই মানবতাবাদী দৃষ্টিভঙ্গিই তাঁকে সর্বজনীন কবিতে পরিণত করেছে। ইসলামী সংগীত, শ্যামাসঙ্গীত, কীর্তন, ভজন কিংবা গজল—সবধরনের সুরে তিনি সমান দক্ষতা দেখিয়েছেন।নারীর মুক্তি ও মর্যাদা প্রশ্নে নজরুল ছিলেন অত্যন্ত প্রগতিশীল। তাঁর কবিতায় নারীকে কখনো অবলা নয়, বরং শক্তি, সাম্য ও সৌন্দর্যের প্রতীক হিসেবে দেখা যায়।
তিনি বিশ্বাস করতেন নারী-পুরুষের সমান অংশগ্রহণেই সমাজে প্রকৃত অগ্রগতি সম্ভব। তাঁর বিখ্যাত কবিতা ‘নারী’-তে তিনি নারীকে তুলনা করেছেন সৃষ্টি ও শক্তির মূল উৎস হিসেবে।বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে নজরুলের রচনা ছিল প্রেরণার উৎস। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে তাঁর অসংখ্য দেশাত্মবোধক গান বাজত মুক্তিকামী মানুষের কণ্ঠে। তাই স্বাধীন বাংলাদেশ সরকার তাঁকে জাতীয় কবির মর্যাদায় ভূষিত করেছে, যা আমাদের জাতীয় গৌরবের অংশ।কিন্তু জীবনের শেষ ভাগ ছিল অত্যন্ত করুণ। দুরারোগ্য অসুখে আক্রান্ত হয়ে তিনি দীর্ঘকাল বাকশক্তি ও লেখনীর শক্তি হারিয়ে ফেলেছিলেন। ১৯৭২ সালে স্বাধীন বাংলাদেশে এনে তাঁকে রাষ্ট্রীয় সম্মান দেওয়া হয়, তবে সৃষ্টির কলম আর হাতে ধরা পড়েনি। অবশেষে ১৯৭৬ সালের ২৭ আগস্ট তিনি চিরবিদায় নেন।আজকের দিনে দাঁড়িয়ে আমরা বুঝতে পারি নজরুল ইসলাম কেবল তাঁর সময়ের কবি নন, তিনি সর্বকালের কবি। অন্যায়, বৈষম্য, সাম্প্রদায়িকতা ও অমানবিকতার বিরুদ্ধে তাঁর অগ্নিঝরা কলম আজও সমান প্রাসঙ্গিক। তাঁর বিদ্রোহের শ্লোগান আমাদের অনুপ্রাণিত করে, তাঁর প্রেম ও মানবতার বাণী আমাদের পথ দেখায়।কাজী নজরুল ইসলাম আমাদের জাতীয় কবি, কিন্তু তার চেয়েও বড় কথা তিনি আমাদের আত্মার কবি। তাঁর বিদ্রোহ আমাদের মুক্তি দেয়, তাঁর প্রেম আমাদের ঐক্যবদ্ধ করে, আর তাঁর মানবতার দৃষ্টিভঙ্গি আমাদের করে তোলে সত্যিকারের মানুষ।এই মৃত্যুদিনে জাতীয় কবি নজরুল ইসলামের প্রতি জানাই গভীর শ্রদ্ধাঞ্জলি।
(স্বপন বিশ্বাস)
সাংবাদিক ও কবি
শালিখা মাগুরা