
বর্তমান পৃথিবী প্রযুক্তির এক মহাসমুদ্রে পাড়ি দিচ্ছে। আর এই প্রযুক্তির সবচেয়ে আলোচিত ও দ্রুতবর্ধনশীল শাখা হলো কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (Artificial Intelligence – AI)। শিক্ষাব্যবস্থা, চিকিৎসা, কৃষি, অর্থনীতি এমনকি ধর্মীয় ব্যাখ্যা পর্যন্ত—সবখানেই AI তার প্রভাব বিস্তার করছে। কিন্তু প্রশ্ন হলো—ইসলাম এই প্রযুক্তিগত পরিবর্তনকে কীভাবে দেখছে? কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ব্যবহার ইসলামি দৃষ্টিকোণ থেকে কতটুকু গ্রহণযোগ্য?
আধুনিক শব্দ “কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা” অবশ্যই কুরআন বা হাদিসে সরাসরি উল্লেখ নেই। তবে প্রযুক্তি ও জ্ঞান ব্যবহার নিয়ে ইসলামের কিছু মৌলিক দিকনির্দেশনা রয়েছে, যা এই প্রসঙ্গে গুরুত্বপূর্ণ।
আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা বলেন: “আর তিনি (আল্লাহ) মানুষকে শিক্ষা দিয়েছেন যা সে জানত না।” — (সূরা আল-আলাক, আয়াত ৫)
এই আয়াতে মানুষের জ্ঞানার্জনের ক্ষমতাকে আল্লাহর অনুগ্রহ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। অর্থাৎ, মানবজাতি যখন নতুন প্রযুক্তি উদ্ভাবন করে, তা মূলত আল্লাহ প্রদত্ত বিবেক, বুদ্ধি ও জ্ঞান থেকেই সম্ভব হয়। নবী করীম (সা.) বলেন: “তোমরা তোমাদের জ্ঞানার্জন করো, এমনকি তা যদি চীনে গিয়ে নিতে হয়, তবুও।” — (বায়হাকি; যদিও হাদিসটি দুর্বল হিসেবে বিবেচিত, কিন্তু এর অর্থ বহু আলেম গ্রহণযোগ্য মনে করেন।) অর্থাৎ, ইসলাম কখনো জ্ঞান-বিজ্ঞানকে সীমাবদ্ধ করে না, বরং উৎসাহ দেয়।
বর্তমানে AI যে পরিমাণে জটিল কাজ করতে পারছে—যেমন লেখালেখি, ছবি আঁকা, মানুষের মতো কথা বলা, এমনকি ধর্মীয় ব্যাখ্যা প্রদান—তা দেখে অনেকেই দ্বিধায় পড়ে যান। এসব বিষয়ে ইসলামের চিন্তা-চেতনায় তিনটি দিক বিবেচনায় রাখা জরুরি:
১. মানবসৃষ্ট প্রযুক্তি কখনো স্রষ্টার পর্যায়ে পৌঁছাতে পারে না
কুরআনে বলা হয়েছে: “তোমরা যাদের ডেকে থাকো আল্লাহ ছাড়া, তারা একটি মাছিও সৃষ্টি করতে পারবে না— যদি তারা সবাই একত্র হয়।” — (সূরা হজ্জ, আয়াত ৭৩)
AI যতই উন্নত হোক না কেন, সেটা মানুষের তৈরি কিছু কোড ও তথ্যের ভিত্তিতে কাজ করে। এটি চিন্তা করতে পারে না; বরং চিন্তা করার মতো ‘মেকানিক্যাল প্রতিক্রিয়া’ দেখায় মাত্র। সৃষ্টির ক্ষমতা একমাত্র আল্লাহর।
২. নকল করা ও ভ্রান্ত তথ্য ছড়ানো
AI অনেক সময় ভুল বা বিকৃত তথ্য তৈরি করে। এমনকি ধর্মীয় বিষয়েও এমন হয়েছে, যেখানে AI কুরআনের আয়াত বিকৃতভাবে উপস্থাপন করেছে। এই জায়গায় ইসলামের দৃষ্টিভঙ্গি অত্যন্ত কঠোর:
“যে ব্যক্তি আমার নামে মিথ্যা কথা বলবে, সে তার জায়গা জাহান্নামে নির্ধারিত করুক।”
— (সহিহ বুখারী, হাদিস: ১০৭)
সুতরাং ধর্মীয় ব্যাখ্যার ক্ষেত্রে AI-এর উপরে নির্ভর না করে মূলসূত্র—কুরআন ও সহিহ হাদিস—থেকে ব্যাখ্যা গ্রহণ করা উচিত।
AI প্রযুক্তির ব্যবহার: হালাল না হারাম?
ইসলাম প্রযুক্তিকে ‘হালাল’ বা ‘হারাম’ হিসেবে মূল্যায়ন করে এর ব্যবহারের ভিত্তিতে। যেমন:
হালাল ব্যবহার:
- কুরআনের তিলাওয়াত শেখার অ্যাপ
- ইসলামী ইতিহাস ব্যাখ্যার টুল
- শ্রবণ বা দৃষ্টিপ্রতিবন্ধীদের জন্য কুরআন পাঠের প্রযুক্তি
- ফতোয়া বোর্ডের গবেষণা সহায়ক যন্ত্র
হারাম ব্যবহার:
- মিথ্যা হাদিস তৈরি
- ছবি/ভিডিও দিয়ে নবী বা সাহাবীদের অবমাননা
- ধর্মীয় বিভ্রান্তি সৃষ্টি
ইসলাম চায় প্রযুক্তি হোক মানবকল্যাণমূলক ও নৈতিকভাবে নিয়ন্ত্রিত। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা যদি মানবতার উপকারে আসে, সত্য প্রতিষ্ঠায় ভূমিকা রাখে এবং আল্লাহর বিধান অমান্য না করে, তাহলে এটি ইসলামি দৃষ্টিকোণ থেকেও গ্রহণযোগ্য।
তবে বড় প্রশ্ন হলো—কে নিয়ন্ত্রণ করবে AI কে? যদি এটি অসৎ ব্যক্তির হাতে পড়ে, তাহলে প্রযুক্তি হানিকর হয়ে উঠবে। রাসূল (সা.) বলেন: “প্রত্যেক অভিভাবক তার দায়িত্বের জন্য জবাবদিহি করবে ।” — (সহিহ বুখারী, হাদিস: ৮৯৩)
এই হাদিসের ভিত্তিতে বলা যায়—AI ডেভেলপার, প্রোগ্রামার, রাষ্ট্র ও ইসলামি স্কলারদের এ প্রযুক্তি ব্যবহারে সচেতনতার ভূমিকা রাখা জরুরি।
AI প্রযুক্তি আজকের বাস্তবতা। ইসলাম প্রযুক্তিবিরোধী নয়—বরং মানুষের কল্যাণে ব্যবহৃত হলে তা ইসলামি শিক্ষার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ। তবে এই প্রযুক্তি যেন মানুষকে সত্য থেকে বিচ্যুত না করে, বরং সত্য ও ন্যায়ের পথে সহায়ক হয়—সেজন্য প্রয়োজন ইসলামি দৃষ্টিকোণ থেকে এটির নৈতিক ব্যবস্থাপনা ও ব্যাখ্যা।
স্মরণ রাখা দরকার—AI ‘অলওয়েজ অন’, কিন্তু আল্লাহ সর্বজ্ঞ ও সর্বশক্তিমান। প্রযুক্তিকে আল্লাহর চেয়েও বড় ভাবার কোনো সুযোগ নেই। সুতরাং সময় এসেছে প্রযুক্তির সঙ্গে ধর্মীয় চেতনার সেতুবন্ধন ঘটানোর।