Thursday, September 18
Shadow

রক্তজবার মায়াজাল: স্মৃতি, প্রেম ও অধরা বাস্তবতা

কাইয়ুম আজাদ : বৈশাখ মাসের অন্তিম দিন। বেলা তখন দশ প্রহর। মতলব চাচা আর আমি বিদ্যাগঞ্জ রেল স্টেশনের নিরবচ্ছিন্ন অপেক্ষায় প্রহর গুনছি। আজকাল বেগুনবাড়ি স্টেশনে রেলগাড়ি আর থামে না, তাই বিদ্যাগঞ্জই একমাত্র ভরসাস্থল। আমাদের গন্তব্য জামালপুরের দুরমুট হযরত শাহ্ কামাল রহমাতুল্লাহ আলাইহির পুণ্য মাজার শরীফ জিয়ারত করা। সমগ্র বৈশাখ মাস জুড়েই এখানে ওরস চলে, আর আজই সেই পুণ্য ওরসের পরিসমাপ্তি। বাদ এশার পর আখেরি মোনাজাতের পুণ্য লগ্ন। আমার পকেটে দুইটি রক্তজবা পুষ্প, কারণ আজ আরও এক অপ্রকাশিত সত্তার সহিত সাক্ষাৎ হইবার কথা, সে কে, তা উন্মোচিত হবে যথাসময়ে।

দশ প্রহরের ট্রেন একাদশ প্রহর অতিক্রান্ত করিয়াও আসার কোনো হেতু প্রদর্শন করিল না। আমরা চা স্টলের সামান্য পরিসরে উপবিষ্ট হইয়া উষ্ণ চা পান করিতেছি। মতলব চাচা ক্ষণে ক্ষণে দূরভাষ যন্ত্র বাহির করিয়া সজীব সম্প্রচার করিতেছেন, জ্ঞাত করিতেছেন আমাদের গন্তব্য ও কর্মপরিধি। এরই মধ্যে এলাকার কিছু পরিচিত মুখও স্টেশনে সমবেত হইয়াছেন – গুলমাহমুদ, পাগল বাবুল এবং আরও কতিপয় সহযাত্রী। ওনারাও মাজার শরীফে গমন করিবেন।

অবশেষে অপেক্ষার সুদীর্ঘ প্রহর ফুরাইয়া রেলগাড়ি সমাগত হইল। মধ্যবর্তী একটি বগিতে আরোহণ করিলাম। রেলগাড়ি জনাকীর্ণ, পদস্থাপনের কিঞ্চিৎ স্থানও নাই। আমি আর মতলব চাচা জনসমুদ্রের মধ্যে কুণ্ঠিতভাবে দণ্ডায়মান। হকারগণ চানাচুর, ঝালমুড়ি লইয়া ঠেলাঠেলি করিয়া বিক্রয় করিতেছে – ইহা তাহাদের নিত্যদিনের জীবিকা।

বিদ্যাগঞ্জের পরবর্তী স্টেশন নুরুন্দি। এখানে কিছু যাত্রী অবতরণ করায় ভিড় কিঞ্চিৎ শিথিল হইল, এখন অল্প কিঞ্চিৎ লোক দণ্ডায়মান। আমি শুভ্র পাঞ্জাবি আর পায়জামা পরিহিত। হঠাৎ দৃষ্টি নিবদ্ধ হইল আমার জ্যেষ্ঠ জেঠা মনির উদ্দিনের বয়সী এক প্রবীণ মুরব্বির প্রতি, প্রায় পঁয়ষট্টি-সত্তর বৎসর হইবে তাঁহার বয়স, মুখমণ্ডল পূর্ণ শ্বেত শ্মশ্রুতে আবৃত, ধবধবে শ্বেত পাঞ্জাবি আর পায়জামা পরিহিত। আমাকে দণ্ডায়মান দেখিয়া তাঁহার হৃদয় দ্রবীভূত হইল, বলিলেন – “বাবা, আপনি আমার আসনের পার্শ্বে উপবেশন করুন।” তাঁহার আন্তরিক আহ্বানে মুগ্ধ হইয়া উপবিষ্ট হইলাম।

ঠিক এমন সময় একজন গায়ক রেলগাড়ির বগিতে খঞ্জনি বাজাইয়া নৃত্যরত ভঙ্গিমায় গান গাহিতেছেন:

বাবা দিও না, দিও না বাবা খালি ফিরাইয়া

রহমতের হাত বাবা দাও বাড়াইয়া।

আর কত গাঁথিব তোমার বেনি ফুলের মালা

দয়াল তোমার বীনি ভক্ত মনে বড় জ্বালা

আর কতকাল রবো আমি পথে দাঁড়াইয়া।।

কি করিতে এলাম ভবে কি করিয়া গেলাম

দয়াল তোমার দোহাই দিয়ে পারের আশা করলাম

জামালপুরের পোঁড়া মানিকরে নিও তাড়াইয়া।।

গানের শেষ অন্তরায় গায়কের নাম জানা গেল – পোঁড়া মানিক। এই লোকভাবের গানটি তিনি নিজেই রচনা করিয়াছেন। তাঁহার সমগ্র শরীর মস্তক হইতে পদতল পর্যন্ত দগ্ধ। রেলগাড়ির ঝনঝন শব্দের সহিত পোঁড়া মানিকের গানের তালে তালে এক অদ্ভুত প্রীতিনির্ভর আনন্দ উপভোগ করিতেছিলাম। পূর্বে বহুবার রেলগাড়িতে ভ্রমণ করিয়াছি, কিন্তু এমন নিবিড় আনন্দ পূর্বে কখনো অনুভব করি নাই।

আমার একবারের রেল ভ্রমণের কথা নিদারুণভাবে মনে পড়িতেছিল – কমলাপুর স্টেশনে ট্রেনের জন্য সারিভুক্ত হইব। এমন সময় এক আরক্ষক আসিয়া বলিল, “টিকেট ক্রয় করিবার প্রয়োজন নাই, আমি ট্রেনের অভ্যন্তরে টিকেটের ব্যবস্থা করিতেছি, আপনি একশত মুদ্রা প্রদান করুন।” আমি মূর্খের ন্যায় আরক্ষককে একশত মুদ্রা প্রদান করিলাম। কিঞ্চিৎ কাল পরে ট্রেন আসিল, কিন্তু ট্রেনের অভ্যন্তরে সেই আরক্ষক ভ্রাতাকে আর পাইলাম না। ট্রেনের অভ্যন্তরে টিটি টিকেট পরীক্ষা করিতে আসিলে আমার নিকট টিকেট না পাইয়া জরিমানা সহ টিকেটের মূল্য গ্রহণ করিল। এবারও আরেকটি ভ্রান্তি করিলাম, টিটির নিকট হইতেও টিকেট সংগ্রহ করিলাম না। ময়মনসিংহ জংশন স্টেশনে যখন অবতরণ করিলাম, সেখানকার প্রহরীগণ আমার নিকট টিকেট না পাইয়া স্টেশনের একটি বন্দীশালায় আমাকে সহ আরও কতিপয় জনকে আটক করিল। বাংলাদেশ রেলওয়ের নানা আইন প্রদর্শন করিয়া আমাদের হুমকি দিতেছিল – জরিমানা সহ অর্থ না দিলে তিন মাস কারাদণ্ড ভোগ করিতে হাজতে প্রেরণ করিবে। দণ্ডপ্রদর্শন করিয়া ভয় দেখাইতেছিল, যেন তাহা আমাদের উপর প্রয়োগ করিবে। ভয়ে কেউ কেউ টিকেটের মূল্য সহ বৃহৎ অঙ্কের জরিমানা প্রদান করিতেছিল। আমার নিকট যখন আসিল, আমি বলিলাম, “আমি কারাদণ্ড ভোগ করিব, কিন্তু আর নবীন করিয়া অর্থ প্রদান করিতে পারিব না।” তাহারা হুমকি ধামকি দিতেছিল, দণ্ড দেখাইতেছিল, প্রহার করিবে বলিতেছিল। আমি ভীত না হইয়া বলিলাম, “আমাকে কারাগারে প্রেরণ করুন, হুমকি দিতেছেন কেন?” একসময় যাহারা জরিমানা সহ টিকেটের মূল্য দিয়াছিল, তাহাদের সহিত আমাকেও মুক্তি দিল।

তবে এবার বন্দীশালায় বন্দী নহি, এবার মন বন্দী হইয়া গেল পোঁড়া মানিকের গানে। আমি গায়ককে কিঞ্চিৎ অর্থ বকশিস দিয়া বলিলাম – “আরেকটি গান করুন।” পোঁড়া মানিক এবার যে গানটি ধরিলেন:

“ও আমি করি নাই করিতে পারিনাই

পিতা মাতার খেদমত করিও আমার উম্মত”

এ গানটি শ্রবণ করিতে করিতে অবিরত চক্ষু হইতে জল গড়াইয়া পড়িতেছিল। বর্তমানে সমাজে সন্তান মা-বাবাকে দেখভাল করিতে চাহে না। অথচ আমাদের নবীজী হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মায়ের উদরে থাকা অবস্থায় পিতাকে হারাইয়াছেন। যখন তাঁহার শিশু বয়স, নিজ মাতাকে হারাইয়া এতিম হইয়াছেন। মা-বাবার তিনি সেবা যত্ন করিতে পারেন নাই। তাই নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলিয়াছেন – “আমি দুনিয়ায় সকল কর্ম করিতে পারিলাম শুধু পিতা-মাতার খেদমত ব্যতীত। তোমরা আমার উম্মত হইয়া নিজ পিতা-মাতার সেবা যত্ন করিও।”

গান শেষ, আরেকটি স্টেশনে আসিয়া ট্রেন থামিল। গায়ক পোঁড়া মানিক অবতরণ করিলেন। পার্শ্ববর্তী আসনের মুরব্বির নিকট হইতে জানিলাম আর দুইটি স্টেশন পর দুরমুট স্টেশন পড়িবে।

দুরমুট স্টেশনে অবতরণের পর আমি আর মতলব চাচা একটি রিক্সা লইয়া মাজার শরীফের দ্বারে উপনীত হইলাম। কিছু উন্মাদ আমাকে দেখিয়া তাহাদের দল হইতে বিনীত হস্তে দণ্ডায়মান। মতলব চাচা বলিতেছেন – “চাচা, চাচা, আপনাকে উন্মাদগণ সম্মান জানাইতেছে!” আমি তাকাইয়া হতবাক।

কিঞ্চিৎ সময় অতিবাহিত হইল। এখন যাহার সহিত সাক্ষাৎ হইবে, তাহার সহিত পরিচয় করাইয়া দিতেছি সম্মানিত পাঠক/পাঠিকা। ঊনবিংশতি বর্ষীয়া এক তরুণী লেখিকা, নাম সানজিদা। তবে তাহাকে ভালোবেসে সানজু বলিয়া ডাকি সর্বদা। সানজুর নিবাস জামালপুর জেলার ইসলামপুর থানায়, পূর্ব বাহাদুরপুর প্রাইমারি স্কুলের সন্নিকটে। একদিন আমার মেসেঞ্জারে সালাম জ্ঞাপন করিয়া বার্তা প্রেরণ করিয়াছিল। অতঃপরই পরিচয় হইয়াছিল। অবসর পাইলে মেসেঞ্জারে সানজুর সহিত সাহিত্য বিষয়ক আলোচনা হয়। আজ সম্মুখে সানজুর সহিত সাক্ষাৎ হইবে। এত দূর আসিয়া কোনো রমণীর সহিত সাক্ষাৎ হইবে, এই সামান্য চিন্তাতেই আমার উন্মুখ মন অত্যন্ত উচ্ছ্বসিত।

সানজুর ন্যায় এক রমণী মাজারের দ্বারে আসিয়া অটো হইতে অবতরণ করিল। আমি রমণীটিকে জিজ্ঞাসা করিলাম – “আপনার নাম কি সানজু?” রমণীটি কিঞ্চিৎও বাক্য ব্যয় না করিয়া চলিতে লাগিল! রমণীটির পশ্চাতে আমিও চলিতে লাগিলাম। কিঞ্চিৎ দূর গিয়া একটি বালকের সহিত ঐ রমণীটি মিলিত হইল। পরে অনুধাবন করিলাম এ সানজু নহে, অন্য কেহ। কিঞ্চিৎ ক্ষণ পরে একটি গোলাপি বর্ণের থ্রি-পিস পরিহিতা, মুখমণ্ডলে মাস্ক পরিহিতা এক রমণী আসিল। এবার চিনিতে ভ্রান্তি হইল না, বলিলাম – “আপনি কি সানজু?” সে বলিল – “হ্যাঁ।”

আড্ডা দিবার নিমিত্ত একটি ফল দোকানে গিয়া আমি, সানজু আর মতলব চাচা উপবিষ্ট হইলাম। সানজুকে বলিলাম – “কী আহার করিবে?”

– “আপনারা যাহা আহার করিবেন।”

আহার্যের তালিকা দেখিয়া ফুচকা আদেশ করিলাম। কারণ ফুচকা সকল রমণীরই প্রিয় হয়। সানজুর ফুচকা অত্যন্ত প্রিয়, একদিন আমাকে বলিয়াছিল প্রিয়-অপ্রিয় লইয়া আলোচনা করিবার সময়। যে ফুচকা নিয়মিত শহর, হাটবাজার, গ্রামগঞ্জে চল্লিশ মুদ্রায় পূর্ণ প্লেট বিক্রয় হয়, এখন এই মেলায় তাহার মূল্য একশত বিশ মুদ্রা প্রতি প্লেট। আহারের মধ্যেই সাহিত্য আলোচনা হইতেছিল। মতলব চাচা বলিলেন – “স্মৃতিটি আলোকচিত্রে ধারণ করিয়া রাখি।” সানজু বলিল – “প্রদান করুন, আমি চিত্র তুলিয়া দিই।” তিনটি চিত্র তুলিয়া আমরা আহার শেষে পুনরায় মেলায় পদচারণা করিতে লাগিলাম। এক ফাঁকে আমার বক্ষ পকেট হইতে একটি রক্ত জবা পুষ্প বাহির করিয়া সানজুর হস্তে দিলাম। সানজু বলিল – “থ্যাংকু।” তাহার থ্যাংকু শুনিয়া আরেকটি রক্ত জবা প্রদান করিলাম। সে পুনরায় বলিল – “থ্যাংকু।”

এবার আমরা ত্রয়ী মিলিয়া ভূতের গৃহে গমন করিলাম। এখানে প্রকৃতপক্ষে কোনো ভূত নাই, খেলা প্রদর্শন করিবার নিমিত্ত পুতুল দ্বারা ভূত নির্মিত হইয়াছে। এখানে সানজুর সহিত তিন-চারটি চিত্র তুলিলাম সম্মিলিতভাবে। সানজুকে কাঁচের রেশমি চুড়ি ক্রয় করিয়া দিলাম। মতলব চাচা এক ফাঁকে স্মৃতিস্বরূপ খাঁচা সহ পক্ষী ক্রয় করিয়া দিলেন।

আমি, মতলব চাচা, সানজু সহ আমরা মেলার আরও অভ্যন্তরে প্রবেশ করিলাম। এই দিকে কেবল উন্মাদ আর উন্মাদ, আর গাঁজাখোরদের গাঁজার ধূম্র। আমরা একটি চা স্টল পাইয়া উপবিষ্ট হইয়া রং চা পান করিতেছি। আমাদের সহিত রমণী দেখিয়া আমাদের এলাকার কিছু মাজার জিয়ারত করিতে আসা লোকজন আমাদের পশ্চাদ্ধাবন করিয়াছে। তাহাদের আমাদের সহিত বসাইয়া মতলব চাচা চা পান করাইয়া বিদায় করিলেন।

অনেকক্ষণ ঘোরাঘুরি করিবার পর সানজু বলিল – “এখন আমি গৃহে প্রত্যাবর্তন করি?” আমি বলিলাম – “দাঁড়াও!” আমি একটি দোকানে গিয়া কিছু লাভ চকলেট ক্রয় করিয়া সানজুর হস্তে দিলাম। সানজু চকলেট পাইয়া অত্যন্ত আনন্দিত হইল। পুনরায় বলিল – “থ্যাংক ইউ।”

সানজুকে একটি অটোরিকশায় তুলিয়া দিলাম, সে চলিয়া গেল। আমি আর মতলব চাচা মাজারে রহিয়া গেলাম। সূর্যের তেজ হ্রাস পাইয়াছে, হেলিয়া পড়িয়াছে পশ্চিমাকাশে। মাজারের পশ্চিমে একটি মাঠে গিয়া আমি আর মতলব চাচা সময় অতিবাহিত করিতেছি। একসময় সবুজ ঘাসের উপর শয়ন করিয়াছি, মস্তকের নিচে পদযুগলের জুতার বালিশ নির্মাণ করিয়া। লোকজন আমাদের দিকে হা করিয়া তাকাইয়া আছে। আর আমরা নানাবিধ গল্প করিয়া সময় অতিবাহিত করিতেছি। সন্ধ্যা সমাগত, শিশিরের জল সবুজ ঘাসের উপর আশ্রয় লইতেছে।

শয়ন হইতে উঠিয়া মাগরিবের নামাজ আদায় করিলাম। একটি হোটেলে ডিম ভাত আহার করিয়া মাজারে পলিথিন বিছাইয়া উপবিষ্ট হইলাম। কিছু রাজনৈতিক বক্তা ও ধর্মীয় বক্তা ভাষণ প্রদানের পর সহস্র সহস্র মানুষকে সহিত লইয়া মোনাজাত আরম্ভ হইল। লোকজন অশ্রুপাত করিতেছে। নিজেদের ইচ্ছা, কামনা-বাসনা অলির উসিলায় প্রভুর নিকট নিবেদন করিতেছে।

মোনাজাত শেষ, চতুর্দিকে জনসমুদ্র। এই জনাকীর্ণতার মধ্যে কিছু উন্মাদ আসিয়া আমায় ভক্তি জানাইল। ভক্তি জানানোর উদ্দেশ্য হইতেছে, আমার পিতা একজন খেলাফত প্রাপ্ত গুরু। আর আমি একজন গুরুর সন্তান। এই কথাটি মতলব চাচা কিছু উন্মাদকে গমন করিবার পরই বলিয়াছেন। আমরা যেখানেই যাইতেছি, বিভিন্ন কাফেলা হইতে লোকজন আমাদের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করিতেছে।

কামাল শাহ্ আউলিয়ার মেলা শেষ করিয়া এবার চলিয়া গেলাম হযরত জামাল শাহ্ রহমাতুল্লাহ আলাইহির মাজার শরীফে। কামাল শাহ্ রহমাতুল্লাহ আলাইহির মাজারের ওরস ও মেলা শেষ হইলে, জামাল শাহ্ রহমাতুল্লাহি আলাইহির মাজার শরীফের ওরস ও মেলা শুরু হয়। আমরা জামাল শাহ রহমাতুল্লাহ আলাইহির মাজারে গিয়া প্রথমে মাজার শরীফ জিয়ারত করিলাম। মাজারের সম্মুখে বাউল গান হইতেছে, শামিয়ানার নিচে অনেক চেয়ার বিছানো। আমরা গিয়া চেয়ারে উপবিষ্ট হইলাম। মিন্টু বাউল আর কতিপয় বাউল গান করিতেছে। গানের মাঝে লোকজন আনন্দে মুদ্রা ছড়াইয়া দিতেছে। একজন উপস্থাপক গানের মধ্যেই দাওয়াত দিল – আগামী শনিবার বাউল পালা গান অনুষ্ঠিত হইবে, মহারাজ আবুল সরকার মানিকগঞ্জ বনাম ঢাকার রুমা সরকার। সারারাত্রি কাটিয়া গেল আনন্দ উল্লাসে। ভোর হইল, আমরা একটি অটো করিয়া জামালপুর রেল স্টেশনে আসিয়া পড়িলাম। প্রভাত আট প্রহরে ট্রেন আসিবে স্টেশনে। পরবর্তী ট্রেন অপরাহ্ন তিন প্রহরে। ট্রেন আসিতে অনেক বিলম্ব, তাই ট্রেন স্টেশনের যাত্রী ছাউনিতে শয়ন করিয়া সময় অতিবাহিত করিতেছি। ক্ষণে ক্ষণে চা পান করিয়া নিদ্রা দূর করিতেছি।

প্রভাত আট প্রহরে ট্রেন আসিল, টিকেট করিয়া ট্রেনে আরোহণ করিলাম। এখন ট্রেনে অনেক আসন শূন্য। আমি জানালার পার্শ্বে উপবিষ্ট। মতলব চাচাকে বলিলাম – “একটি চিত্র তুলুন।”

দুই দিন পর সানজু ফেসবুকের সামাজিক মাধ্যমে একটি পোস্ট করিল। কবি রফিকুল ইসলাম রাজুর ‘ছুঁয়ে দিলে মন’ কবিতার পুস্তকের সহিত হস্ত প্রসারিত করিয়া। ক্যাপশনে লিখিত – ‘ধন্যবাদ আপনাকে’। সানজুর হস্তে মেলায় ক্রয় করিয়া দেওয়া চুড়ি আর জবা পুষ্পগুলির পাপড়ি পুস্তকটির চতুর্দিকের পটভূমিতে।

অতঃপর মধ্যখানে এক বৎসর চলিয়া যায়। বিভিন্ন বিষয় লইয়া প্রতিদিনই খণ্ড খণ্ড সানজুর সহিত কথোপকথন হয়। সে আমার প্রেমিকা নহে! বন্ধুও নহে! নহে রক্তের কোনো মামাতো, কাকাতো, খালাতো, ফুফাতো, আত্মীয়তার, বা প্রতিবেশীর সম্পর্ক। তবে তাহার সহিত কোনো কারণে কথা না হইলে মন অসুস্থ হইয়া পড়ে। তাহাকে লইয়া আবেগ প্রবাহিত হয়। তাহার জন্য মন খারাপ হয়। মনে হয়, সে শত জনমের এক পরিচিত চরিত্র। তাহার অস্ফুট স্মৃতি আমার সত্তায় এক মায়াবী জাল বুনে রাখে।

সানজু একদিন রাত্রিবেলা মেসেঞ্জারে বার্তা লিখিয়া পাঠাল – “ত্রিশে মে আমার বিংশতি তম জন্মদিন। আমি চাহি আপনি সকলের পূর্বে আমাকে বিংশতি টকটকে রক্তিম গোলাপ লইয়া আসিয়া জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানান। আর ঐ দিন আপনার পছন্দের নীল শাড়ি পরিব।”

সানজুর বার্তা পাইয়া বলিলাম, “তোমার একটি কবিতা প্রেরণ করো, আমি পড়িব।” সানজু তাৎক্ষণিকভাবে একটি কবিতা লিখিয়া পাঠাল:

আমি’ আছি নিজস্ব রাস্তায় দাঁড়িয়ে। তোমাকে দেখার অপেক্ষা-ই.. সরল মানুষ হয়ে, সহজ নিয়মে!

মনে’র -বাসনা; কখনো মিললো না। তৃপ্তি’র স্বাদ আমার বরাবর’ই-অজানা!

সুতো কাটা এক ঘুড়ি হয়ে মুক্ত আকাশে উড়ো। তুমি যেন এক দিগন্তের আলো সৌন্দর্যের অপার মিশেল।

তোমার চোখে তাকালে তৃষ্ণা বাড়ে প্রতিক্ষণে।

নেমেছে এ চোখে বিষাক্ত মেঘের ছায়া,

বৃষ্টি হয়ে ঝরছে আগুনের কণা,

অমরত্বের প্রত্যাশায় কিছু কোনো দাবি-দাওয়া

এই নশ্বর জীবনে আছে কি বা পাওয়া?

কিছুদিন পরে তাহার জন্মদিনে সারপ্রাইজ দিবার নিমিত্ত নীল শাড়ি ও পাঞ্জাবির যুগল পরিচ্ছদ ক্রয় করিলাম। তাহার কিছু চিত্র তাহার প্রোফাইল হইতে লইয়া মুদ্রিত করাইলাম। এরই মধ্যে আবার বৎসরান্তে কামাল শাহ্ মেলা সমাগত হইয়াছে। সানজু বলিতেছে – “আপনি এবার মেলায় আসিবেন না?”

– “না।”

– “আসুন।”

কর্মস্থান হইতে ছুটি লইয়া সানজুকে সারপ্রাইজ দিবার নিমিত্ত গৃহে গমন করিলাম। এবং টেক্সট করিয়া বলিলাম – “আগামীকাল আপনার সহিত সাক্ষাৎ হইবে।” পরদিন ভোর বেলা উঠিয়াই রওনা দিলাম ইসলামপুরের উদ্দেশ্যে। সানজু মেসেজ করিয়া জানায়, তিন প্রহরের পূর্বে আসিলে দেখা করিতে পারিবে।

আমি নদীর ঘাটে গিয়া তরণী পার হইলাম। নদীর ঘাট হইতে অটো করিয়া বেগুনবাড়ি উপনীত হইলাম। স্টেশন মাস্টারের নিকট জিজ্ঞাসা করিলাম, “ট্রেন কয় প্রহরে?” উনি বলিলেন, “মহাশয়, একাদশ প্রহরে ট্রেন আসিবে। আপনি বিদ্যাগঞ্জ স্টেশনে চলিয়া যান, এখানে ট্রেন থামিবে না।” বিদ্যাগঞ্জ যাইবার নিমিত্ত একটি অটোতে আরোহণ করিলাম। কিন্তু অটো নষ্ট হইয়া গেল। এখানে দশটা পঁয়তাল্লিশ প্রহর অতিবাহিত হইয়াছে। এমন সময় একটি সিএনজি আসিল। সিএনজিতে আরোহণ করিয়া বিদ্যাগঞ্জ চলিয়া গেলাম। গিয়া দেখি ট্রেন আসার কোনো সংবাদ নাই। আর প্রায় এক ঘন্টা পরে ট্রেন আসিল। ট্রেনে আরোহণ করিলাম। কিন্তু ট্রেনে কোনো আসন শূন্য নাই। দণ্ডায়মান। তবে একজনকে নিদারুণভাবে অনুভব করিতেছি, সেই গায়ক পোঁড়া মানিককে। যাহার লোকভাব দর্শনে গত বৎসর রোমাঞ্চিত ছিলাম।

এখন আমি আছি কামাল শাহ্ রহমাতুল্লাহ আলাইহির মাজার শরীফ প্রাঙ্গণে। ঘড়িতে বাজে দুপুর একটি কয়েক মিনিট। অপেক্ষার প্রহর গুনিতেছি সানজুর। মাজারের সহিত টিউবওয়েলে গিয়া অজু করিলাম। মসজিদে উপবিষ্ট হইয়া ব্যাগ খুলিয়া দেখি সানজুর জন্য যে পুষ্প নিয়াছিলাম – গোলাপ ও রজনীগন্ধা – সকল পুষ্প উষ্ণতায় নষ্ট হইয়া গিয়াছে। তবে এবারও একটি জবা পুষ্প সানজুর জন্য বক্ষ পকেটে।

একা একা সময় যেন রোগাক্রান্ত, বিষণ্ণ লাগিতেছে কাব্যের কবিতার ন্যায়। আমার বন্ধু রবিকে দূরভাষ করিলাম। রবির নিবাসও সানজুর নিবাসের পার্শ্বে। মেসে থাকাকালীন সে আমার রুমমেট ছিল। কিন্তু রবি গৃহে নাই, সে এখন গাজীপুরে আছে। অতঃপর দূরভাষ করিলাম শ্রী সুমনা দাসকে। সুমন দা একসময় আমার প্রিয় বন্ধু ছিল। আমরা একসাথে অফিসে কর্ম করিতাম। তাহার নিবাস মাজারের সাথেই। সুমন দার গায়ের রং কৃষ্ণবর্ণ, ক্ষুদ্রকায় অবয়ব। কিন্তু সুমন দার মেধা শক্তি অত্যন্ত প্রখর। শ্রমিক আন্দোলনের শীর্ষ নেতা ছিলেন তিনি। সুমন দার সহিত একসাথে কর্ম করিবার সময় তাহার সহিত শুভ্র শুদ্ধ জ্ঞান তর্কাতর্কি হইত প্রতিদিন। এবং উচ্চস্বরে প্রেম বাক্যর মাধ্যমে ভাব আদান প্রদান হত। আমাদের বাক্য অফিস স্টাফরা একত্রিত হইয়া যাইত। কিন্তু সুমন দা পূর্বের স্থানে, তিনিও এখনো চাকরিরত আছেন।

কিঞ্চিৎ ক্ষণ উপবিষ্ট থাকিবার পর সানজু আসিল। সানজুকে লইয়া চলিতে লাগিলাম খোশ গল্প করিতে করিতে। সানজু কাগজের গ্লাস পছন্দ করিতেছিল। আমি বলিলাম – “এসব ভালো না, নিয়ো না।”

– “জল পান করিবার জন্য না, সৌন্দর্যের জন্য নিব।”

– “পরে নিয়ো, এসো মেলায় ঘুরি।”

মেলায় চলিতে লাগিলাম। প্রতি বৎসরের ন্যায় মেলা এত জমজমাট নহে। কারণ প্রতি বৎসর অনেক উন্মাদ থাকে, এবার মেলায় কোনো উন্মাদ নাই। লোকজনের সম্মুখেই বক্ষ পকেট হইতে রক্ত-জবা পুষ্পটি বাহির করিয়া সানজুর হস্তে দিলাম। সানজু বলিল – “থ্যাংক ইউ।”

এমন সময় কাঠের নাম দৃষ্টিগোচর হইল। সানজুকে বলিলাম – “নাম ক্রয় করিবে?”

সানজু – “হ্যাঁ-না” করিতেছে।

আমি লোককে বলিলাম – “সানজিদা আছে?”

বলিল, “আছে। মূল্য পড়িবে চল্লিশ মুদ্রা।”

আমি বলিলাম – “প্রদান করুন।”

সানজু বলিল – “আপনার নাম নিন সাথে।”

– “না।”

দোকানদার ঝিলমিল দিয়া নামটা সৌন্দর্য করিতেছিল। উষ্ণতায় হস্ত মুখ প্রচণ্ড ঘামে সিক্ত। সানজুকে বলিলাম – “টিস্যু আছে?”

– “আছে। তবে ইহা ব্যবহার করা দেওয়া যাইবে না।”

– “সমস্যা নাই, আমার ব্যাগে আছে।” ব্যাগ হইতে টিস্যু বাহির করিলাম। সানজুকে একটি টিস্যু পেপার দিলাম আর বলিলাম, “গতবার একটি আমাকে টিস্যু পেপার দিয়াছিলে, এবার সুদ করিলাম।” সানজু মুচকি হাসিয়া দিল। দোকানদারকে মুদ্রা দিয়া পুনরায় চলিতে লাগিলাম মেলায়।

সানজু বলিল – “আপনাকে খিচুড়ি আহার করাইব, হোটেলে চলুন।”

একটি হোটেলে গিয়া উপবিষ্ট হইলাম। সানজু বলিল – “আমি খাইব না, আপনি খান।”

– “আমি একা একা, আমিও খাইব না।” ইহা বলিয়া উঠিয়া আসিলাম।

মেলায় আরও কিছু সময় ঘোরাঘুরি করিলাম। সানজু বলিতেছে – “আপনি না আসিলে কখনো আসিতাম না। পিতা গৃহে অত্যন্ত অসুস্থ, আমি ঔষধ লইয়া গেলে পিতা আহার করিবে।”

– “তাহলে তুমি দ্রুত গৃহে প্রত্যাবর্তন করো। আমি মাজারে আজ রাত্রি হইতে কাল প্রভাত বেলা গৃহে যাইব।”

– “উন্মাদ-উন্মাদীদের সহিত থাকিতে হইবে না, গৃহে চলিয়া যান। তবে আজ কোনো ট্রেন নাই। সিএনজি দিয়া যাইতে হইবে।”

সানজুর জিদেই সানজুর সহিত অটোতে আরোহণ করিলাম। অটোর মধ্যেই সানজুর সহিত আলাপ-আলোচনা হইতেছে সাহিত্য বিষয়বস্তু লইয়া। সানজুকে বলিলাম – “এত এত কবিতা লেখো, পুস্তক করিবে না একক?”

– “পুস্তক করিব। আমার প্রথম পুস্তক প্রকাশিত হইলে সকলের পূর্বে পুস্তকটি আপনি পাইবেন।”

ইসলামপুরের জেলা পরিষদের সম্মুখে অটো হইতে অবতরণ করিলাম। সানজু বলিতেছে – “এই দেখুন আমাদের ইসলামপুর।” ইসলামপুর থানার সম্মুখে একটি পুষ্করিণী। পুষ্করিণীর পূর্ব পার্শ্বে লৌহনির্মিত স্টিলের মধ্যে বৃহৎ অক্ষরে লিখিত – “আই লাভ ইসলামপুর”। ইসলামপুর জেলা পরিষদের সম্মুখে দণ্ডায়মান হইয়া একটি চিত্র তুলিলাম। সানজু বলিল – “আপনি দাঁড়ান, আমি চিত্র তুলিয়া দিই।” সানজু মোবাইল ঘুরাইয়া ফিরাইয়া বিভিন্নভাবে আমার কয়েকটি চিত্র তুলিল।

– “এমন করিয়া কেউ চিত্র তুলে?”

– “ইহা স্টাইল।”

সানজুর সহিত সম্মিলিতভাবে তিনটি চিত্র তোলা হইল। ব্যাগ হইতে বাহির করিয়া সানজুকে পাঞ্জাবি শাড়ি দিলাম। সহিত পুস্তক ‘অসমাপ্ত প্রেম উপন্যাস’ আর গৃহ হইতে ম্যারা পিঠা ও পোয়া পিঠা লইয়া গিয়াছিলাম, এইগুলি দিলাম। আর দিলাম হস্ত লিখিত চার পৃষ্ঠার একটি পত্র। ব্যাগ হইতে অন্য একটি পুস্তক বাহির করিয়া বলিলাম – “দয়া করিয়া, অটোগ্রাফ।”

– “আপনি প্রদান করুন।”

– “তুমি প্রদান করো, আমি অন্যদিন দিব।”

সানজু লিখিল –

“এ মায়া অটুট থাকুক সবসময়।”

“ভালোবাসা নিবেন”

সানজু আমার জন্য একটি সিএনজি ঠিক করিল। আমার ছাড়িয়া যাইতে মন চাহিতেছে না ইসলামপুর। সানজুর সহিত সিএনজিতে উপবিষ্ট হইয়া আরেকটি চিত্র তুলিলাম সম্মিলিত। সিএনজি ছাড়িয়া দিল। আমি চলিয়া আসিলাম, সানজু চলিয়া গেল গৃহে। আমি জামালপুর হইতে আবার ময়মনসিংহের সিএনজি লইয়া গৃহে চলিয়া আসিলাম। পরের দিন গৃহ হইতে ঢাকায় চলিয়া আসি।

ত্রিশে মে সানজুর জন্মদিন। ঠিক রাত্রি দ্বাদশ প্রহরে তাহাকে জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানাইলাম মেসেঞ্জারে। সানজু লিখিল – “ধন্যবাদ, ঠিক দ্বাদশ প্রহরে জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানানোর জন্য।” আমেরিকান বিখ্যাত কফিশপ ক্রিমসনক্যাপ-এর জন্য তাহার জন্মদিনের কেক কাটার পার্টি দিলাম। সানজুকে বলিলাম – “ভিডিও কলে সংযুক্ত হও।”

– “এত রাত্রে সম্ভব নহে।”

একত্রিশে মে আমার শাড়িটি পরিয়া সানজু ফেসবুকে পোস্ট করিল – চারটি চিত্রের নিচে চারটি কথা লিখিল:

রোদেলা সময় হয়েছে মেঘ

তোমারি নামে পড়ছে আবেগ।

তোমার মায়াবী চোখের একটুখানি

চাহনি হৃদয়ের সব সুর বদলে দেয়।

আমার বসন্ত তোমার সীমান্তের মাঝখানে

দাঁড়িয়ে আছে শুধুই অপেক্ষা।

তোমার শাড়ির স্পর্শ যেনো জীবনানন্দ দাশের

কবিতার শেষ লাইন।

অতঃপর আসিল সেই অপ্রীতিকর মোড়। সানজুর পিতা হঠাৎ করিয়া অসুস্থ হইয়া পড়েন। সে তাহার পিতাকে লইয়া ইসলামপুর হইতে ময়মনসিংহ মেডিকেলে লইয়া আসে উত্তম চিকিৎসার জন্য। এখানে আসার পর কর্তব্যরত এক আরক্ষক কর্মকর্তা সানজুকে দেখিয়া পছন্দ করে। সানজুর সহিত কথা বলিয়া তাহার নাম, ঠিকানা, ফেসবুক আইডি গ্রহণ করে। অতঃপর তাহাদের প্রেম হয়। হঠাৎ করিয়া সানজু ফেসবুকে আমাকে আনফ্রেন্ড করিয়া দেয়। কেন আইডি আনফ্রেন্ড করে, কোনো সময় অনুধাবন করিতে পারিলাম না। এই মায়াবী সম্পর্ক এক অজানা স্রোতে কোথায় যেন হারিয়ে গেল।

সানজুকে মেসেঞ্জারে জিজ্ঞাসা করিলাম – “তোমার প্রোফাইলে প্রথমে লিখিত ‘রঙিন হও কিন্তু রঙ বদলিয়ে নয়’, অথচ নিজেই রঙ বদলিয়ে নিলে?”

সানজু লিখিল – “সময় মানুষকে পরিবর্তন করে।”

সানজুর ফেসবুক আইডিটা তালাবদ্ধ। আমি আনফ্রেন্ড, তাই তাহাকে দেখিতে পাই না। কিন্তু তাহার আইডির প্রথম লেখাগুলো আমাকে অনেক পোড়ায়, কষ্ট দেয়। আইডির প্রথম আরেকটি লেখা ছিল – “আমি মানেই এক দীর্ঘ রহস্যময়ী কবিতা।” সত্যি, এত বৃহৎ কবিতা যাহা পড়িয়া শেষ করা যায় না। তাহার এই উক্তি এক অপ্রকাশিত মায়াজাল যেন।

বৎসর ঘুরিয়া আজ বৈশাখ মাসের শেষ দিন। এই দিনে শাহ্ কামাল শাহ্ মাজার শরীফে আমার আর সানজুর সাক্ষাৎ হইয়াছিল। সানজু বলিয়াছিল প্রতি বৎসর এই দিনে আমার সহিত তাহার মাজার শরীফে সাক্ষাৎ হইবে। তারপর একসাথে মাজার জিয়ারত করিব। আজও আমি সেই হারানো দিনের নিমন্ত্রণে যাইতেছি শাহ্ কামাল শাহ্ মাজার শরীফে।

মাজার শরীফে যাইবার পর কিছুই ভালো লাগিতেছে না। নিদারুণ শূন্যতা অনুভব হইতেছে। কিঞ্চিৎ ক্ষণ পর একটি অল্প বয়সী উন্মাদিনীকে দেখিলাম মাজার শরীফে ঘোরাফেরা করিতেছে। সে কেবল শরীর চুলকাইতেছে। চক্ষু মুখ রক্ত জবার ন্যায় চাক চাক রক্তিম আভা। সমগ্র শরীরে ফুসকুড়ি উঠিয়া গিয়াছে। আর বলিতেছে – “হায় আল্লাহ! হায় আল্লাহ!” কিন্তু রমণীটি দেখিতে ঠিক সানজুর ন্যায়। দেখিতে মায়াবতী, চঞ্চলা আঁখি, ছিপছিপে চাহনি। নিকট গিয়া দেখি হুবহু সানজু। আবার মন বলে, এ সানজু হইবে কেমনে? যাহার সহিত সানজুর প্রেম, এত দিনে হয়তো বিবাহ হইয়া গিয়াছে। স্বামী সরকারি চাকরিজীবী, প্রেম করিয়া বিবাহ। পিতার অঢেল সম্পত্তির ভাগীদার। হয়তো সানজু রাজ রানীর ন্যায় সুখে আছে।

উন্মাদিনীকে গিয়া জিজ্ঞাসা করিলাম, “তোমার নাম কি?”

উন্মাদিনী খিলখিল হাসিয়া উত্তর করিল – “রক্ত-জবা।” এই একটি শব্দেই যেন শত মায়াবী রহস্যের জট খুলে গেল, যা এক নিমেষেই সবকিছুকে আরও প্রগাঢ় করে তুলল।

মাজার শরীফে এশার নামাজের পর সহস্র সহস্র মানুষকে লইয়া আখেরি মোনাজাত আরম্ভ হইল। আমি দোয়ার মধ্যে আল্লাহ্-অলির নিকট একজনকে চাহিলাম। সে হইল সানজু। শ্রবণ করিতেছি এক নিয়ত করিয়া আল্লাহ্’র অলির দরবার হইতে কেউ কিছু চাহিলে কেউ খালি ফিরিয়া যায় না। আল্লাহর অলিরা হইল আল্লাহর খাস বান্দা, আল্লাহর অলিরা হইল আল্লাহর বন্ধু। আমিও মন ভরিয়া আল্লাহর অলির নিকট সানজুকে চাহিলাম, যেন আমার সহিত সানজুর সাক্ষাৎ হয়।

ভোর বেলা দুরমুট স্টেশন হইতে ট্রেনে আরোহণ করিলাম। উঠিয়া দেখি সেই মাজারের উন্মাদিনীটি আমি যে বগিতে, আমার পার্শ্ববর্তী আসনেই উপবিষ্ট। ট্রেনে স্পিকারে ভোরের রবীন্দ্রসংগীত বাজিতেছে –

কাল রাতের বেলা গান এলো মোর মনে,

তখন তুমি ছিলে না মোর সনে ॥

যে কথাটি বলব তোমায় ব’লে

কাটল জীবন নীরব চোখের জলে

সেই কথাটি সুরের হোমানলে

উঠল জ্বলে একটি আঁধার ক্ষণে–

তখন তুমি ছিলেনা মোর সনে ॥

ভেবেছিলেম আজকে সকাল হলে

সেই কথাটি তোমায় যাব বলে ।

ফুলের উদাস সুবাস বেড়ায় ঘুরে,

পাখির গানে আকাশ গেল পূরে,

সেই কথাটি লাগল না সেই সুরে

যতই প্রয়াস করি পরানপণে–

যখন তুমি আছ আমার সনে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *