Thursday, September 18
Shadow

অনলাইন জুয়ায় আসক্ত যুবসমাজ : এখনই সময় সিদ্ধান্ত নেওয়ার

….. স্বপন বিশ্বাস
আজকের তরুণ প্রজন্ম প্রযুক্তির সবচেয়ে সহজলভ্য সময়ের মধ্য দিয়ে বেড়ে উঠছে। স্মার্টফোন, ইন্টারনেট, সোশ্যাল মিডিয়া ও গেমিং—সবই হাতের মুঠোয়। এই প্রযুক্তি নিঃসন্দেহে তাদের সম্ভাবনা উন্মোচনের শক্তিশালী হাতিয়ার। কিন্তু সেই একই প্রযুক্তি আজ তাদের জন্য হয়ে উঠছে এক ভয়ঙ্কর ফাঁদ—অনলাইন জুয়া। সামান্য কৌতূহল বা বিনোদনের নাম করে শুরু হলেও অল্প সময়েই এ নেশা গ্রাস করছে তরুণদের স্বপ্ন, ভবিষ্যৎ ও পরিবার।অনলাইন জুয়া মূলত সহজ অর্থ উপার্জনের প্রলোভন দেখায়। এক ক্লিকেই খেলা, লটারি বা বেটিংয়ে অংশ নেওয়া যায়। প্রথমদিকে কেউ কেউ সামান্য লাভ পেলেও খুব দ্রুতই তারা অন্ধকারের গহ্বরে তলিয়ে যায়। কারণ এই খেলার নিয়মটাই এমন, যেখানে জেতার চেয়ে হারার সম্ভাবনা বহুগুণ বেশি। একসময় খেলোয়াড় বুঝতে পারে, সে শুধু অর্থ হারাচ্ছে না, বরং নিজের সময়, মনোযোগ আর ভবিষ্যতকেও ধ্বংস করে ফেলছে।
এ আসক্তির সবচেয়ে বড় শিকার হচ্ছে পড়াশোনা। শিক্ষার্থীরা রাত জেগে বই নয়, বরং মোবাইলের স্ক্রিনে জুয়ার সাইট ঘাঁটছে। পরীক্ষার ফল খারাপ হচ্ছে, শিক্ষাজীবন ভেঙে পড়ছে। পরিবার থেকে পাওয়া টাকার বাইরে খরচ মেটাতে শুরু হয় চুরি, প্রতারণা কিংবা ঋণ নেওয়ার প্রবণতা। অনেকে আবার হতাশা থেকে মানসিক ভারসাম্য হারাচ্ছে। সমাজে আমরা ইতিমধ্যে দেখেছি—অনলাইন জুয়ার কারণে আত্মহত্যা বা অপরাধের ঘটনাও ঘটছে। এটি শুধু একজন তরুণের ক্ষতি নয়, বরং একটি পরিবারের ভাঙন ও সমাজের নিরাপত্তার ওপর সরাসরি আঘাত।
কেন তরুণরা এত সহজে এ নেশায় জড়িয়ে পড়ছে? প্রথমত, সচেতনতার অভাব। তারা ভাবে, এটি কেবল খেলা, সামান্য বিনোদন মাত্র। দ্বিতীয়ত, অনিয়ন্ত্রিত ইন্টারনেট ব্যবহার। রাতদিন অবাধে মোবাইল হাতে থাকার কারণে তরুণরা নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলে। তৃতীয়ত, পরিবার ও সমাজে পর্যাপ্ত নজরদারির অভাব। অনেক বাবা-মা সন্তানের ইন্টারনেট ব্যবহারের দিকগুলো খেয়াল করেন না। ফলে আসক্তি গড়ে ওঠে অজান্তেই।

এখন প্রশ্ন হচ্ছে—এ থেকে মুক্তির পথ কোথায়?
প্রথমত, পরিবারকে সচেতন হতে হবে। সন্তান কী করছে, কার সঙ্গে মিশছে, কতক্ষণ ইন্টারনেটে সময় দিচ্ছে—এসব বিষয়ে নজর রাখা জরুরি। একে অপরের সঙ্গে খোলামেলা আলোচনা করার অভ্যাস গড়ে তুলতে হবে।
দ্বিতীয়ত, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে এগিয়ে আসতে হবে। স্কুল-কলেজে অনলাইন জুয়ার ক্ষতিকর দিক নিয়ে সেমিনার, কর্মশালা ও আলোচনা সভা আয়োজন করা উচিত। শিক্ষকদেরও শিক্ষার্থীদের মানসিক অবস্থা পর্যবেক্ষণ করতে হবে।
তৃতীয়ত, রাষ্ট্রীয়ভাবে কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে অনলাইন ক্যাসিনো, বেটিং সাইট বা অবৈধ অ্যাপগুলো চিহ্নিত করে বন্ধ করতে হবে। একইসঙ্গে আইটি বিশেষজ্ঞদের সহযোগিতায় একটি শক্তিশালী নজরদারি ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে।
চতুর্থত, তরুণদের নিজস্ব আত্মনিয়ন্ত্রণ গড়ে তুলতে হবে। অনলাইন জুয়া যে কেবল অর্থ নয়, জীবনকেও ধ্বংস করে—এই বোধ তাদের ভেতরে গড়ে তুলতে হবে। বিকল্প বিনোদনের পথ যেমন খেলাধুলা, সাহিত্য, সংগীত বা সৃজনশীল কাজের প্রতি আগ্রহী করা দরকার।
আমরা যদি এখনই পদক্ষেপ না নেই, তবে অনলাইন জুয়ার এই আগ্রাসন আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে বিপথে ঠেলে দেবে। যেভাবে মাদক একসময় সমাজে ভয়াল থাবা বসিয়েছিল, অনলাইন জুয়াও ঠিক তেমন ভয়াবহ রূপ নিতে চলেছে।
প্রযুক্তি আমাদের শত্রু নয়, বরং বন্ধু। তবে এই বন্ধুকে সঠিকভাবে ব্যবহার করতে না পারলে সেটিই হয়ে উঠবে সর্বনাশের কারণ। তরুণ সমাজকে বাঁচাতে হলে এখনই সিদ্ধান্ত নিতে হবে—আমরা কি প্রযুক্তিকে উন্নতির হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করব, নাকি অনলাইন জুয়ার ফাঁদে পড়ে নিজের স্বপ্ন ও সম্ভাবনাকে ধ্বংস হতে দেব?
সময়ের দাবি—একটি সুস্থ, সচেতন ও নিয়ন্ত্রিত সমাজ গড়ে তোলা, যেখানে তরুণরা তাদের প্রতিভা কাজে লাগিয়ে দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাবে। আর এজন্যই এখনই সময় সিদ্ধান্ত নেওয়ার।
স্বপন বিশ্বাস
সাংবাদিক ও কবি
শালিখা মাগুরা

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *