
কুমার প্রীতীশ বল
ক্ষাণিকক্ষণ আগে রাত্রি নেমেছে নগরের বুক জুড়ে। ব্যালকনির দোলনায় দুলতে দুলতে মনোযোগ দিয়ে নীরা ফাগুনের আকাশ দেখছেন। আকাশে তারারা জ¦ল-জ¦ল করছে। আইফোনের পাশে টি-টেবিলে অর্ধেকটা কফি তখনও বর্তমান। চারপাশ ঘিরে আছে এক নির্জনতা। ঘরের আলো, সংসারের কোলাহল– সবই একঘেয়েমি লাগছে। আলোর রহস্যময়ী সহোদরার মতো এই অন্ধকার আকাশ ঘন হয়ে উঠছে। নীরার ভেতরের নির্জনতাটাও রাত বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বেড়ে চলেছে।
আজকের রাতটা কেন জানি অন্যরকম লাগছে তাঁর। মনে হয়, কোনো এক বিলুপ্ত নগরীর মতো। সেই নগরীর এক ধূসর প্রাসাদের রূপ জেগে ওঠছে হৃদয়ে।
নির্জনতাটা যখন স্বৈরাচারের হিংস্র থাবার মতো জাঁকিয়ে বসছে, তখন মিউট আইফোনের আলোটা জ¦লে ওঠে। ওয়াটসআপে অমিত লিখেছে, ‘ছাদে কেউ নেই। একবার আসবেন?’
এ-সময় নীরার ছাদে যেতে ইচ্ছে করছিল না। তাই লিখলেন, ‘রাত্রি অনেক।’
সুনীল একটা ‘হাসির লিমুজি’ পাঠিয়ে লিখল, ‘কী করেন?’
‘নগ্ন-নির্জন আধাঁরের রূপ দেখি।’
সুনীল আবার ‘হাসির লিমুজি’ পাঠাল।
নীরা পাল্টা ‘হাসির লিমুজি’ পাঠিয়ে লিখলেন, ‘বলছ যখন আসছি।’
সুনীল-নীরার নিঃশব্দে ছাদে উঠে।
সুনীলের প্রশ্ন, ‘শরৎবাবু নাকি জীবনানন্দ দাশ? কে দায়িত্ব দিয়ে গেল নগ্ন-নির্জন আধাঁরের রূপ বর্ণনার?
নারী মৃদু হেসে জবাব দিলেন, ‘দু’জনের একজনও না।’
‘তবে?’
‘সুনীল গাঙ্গুলী।’
সুনীল হা…হা করে হেসে উঠল। সুনীলের হাসিটা রাতের নির্জনতাকে ছিন্ন করে অনেক দূরে চলে গেল।
‘আপনি একসময় গভীরভাবে ভালোবাসতেন!’
নীরা চমকে ওঠেন।
ক্ষণিকের নীরবতা ভেঙ্গে নীরা প্রশ্ন করলেন,‘কি করে জানলে?’
‘আপনার চোখ দেখে।’
‘এমন নিকষ নির্জন আধাঁরে আমার চোখ পড়তে পারলে!’ নীরার এ-এক মহাবিস্ময়।
‘কারণ আমি কবি। আপনিও কবিতা লিখতেন একসময়।’
নীরা বাংলার এম.এ। কলেজে পড়তে কবিতা লিখতেন। ছাপাও হয়। নাম কুড়িয়েছিলেন কিছু।
স্বামীর পছন্দ হলো না। যুক্তি দিল, ‘কবিরা অসুখি হয়।’
ধীরে ধীরে নিজেকে গুটিয়ে নিলেন। চার দেয়ালে বন্দি করে নিলেন নিজেকে।
‘এখন আমার পরিচয় শুধু একজন মানুষ কিংবা অমানুষের স্ত্রী। সন্তানের মা। আর কিছু না।’
সুনীল বলল, ‘সবাই বাঁচে। কিন্তু, খুব কম মানুষ জীবনের আঁধারে আলোর রোশনাই খুঁজে পায়। আপনি পাবেন। কারণ আপনি কবি। আপনি অন্যরকম।’
ফাগুনের হাওয়া তখন ধীর ধীর করে বইছিল। নীরার শাড়ির আঁচল উড়ে অন্যছাদে অমিতের কাঁধ ছুঁয়ে দিল।
চোখের কোণে জমে থাকা জলটুকু লুকিয়ে ফেললেন নীরা। তাঁর মনে হলো, কেউ যেন জীবনের আঁধারে একফালি আলোর রোশনি ছুঁয়ে দিয়ে গেল…। মনে হলো, আজকের রাতটা সত্যি অন্যরকম!
