
একটি সহজ বিশ্লেষণ
ইসলাম একটি পরিপূর্ণ জীবনবিধান, যেখানে পারিবারিক সম্পর্কের বন্ধন রক্ষা ও সামাজিক ভারসাম্য বজায় রাখাকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক ভেঙে যাওয়া, অর্থাৎ তালাক, যদিও আল্লাহর সবচেয়ে অপছন্দনীয় বৈধ কাজগুলোর একটি, তথাপি কিছু পরিস্থিতিতে ইসলামে এর অনুমতি রয়েছে।
তালাকের পর পুনরায় সংসার করার সুযোগ ও সীমা কী? ইসলামি শরিয়াহ, বিশেষ করে কুরআনুল কারিম ও রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সহিহ হাদিস—এই দুটি মূল উৎসের আলোকে বিষয়টি বিশ্লেষণ করা প্রয়োজন।
❖ তালাকের প্রকারভেদ ও কুরআনের দৃষ্টিভঙ্গি
কুরআনুল কারিমে আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেন: ٱلطَّلَٰقُ مَرَّتَانِۖ فَإِمۡسَاكُۢ بِمَعۡرُوفٍ أَوۡ تَسۡرِيحُۢ بِإِحۡسَٰنࣲۗ وَلَا يَحِلُّ لَكُمۡ أَن تَأۡخُذُواْ مِمَّآ ءَاتَيۡتُمُوهُنَّ شَيۡئًا إِلَّآ أَن يَخَافَآ أَلَّا يُقِيمَا حُدُودَ ٱللَّهِۖ فَإِنۡ خِفۡتُمۡ أَلَّا يُقِيمَا حُدُودَ ٱللَّهِ فَلَا جُنَاحَ عَلَيۡهِمَا فِيمَا ٱفۡتَدَتۡ بِهِۦۗ تِلۡكَ حُدُودُ ٱللَّهِ فَلَا تَعۡتَدُوهَاۚ وَمَن يَتَعَدَّ حُدُودَ ٱللَّهِ فَأُوْلَٰٓئِكَ هُمُ ٱلظَّٰلِمُونَ “তালাক দু’বার। অতঃপর বিধি মোতাবেক রেখে দেবে কিংবা সুন্দরভাবে ছেড়ে দেবে। আর তোমাদের জন্য হালাল নয় যে, তোমরা তাদেরকে যা দিয়েছ, তা থেকে কিছু নিয়ে নেবে। তবে উভয়ে যদি আশঙ্কা করে যে, আল্লাহর সীমারেখায় তারা অবস্থান করতে পারবে না। সুতরাং তোমরা যদি আশঙ্কা কর যে, তারা আল্লাহর সীমারেখা কায়েম রাখতে পারবে না তাহলে স্ত্রী যা দিয়ে নিজকে মুক্ত করে নেবে তাতে কোন সমস্যা নেই। এটা আল্লাহর সীমারেখা। সুতরাং তোমরা তা লঙ্ঘন করো না। আর যে আল্লাহর সীমারেখাসমূহ লঙ্ঘন করে, বস্তুত তারাই যালিম।“— (সূরা আল-বাকারা, ২:২২৯)
এই আয়াত থেকে বোঝা যায়, স্বামী তার স্ত্রীকে সর্বোচ্চ দুইবার তালাক দেওয়ার পর আবার রুজু করতে (সংসারে ফিরিয়ে নিতে) পারে ইদ্দত চলাকালীন। তবে তৃতীয় তালাক দিলে তারপরে আর রুজু বা পুনরায় বিবাহের সুযোগ নেই—এতে স্থায়ী বিচ্ছেদ হয়ে যায়।
আল্লাহ বলেন: فَإِن طَلَّقَهَا فَلَا تَحِلُّ لَهُۥ مِنۢ بَعۡدُ حَتَّىٰ تَنكِحَ زَوۡجًا غَيۡرَهُۥۗ فَإِن طَلَّقَهَا فَلَا جُنَاحَ عَلَيۡهِمَآ أَن يَتَرَاجَعَآ إِن ظَنَّآ أَن يُقِيمَا حُدُودَ ٱللَّهِۗ وَتِلۡكَ حُدُودُ ٱللَّهِ يُبَيِّنُهَا لِقَوۡمࣲ يَعۡلَمُونَ “অতএব যদি সে তাকে তালাক দেয় তাহলে সে পুরুষের জন্য হালাল হবে না যতক্ষণ পর্যন্ত ভিন্ন একজন স্বামী সে গ্রহণ না করে। অতঃপর সে (স্বামী) যদি তাকে তালাক দেয়, তাহলে তাদের উভয়ের অপরাধ হবে না যে, তারা একে অপরের নিকট ফিরে আসবে, যদি দৃঢ় ধারণা রাখে যে, তারা আল্লাহর সীমারেখা কায়েম রাখতে পারবে। আর এটা আল্লাহর সীমারেখা, তিনি তা এমন সম্প্রদায়ের জন্য স্পষ্ট করে দেন, যারা জানে।“— (সূরা আল-বাকারা, ২:২৩০)
অর্থাৎ, তৃতীয় তালাকের পর আগের স্বামী-স্ত্রী একে অপরের জন্য হারাম হয়ে যান, যতক্ষণ না স্ত্রী অন্য কাউকে বিয়ে করে এবং প্রকৃত কারণে সেই বিয়েও শেষ না হয়।
❖ তালাকের পরে পুনরায় বিবাহের শরয়ি শর্ত
তৃতীয় তালাকের পর আগের স্বামীর সঙ্গে ফের সংসার করতে হলে, নিচের শর্তগুলো পূরণ হওয়া বাধ্যতামূলক:
১. স্ত্রীকে অন্য পুরুষকে প্রকৃতভাবে বিয়ে করতে হবে।
২. সেই বিয়ে বাসর সম্পন্ন হওয়া চাই। (হালালাহ শর্ত)
৩. দ্বিতীয় স্বামী যদি তাকে তালাক দেয় বা তার মৃত্যু হয়, তাহলে ইদ্দত শেষে প্রথম স্বামীকে বিয়ে করা বৈধ।
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন: “যতক্ষণ না তুমি তার (দ্বিতীয় স্বামীর) সঙ্গে সহবাস করো, সে পর্যন্ত তুমি আগের স্বামীর জন্য হালাল হবে না।” — (সহিহ বুখারি, হাদিস: ৫২৬১; সহিহ মুসলিম, হাদিস: ১৪০৩)
এই হাদিসটি তালাকের পর হালাল হওয়ার স্পষ্ট নির্দেশনা দেয়।
❖ ‘হালালাহ’ কৃত্রিমভাবে করা যাবে না
বর্তমানে কিছু জায়গায় দেখা যায়, তালাকপ্রাপ্ত স্ত্রীকে পূর্ব স্বামীর সঙ্গে পুনরায় বিয়ের সুযোগ করে দিতে কৃত্রিম ‘হালালাহ’ করা হয়—অর্থাৎ একজন পুরুষকে ভাড়া করা হয় বিয়ে ও সহবাসের নামমাত্র উদ্দেশ্যে।
রাসুল (সা.) এ ব্যাপারে কঠোরভাবে সতর্ক করেছেন: “যে ব্যক্তি কোনো মহিলাকে হালাল করার জন্য বিয়ে করে এবং যে ব্যক্তি হালাল করায়, উভয়েই অভিশপ্ত।” — (সুনান ইবন মাজাহ, হাদিস: ১৯৩৮; আবু দাউদ, হাদিস: ২০৭6; সহিহ হিসেবে হাদিসটি আলবানী প্রমাণ করেছেন)
এই হাদিস থেকে বোঝা যায়, কৃত্রিম ‘হালালাহ’ করা হারাম এবং গর্হিত কাজ।
❖ সালাফি আলেমদের অবস্থান
সালাফি আলেমগণ—যারা কুরআন ও সহিহ হাদিসকে ভিত্তি করে ফতোয়া দেন—তারা পরিষ্কারভাবে বলেন:
- তালাক একটি সিরিয়াস বিষয়। এটি মজা করে, রাগের মাথায় বা খেলার ছলে দেওয়া জায়েয নয়।
- তালাকের নিয়ম না মানলে সেটি শরিয়তসম্মত হবে না।
- তৃতীয় তালাকের পর রুজু করা হারাম, যতক্ষণ না স্ত্রী অন্য কাউকে প্রকৃতভাবে বিয়ে করেন।
শাইখ ইবনে বায (রহ.) বলেন: “তৃতীয় তালাকের পর সে (স্ত্রী) স্বামীর জন্য হারাম। যতক্ষণ না সে অন্য কাউকে বিয়ে করে সহবাস করে, এবং সে স্বামী তাকে তালাক দেয়।”
ইসলামে তালাক একটি গম্ভীর বিষয়, যা সম্পর্ক রক্ষা ও বিচ্ছেদ—দুইটিরই পথ খুলে দেয়। তবে এর অপব্যবহার বা কৃত্রিম পথ অবলম্বন করা ইসলামে নিষিদ্ধ।
তালাকের পর পুনরায় সংসার গড়তে চাইলে কুরআন ও সহিহ হাদিসের নিদর্শন মেনে চলাই একমাত্র পথ। ইসলামী শরিয়াহ, পারিবারিক সুস্থতা ও নৈতিক শৃঙ্খলার জন্য এটিই সর্বোত্তম ও নিরাপদ পন্থা।