Friday, November 14
Shadow

নেপালের তরুণ প্রজন্মের আন্দোলন ও ভবিষ্যৎ নেপাল


স্বপন বিশ্বাস: সাম্প্রতিক সময়ে এমন এক আন্দোলনের ভেতর দিয়ে যাচ্ছে, যা দেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে এক নতুন অধ্যায় খুলে দিয়েছে। তরুণ প্রজন্ম সরকারের বিরুদ্ধে অসন্তোষ প্রকাশ করতে রাজপথে নেমেছে। তাদের কণ্ঠে উঠে এসেছে দীর্ঘদিনের ক্ষোভ, হতাশা এবং পরিবর্তনের আকাঙ্ক্ষা। কিন্তু সেই আন্দোলনের রূপ নিয়েছে সহিংসতায়। ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ ও রাষ্ট্রের সম্পদ ধ্বংসের মধ্য দিয়ে আন্দোলন ক্রমশ নিয়ন্ত্রণ হারিয়েছে। সরকারের পতনের দাবির পাশাপাশি রাজপথ জুড়ে ছড়িয়ে পড়া এই আগুন যেন নেপালের ভবিষ্যতের দিগন্তকে ঘিরে ফেলেছে অন্ধকার মেঘে।দেশটির প্রকৌশল বিভাগ ক্ষতির হিসাব করতে গিয়ে চরম হতাশা প্রকাশ করেছে। পুড়ে যাওয়া ভবন, ভাঙা সেতু, নষ্ট হওয়া বিদ্যুৎ সরঞ্জাম, যানবাহন—এসব পুনর্নির্মাণের দায় তাদের কাঁধে এসে পড়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, “জানি না কবে, কিভাবে এ অবকাঠামো আবার দাঁড় করানো সম্ভব হবে।” নেপালের সীমিত অর্থনৈতিক শক্তি ও দুর্বল প্রযুক্তিগত সক্ষমতার কারণে এই ক্ষতি পূরণ করতে বহু বছর সময় লাগতে পারে।প্রশ্ন হলো—এই ধ্বংসযজ্ঞের পর নেপালের ভবিষ্যৎ কী দাঁড়াবে?


অর্থনৈতিক বিপর্যয়
নেপালের অর্থনীতি মূলত কৃষি ও পর্যটননির্ভর। রাষ্ট্রের আয়ের বড় অংশ আসে বিদেশে কর্মরত শ্রমিকদের পাঠানো রেমিট্যান্স থেকে। এমন পরিস্থিতিতে সহিংস আন্দোলন দেশীয় বিনিয়োগকারীদের নিরুৎসাহিত করছে। একই সঙ্গে বিদেশি বিনিয়োগকারীরাও আতঙ্কিত হয়ে পড়ছে। পর্যটকরা নিরাপত্তাহীনতার ভয়ে দেশটি এড়িয়ে চলতে পারে। এর ফল হবে কর্মসংস্থান সংকট, আয় হ্রাস ও নতুন দারিদ্র্যের জন্ম।
রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা
যে কারণে তরুণরা আন্দোলনে নেমেছিল, সেই রাজনৈতিক সংস্কার বা পরিবর্তনের সম্ভাবনাই এখন ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। সহিংস আন্দোলন গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির প্রতি আস্থা নষ্ট করে। মানুষ যখন দেখে প্রতিবাদের নামে রাষ্ট্র ধ্বংস হয়, তখন তাদের মনে প্রশ্ন জাগে—এটাই কি সত্যিই পরিবর্তনের পথ? সরকার ও আন্দোলনকারী পক্ষের মধ্যে দূরত্ব বাড়তে থাকে, আর সংলাপের সম্ভাবনা ক্ষীণ হয়। এর ফলে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা দীর্ঘস্থায়ী হতে পারে।


সামাজিক বিভাজন
অগ্নিসংযোগ ও ভাঙচুর শুধু রাষ্ট্রের অবকাঠামো ধ্বংস করেনি, সাধারণ মানুষের জীবনকেও করেছে দুর্বিষহ। গরিব দোকানি তার জীবনের সঞ্চয় হারিয়েছে, কর্মজীবী মানুষ প্রতিদিনের যাতায়াত ও কাজ হারাচ্ছে, ছাত্রছাত্রীরা শিক্ষার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। ক্ষতিগ্রস্ত সাধারণ মানুষ ধীরে ধীরে আন্দোলনের প্রতি সহানুভূতি হারিয়ে ফেলছে। তরুণ প্রজন্ম যাদের পরিবর্তনের জন্য নেতৃত্ব দিতে চেয়েছিল, সেই জনগণের সাথেই তাদের দূরত্ব বাড়ছে।


করণীয় কী?

আন্দোলন গণতন্ত্রে একটি শক্তিশালী হাতিয়ার। তবে সেটি যদি সহিংসতায় রূপ নেয়, তবে এর ইতিবাচক লক্ষ্য নষ্ট হয়। নেপালের তরুণ প্রজন্মের উচিৎ ধ্বংসাত্মক পথ থেকে সরে আসা। পরিবর্তন চাইলে তার জন্য শান্তিপূর্ণ আন্দোলন, বিকল্প প্রস্তাবনা, নাগরিক আলোচনার পথ বেছে নিতে হবে। তারা যদি সরকারের নীতি নিয়ে প্রশ্ন তোলে, সমাধানের রূপরেখা দেয়, তাহলে জনসমর্থনও তাদের দিকে ঝুঁকবে।সরকারের পক্ষ থেকেও সংলাপের উদ্যোগ জরুরি। শুধু বলপ্রয়োগ করে আন্দোলন দমন করলে ক্ষোভ আরও তীব্র হবে। বরং একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক রাজনৈতিক সংস্কৃতি গড়ে তোলা দরকার, যেখানে তরুণদের কণ্ঠস্বর গুরুত্ব পাবে।

আজকের আন্দোলন নেপালকে অবকাঠামোগত নয়, মানসিক ও সামাজিক সংকটেও ফেলেছে। রাজপথের আগুনে যে স্বপ্ন পুড়ছে, তার ছাই থেকে যদি তরুণরা নতুন স্বপ্ন গড়তে না শেখে, তবে ভবিষ্যতের নেপাল এক অন্ধকার সুড়ঙ্গে আটকে যাবে। কিন্তু যদি তারা ধৈর্য, সংলাপ ও দূরদর্শিতা দেখাতে পারে, তবে আজকের ক্ষতিই হতে পারে আগামী দিনের শক্তি। পোড়া ছাইয়ের ভেতর থেকেও উঠে আসতে পারে এক নতুন, শান্তিপূর্ণ ও সমৃদ্ধ নেপাল।

স্বপন বিশ্বাস
সাংবাদিক ও কবি
শালিখা মাগুরা

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *