Friday, August 15
Shadow

চিঠিতে লেখা ভালোবাসা

একেএম নাজমুল আলম

এক
পল্লবপুর গ্রামের শেষ মাথায় একচালা খড়ের ঘরে বাস মালতির। গরীব ঘরের মেয়ে, তবু চোখে তার স্বপ্নের দীপ্তি। পিতৃহীন সংসারে মা-ই তার পৃথিবী। স্কুলের গণ্ডি পার করার পর বইয়ের পাতায় মুখ না গুঁজে সে গুঁজে রেখেছিল মায়ের ঔষধের প্রেসক্রিপশন আর ভাতের মাপ। জীবন তার কাছে এক বিশাল যুদ্ধ, আর প্রতিদিন সকালটা যেন সেই যুদ্ধে অস্ত্র হাতে নামা।

অন্যদিকে শহর থেকে পাঁচ কিলোমিটার দূরের বাড়ি রাজীবের। ধনী ব্যবসায়ী পরিবারের একমাত্র সন্তান। বিলাসী জীবনযাপন, বিদেশি গাড়ি, ঢাউস বাংলো, মুঠোফোনে লাখ টাকার খরচ। তবু তার ভিতরটা ছিল একা। বাবার ব্যস্ততা আর মায়ের উচ্চশিক্ষার স্বপ্নপূরণের দায়ে সে হয়ে উঠেছিল নিঃসঙ্গ।

দুই
গল্পের শুরু এক সাদা খামে। মালতি প্রতি শুক্রবারে ডাকঘরের সামনে বসে চিঠি লিখত—তার কল্পনার এক ‘অচেনা বন্ধু’কে। সেখানে সে লিখত তার মন খারাপ, মা অসুস্থ, পড়াশোনার ইচ্ছে আর একদিন নিজের পায়ে দাঁড়ানোর স্বপ্ন। চিঠিগুলো সে রাখত নির্দিষ্ট এক পুরনো লাল ডাকবাক্সে, ঠিক যেন সে জানে, কেউ না কেউ সেগুলো একদিন ঠিক পড়ে নেবে।

সেই কেউ ছিল রাজীব।

একদিন গ্রামের ভূমি পরিদর্শনে গিয়ে রাজীব পুরনো ডাকবাক্স থেকে কিছু চিঠি তুলে নেয়। কৌতূহলে পড়তে গিয়ে হতবাক হয়ে যায়। কী গভীর কথা, কী নিষ্পাপ আকাঙ্ক্ষা, কী মায়াময় দুঃখ! তার মন ভিজে ওঠে। এরপর প্রতি শুক্রবারে সে ডাকবাক্স থেকে চিঠি পড়ত এবং ফিরতি চিঠি দিত—“তোমার অচেনা বন্ধু” নামেই।

তিন
এভাবেই সপ্তাহ থেকে মাস, মাস থেকে বছর। মালতির ভেতর ‘অচেনা বন্ধুর’ জন্য এক অদ্ভুত টান জন্ম নেয়। সে জানত না কে লেখে, কোথায় থাকে, কেমন দেখতে—তবু সেই চিঠিগুলিই ছিল তার জীবনের বেঁচে থাকার রসদ।

একদিন চিঠিতে রাজীব লিখল,
“আমি তোমাকে সামনাসামনি দেখতে চাই। জীবনকে তোমার চোখ দিয়ে চিনতে চাই। দেখা হবে? এই শুক্রবার, গাছতলায়, দুপুর তিনটায়।”

মালতির বুক কেঁপে উঠল। দেখা? তবে কি তার ‘অচেনা বন্ধু’ আসলেই আছে?
চার
শুক্রবার, গাছতলা, দুপুর তিনটা।

মালতি লাল শাড়িতে গাছতলায় দাঁড়িয়ে। পায়ের স্যান্ডেল ফাটা, চোখে সস্তা কাজল, তবু চেহারায় অনন্য এক দীপ্তি।

পাশ থেকে ধীরে ধীরে এগিয়ে এলো রাজীব। কালো পাঞ্জাবি, চোখে চশমা, হাতে একটি গোলাপ।

— “তুমি?” মালতির কণ্ঠ থরথর।

— “হ্যাঁ, আমি। রাজীব। তোমার সেই ‘অচেনা বন্ধু’। আমি তোমার চিঠিগুলো পড়ে বদলে গেছি। তুমি আমার জীবনের গল্প।”

পাঁচ
এরপর শুরু এক অসম প্রেম। শহরের রাজীব আর গ্রামের মালতি। রাজীবের পরিবার রাজি নয়। তাঁরা চান উচ্চশিক্ষিত, বড়লোক ঘরের মেয়ে। রাজীব বলল,
— “এই মেয়েটি আমাকে জীবন চিনিয়েছে। ভালোবাসা শিখিয়েছে। আমি তার সঙ্গে পথ চলতে চাই।”

শেষমেশ রাজীব তার বাবাকে বলেছিল,
— “আপনি যখন মা-কে ভালোবেসে বিয়ে করেছিলেন, তখনও দাদু আপত্তি করেছিলেন। আজ আপনি দাঁড়িয়ে আছেন, কারণ ভালোবাসা সঠিক ছিল। এবার আমাকে সেই সুযোগ দিন।”

ছয়
বিয়ের আয়োজন হলো একদম সাধারণভাবে। মালতির গায়ে হলুদের দিন সে চিঠিগুলো পুড়িয়ে ফেলে বলেছিল,
— “আজ থেকে আর কোনো চিঠি নয়, আমার অচেনা বন্ধু এখন আমার জীবনের সঙ্গী।”

শেষ শব্দ
আজ মালতি ও রাজীবের ছোট একটা স্কুল রয়েছে পল্লবপুরে—“চিঠির পাঠশালা”। সেখানে গ্রামের গরীব ছেলেমেয়েরা লেখে তাদের স্বপ্নের কথা, আর রাজীব-মালতি পড়ে তাদের চোখের ভাষা।

ভালোবাসা যদি সত্য হয়, পথ বের হবেই। শুধু সাহস করে প্রথম চিঠিটা লিখতে হয়।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *