Friday, August 15
Shadow

ইসরায়েল গাজা দখল করছে অপরাধস্থল গোপন করতে

পশ্চিমা সংবাদমাধ্যমের আজ সকালের খবর পড়লে মনে হতে পারে, গাজার ওপর সামরিক নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহুর ইচ্ছা নতুন কোনো পরিকল্পনা। কিন্তু ২০০০ পাউন্ডের বোমা ফেলা কখনো বন্দিদের উদ্ধার করে না, আর গোটা পাড়া-মহল্লা মুছে দেওয়ার পেছনে সেগুলোর জায়গায় কিছু নির্মাণের পরিকল্পনাই থাকে।

শুক্রবার, ইসরায়েলের নিরাপত্তা মন্ত্রিসভা গাজা সিটি দখলের অনুমোদন দিয়েছে, যা এই গণহত্যার শুরু থেকেই চূড়ান্ত লক্ষ্য ছিল। পরিকল্পনাটি একটি সুপরিকল্পিত ধাপ মেনে চলে: প্রথমে ধ্বংস, তারপর অনাহারে রাখা, দখল, নিরস্ত্রীকরণের দাবি, এবং অবশেষে পূর্ণ জাতিগত নিধন—যখন ফিলিস্তিনিদের কোনো রাজনৈতিক ক্ষমতা বা প্রতিরোধের সামর্থ্য থাকবে না। এইভাবেই “গ্রেটার ইসরায়েল”–এর স্বপ্ন বাস্তবায়িত হয়।

কিন্তু এই দখল এখন আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা করার কারণ কী—২২ মাসের পরিকল্পিত হত্যাযজ্ঞের পর? কারণ অপরাধস্থলকে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করতে হবে, যাতে বিশ্ববাসী গাজার আসল চেহারা দেখতে না পারে।

রবিবার, ইসরায়েলি সেনারা আল-শিফা হাসপাতালের কাছে একটি মিডিয়া টেন্টে ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করে আল জাজিরার সাংবাদিক আনাস আল-শরীফ, মোহাম্মদ কুরাইকেহ, ইব্রাহিম জাহের, মোহাম্মদ নুফাল এবং মোয়ামেন আলিওয়াকে হত্যা করেছে। তাদের নাম এখন ২০২৩ সালের অক্টোবর থেকে ইসরায়েলের হাতে নিহত ২৩২ জনেরও বেশি ফিলিস্তিনি সাংবাদিক ও গণমাধ্যমকর্মীর তালিকায় যোগ হয়েছে।

বিদেশি সংবাদমাধ্যমকে গাজায় অবাধ প্রবেশে ইসরায়েলের নিষেধাজ্ঞার কারণে, কেবল ফিলিস্তিনি সাংবাদিকরাই ইসরায়েলি যুদ্ধাপরাধের খবর ও প্রমাণ নথিভুক্ত করছিলেন। এই হত্যাকাণ্ড তাদের প্রতি স্পষ্ট বার্তা—চুপ থাকো, থেমে যাও।

এদিকে, যারা বিমানযোগে গাজায় সাহায্য ফেলে দেওয়া অভিযানে অংশ নিয়েছিলেন, সেই বিদেশি সাংবাদিকদেরও সতর্ক করা হয়েছে। তারা যে আকাশপথের ফুটেজ প্রকাশ করেছিলেন, তাতে গাজার মৃতদেহসম এক চিত্র দেখা গেছে—ভাঙা কংক্রিটের জোড়া, ধ্বংসস্তূপ আর ফাঁকা রাস্তাঘাট। এটি সম্পূর্ণ ধ্বংস।

এই ফুটেজ বিশ্বজুড়ে দর্শকদের নাড়িয়ে দেয়, আর তাই ইসরায়েল দ্রুত এসব ফ্লাইটে চিত্রায়ণ নিষিদ্ধ করে দেয়, এমনকি সতর্ক করে যে, নিয়ম লঙ্ঘন হলে সাহায্য ফেলা বন্ধ করা হবে।

ইসরায়েল জানে, চিরকাল বিদেশি সংবাদমাধ্যমকে গাজা থেকে দূরে রাখা সম্ভব নয়। এই গণহত্যা একদিন শেষ হবে; ত্রাণ কাফেলা ও সাহায্যকর্মীরা ঢুকবে, আর তাদের সঙ্গে ক্যামেরাসহ বিদেশি সাংবাদিকরাও আসবেন।

তাই সেই দিন আসার আগে, ইসরায়েল প্রমাণ মুছে ফেলতে ছুটছে—কারণ একবার বিশ্ব গাজার চিত্র দেখলে আর ভান করতে পারবে না যে এই যুদ্ধ ছিল ফিলিস্তিনিদের গণহত্যা ও তাদের ইতিহাস মুছে ফেলার বাইরে অন্য কিছু।

গাজা সিটি দখল মানে খুনি অপরাধস্থলে ফিরে এসে লাশ গোপন করছে। লক্ষ্য শুধু অপরাধ আড়াল করা নয়, বরং বিশ্বকে বিশ্বাস করানো যে মৃতরা মারা যায়নি, আর যা দেখা যাচ্ছে, তা আদৌ বাস্তব নয়।

গাজায় সরকারি হিসাবমতে মৃত্যু সংখ্যা ৬০,০০০, যা বহু বিশেষজ্ঞের মতে অবমূল্যায়িত। অনুমান অনুযায়ী, লাখো ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন। জাতিসংঘ বিশেষজ্ঞরা ৭ আগস্ট ঘোষণা করেছেন—“ইসরায়েল গাজার মানুষকে যেকোনো উপায়ে নিশ্চিহ্ন করছে।” গোপন করার মতো অপরাধের তালিকা এখানে বিশাল।

ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর প্রমাণ ধ্বংসের কৌশল আমরা আগে থেকেই দেখেছি: বুলডোজারে গণকবর খুঁড়ে নিহতদের কবর দেওয়া; নির্যাতনে নিহতদের লাশ আটকে রাখা; গুলিতে নিহতদের অপরাধস্থল মাটির নিচে পুঁতে ফেলা; হাসপাতাল লুটপাটের পর অস্ত্র রেখে আসা; সুড়ঙ্গ আবিষ্কারের ভুয়া দাবি করা।

এটি ইসরায়েলের দীর্ঘ ইতিহাসের অংশ, যেখানে ১৯৪৮ সাল থেকে ফিলিস্তিনি গ্রাম-শহর ধ্বংস করে তাদের ওপর ইহুদি বসতি গড়ে তুলে জাতিগত নিধনের প্রমাণ মুছে ফেলা হয়েছে।

ইসরায়েলি গোয়েন্দারা আর্কাইভ থেকে এমন নথিও সরিয়ে ফেলেছে যা নাকবার সময় জায়নিস্ট ও ইসরায়েলি বাহিনীর যুদ্ধাপরাধের প্রমাণ দেয়। এসব নথির কিছুতে দাওয়াইমেহ গ্রামের মতো হত্যাযজ্ঞের ভয়াবহ বর্ণনা রয়েছে, যেখানে শত শত ফিলিস্তিনি পুরুষ, নারী ও শিশু কামানগোলায় বা সরাসরি গুলি করে হত্যা করা হয়েছিল। ১৯৫৫ সালে এই গ্রামের ধ্বংসাবশেষের ওপর আমাজিয়া বসতি গড়ে তোলা হয়।

এখন গাজা উপত্যকার উত্তর দখল করে, ইসরায়েল একই প্রমাণমোছা কৌশল প্রয়োগ করবে এবং বিদেশি গণমাধ্যমের কভারেজ নিয়ন্ত্রণে রাখবে, যেমনটি এতদিন করেছে।

ইসরায়েলি সেনারা বিদেশি সাংবাদিকদের কেবল সেনা-নিয়ন্ত্রিত সফরে গাজায় প্রবেশ করতে দিয়েছে, যেখানে সব উপকরণ সেনা কর্তৃপক্ষের অনুমোদন ছাড়া প্রকাশ করা যায় না, সাংবাদিকরা ক্রমাগত নজরদারিতে থাকে, এবং ফিলিস্তিনিদের সঙ্গে স্বাধীনভাবে কথা বলতে পারে না।

এভাবে সাংবাদিকরা হয়ে ওঠে ইসরায়েলি সেনাদের মুখপাত্র, যারা ধ্বংসযজ্ঞের যৌক্তিকতা প্রচার করে এবং ফিলিস্তিনি বেসামরিক মানুষদের “মানবঢাল” বা গাজার হাসপাতাল ও স্কুলগুলোকে “সন্ত্রাসের ঘাঁটি” হিসেবে তুলে ধরে।

পুরো দখলদারিত্ব আরও হত্যাযজ্ঞ ও জাতিগত নিধনকে সহজ করে তুলবে। যারা জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুত হতে অস্বীকার করবে, তাদের “যোদ্ধা” বলে হত্যা ন্যায্যতা দেওয়া হবে। ইসরায়েল গণহত্যার শুরুতেই এই কৌশল ব্যবহার করেছে—উত্তর গাজার ফিলিস্তিনিদের লিফলেট দিয়ে হুঁশিয়ারি দেওয়া হয়েছিল, সরতে অস্বীকার করলে তাদের “সন্ত্রাসী সংগঠনের সহযোগী” ধরা হবে।

গণ-বাস্তুচ্যুতি অপরাধ ঢাকার মূল অংশ, কারণ এতে একটি নতুন বয়ান তৈরি হয়—ফিলিস্তিনিরা নাকি স্বেচ্ছায় চলে যাচ্ছে, বাস্তবে তারা জাতিগতভাবে উচ্ছেদ হচ্ছে। স্বল্পমেয়াদে, তাদের দক্ষিণে কনসেনট্রেশন ক্যাম্পে ঠেলে দেওয়া হবে, যাতে তারা নিজেদের ঘরবাড়ি ও জমি থেকে বিচ্ছিন্ন হয়। সময়ের সঙ্গে, তাদের অন্যত্র পাঠানো ও প্রত্যাবর্তনের অধিকার অস্বীকার করা সহজ হবে। ঠিক যেমন নাকবার শরণার্থীদের গাজায় ঠেলে দেওয়া হয়েছিল এবং পরে ফিরতে দেওয়া হয়নি।

আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রতিক্রিয়া এখনো কেবল নিন্দা। জার্মানি গাজায় ব্যবহৃত হতে পারে এমন অস্ত্র রপ্তানি স্থগিত করেছে—যা ২২ মাস আগে করা উচিত ছিল, যখন ইসরায়েল নির্বিচারে বোমা বর্ষণ শুরু করেছিল।

এই পদক্ষেপগুলো করুণ। এগুলো এসব সরকারকে গণহত্যায় সহায়তা ও মদদ দেওয়ার দায় থেকে মুক্ত করে না; বরং তাদের নৈতিক ভীরুতার প্রমাণ।

আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে এখনই দৃঢ় পদক্ষেপ নিতে হবে। আন্তর্জাতিক আইনে নির্ধারিত সামরিক হস্তক্ষেপের মাধ্যমে ইসরায়েলকে তাৎক্ষণিকভাবে সহিংসতা বন্ধ করতে, গাজায় অবাধ মানবিক সহায়তা প্রবেশের অনুমতি দিতে, এবং ফিলিস্তিনিদের প্রাপ্য স্বাধীনতা ফিরিয়ে দিতে বাধ্য করতে হবে। আন্তর্জাতিক সাংবাদিকদের এখনই প্রবেশাধিকার দিতে হবে, যাতে তারা ইসরায়েলের অপরাধের অবশিষ্ট প্রমাণ সংগ্রহ করতে পারে, সেগুলো “সামরিক অভিযান”–এর আড়ালে মিলিয়ে যাওয়ার আগে।

বিশ্বকে এখন ফিলিস্তিনিদের বিশ্বাস করতে হবে। ২২ মাস ধরে, ফিলিস্তিনিরা বলে আসছে—এটি গণহত্যা। তারা বলেছে ধ্বংসস্তূপের নিচে চাপা পড়েও, অনাহারে থেকেও, সন্তানদের লাশ কাঁধে নিয়েও। তারা বলেছে, ইসরায়েল আত্মরক্ষা করছে না, বরং ফিলিস্তিনিদের নিশ্চিহ্ন করছে। তারা বলেছে, লক্ষ্য দখলদারিত্ব ও জাতিগত নিধন। ইসরায়েলি রাজনীতিবিদরাও তা স্বীকার করেছে।

যদি এখনই আন্তর্জাতিক পদক্ষেপ না নেওয়া হয়, তবে “কখনো আর নয়” কথাটি গণহত্যা ঠেকানোর বদলে গাজায় ফিলিস্তিনি জীবনের বিলোপকে বোঝাবে। যে সত্য বলার জন্য এত ফিলিস্তিনি প্রাণ দিয়েছেন, তা যেন তাদের সঙ্গেই কবর না হয়।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *