Friday, June 6
Shadow

চীনে স্মার্ট প্রযুক্তিতে নতুন রুপ: পোষা প্রাণীর যত্নে ব্যবহৃত হচ্ছে শিল্পটি

প্রযুক্তিনির্ভর তরুণ প্রজন্ম বদলে দিচ্ছে পোষাপ্রাণী শিল্পের চেহারা

বেইজিংয়ের এক ব্যস্ত সকালে ৩৫ বছর বয়সী প্রযুক্তিপ্রেমী জিয়াং নান তার তিনটি আদুরে বিড়ালের খাবার দেওয়া বা মল-মূত্র পরিষ্কার করা নিয়ে একটুও চিন্তিত নন। আধুনিক স্মার্ট ফিডার স্বয়ংক্রিয়ভাবে সময়মতো নির্ধারিত পরিমাণ খাবার সরবরাহ করে, ২৪ ঘণ্টাব্যাপী পানিশোধক ফোয়ারা বিশুদ্ধ পানি দেয়, আর একটি স্বয়ংক্রিয় ক্যাট লিটার বক্স বিড়ালের বর্জ্য পরিষ্কারের পাশাপাশি ওজনের সূক্ষ্ম পরিবর্তনও রেকর্ড করে রাখে।

“আমার জন্য বিড়াল পালা শুধু আনন্দের নয়, বরং অনেক সহজও,” বলেন জিয়াং। “আমি যখন ব্যবসায়িক সফরে থাকি, তখনও সবকিছু স্বয়ংক্রিয়ভাবে চলে। আমার বিড়ালরা যেমন সুখে থাকে, আমিও তেমন নিশ্চিন্ত।”

জিয়াংয়ের এই অভিজ্ঞতা শুধু তার একার নয় — এটি চীনের দ্রুত বর্ধনশীল পোষাপ্রাণী শিল্পে ঘটতে থাকা এক প্রযুক্তিনির্ভর বিপ্লবের প্রতিচ্ছবি। একসময় অবসরপ্রাপ্তদের শখ হিসেবে ফুল-পাখির বাজারে সীমাবদ্ধ এই খাত এখন স্মার্ট ডিভাইস, এআই প্রযুক্তি এবং ডিজিটাল সেবার মাধ্যমে তরুণ, শহুরে, প্রযুক্তিনির্ভর জনগোষ্ঠীর কাছে এক আবেগময় ও উন্নত সেবা খাতে রূপ নিচ্ছে।

চীনের পোষাপ্রাণী গবেষণা প্ল্যাটফর্ম Petdata.cn-এর ২০২৫ সালের ‘চায়নিজ পেট ইন্ডাস্ট্রি হোয়াইট পেপার’-এর তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪ সালে শহুরে এলাকায় কুকুর ও বিড়াল পালনের বাজার ৭.৫ শতাংশ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩০০.২ বিলিয়ন ইউয়ানে (প্রায় ২.০৯ বিলিয়ন মার্কিন ডলার)। একই সময়ে দেশের মোট পোষাপ্রাণী সংখ্যা ২.১ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়িয়েছে ১২৪.১১ মিলিয়নে। এর মধ্যে বিড়ালের সংখ্যা বৃদ্ধির হার ছিল ২.৫ শতাংশ, যেখানে কুকুরের হার ১.৬ শতাংশ — যা বিড়াল পালনের বাড়তি জনপ্রিয়তাকে স্পষ্টভাবে নির্দেশ করে।

এই প্রবৃদ্ধির পেছনে আছে এক উল্লেখযোগ্য প্রজন্মগত পরিবর্তন যা দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে। ১৯৯০-এর পর জন্ম নেওয়া পোষাপ্রাণী মালিকরা এখনও সংখ্যাগরিষ্ঠ (৪১.২ শতাংশ), কিন্তু এদের হার কমছে। বরং ২০০০ সালের পর জন্ম নেওয়া তরুণদের অংশগ্রহণ নাটকীয়ভাবে বেড়েছে — ২০২৪ সালে এ হার দাঁড়িয়েছে ২৫.৬ শতাংশ, যা আগের বছরের তুলনায় ১৫.৫ শতাংশ বেশি।

এই তরুণ প্রজন্মের অনেকেই ব্যস্ত পেশাজীবী, যারা সাশ্রয়ী, কার্যকর এবং আবেগসঞ্জাত যত্ন নিশ্চিতে স্মার্ট পোষা ডিভাইসের দিকে ঝুঁকছেন। এদের কাছে পোষাপ্রাণীর যত্ন মানে শুধু খাওয়ানো বা পরিষ্কার নয় — বরং স্বাস্থ্যগত নজরদারি, মানসিক সংযোগ এবং জীবনমান উন্নয়ন।

Petkit Network Technology Co Ltd-এর সহ-প্রতিষ্ঠাতা ও সিইও গুয়ো ওয়েইশ্যু বলেন, “পোষাপ্রাণী পালন সাধারণত দুটি ধাপে এগোয়। শুরুতে আপনি তাকে একটি আদুরে শিশু মনে করেন। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে, বিশেষ করে বয়স বাড়ার সঙ্গে যখন অসুস্থতা দেখা দেয়, তখন স্বাস্থ্যই হয়ে ওঠে মূল চিন্তার বিষয়।”

শুধু চিন্তা নয়, প্রযুক্তির বাস্তব প্রয়োগেও এর প্রতিফলন মিলছে। Petkit-এর সর্বশেষ রিপোর্ট অনুযায়ী, কোম্পানিটি গত বছর আয় করেছে প্রায় ১.১ বিলিয়ন ইউয়ান, যার ৯০ শতাংশ এসেছে তিনটি প্রধান পণ্য থেকে: স্মার্ট লিটার বক্স, স্মার্ট ফিডার এবং স্মার্ট পানি ফোয়ারা।

বিশেষ বিষয় হলো, এই প্রযুক্তি কেবল চীনে সীমাবদ্ধ নয়। Petkit-এর প্রায় অর্ধেক বিক্রি হচ্ছে আন্তর্জাতিক বাজারে — ইউরোপ, যুক্তরাষ্ট্র, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার ৪০টিরও বেশি দেশ ও অঞ্চলে। বিশ্বজুড়ে Petkit অ্যাপের ৫০ লক্ষের বেশি সক্রিয় ব্যবহারকারী রয়েছেন, যাদের অনেকেই সাবস্ক্রিপশনভিত্তিক ভিডিও প্লেব্যাকসহ অতিরিক্ত পরিষেবা নিচ্ছেন।

Petkit-এর ভবিষ্যৎ লক্ষ্য আরও বড়। শুধু স্বয়ংক্রিয় যত্ন নয় — বরং প্রতিটি পোষাপ্রাণীর বাসস্থানকে একটি পূর্ণাঙ্গ স্বাস্থ্য পর্যবেক্ষণ কেন্দ্রে পরিণত করাই তাদের উদ্দেশ্য। নতুন এআই-চালিত স্মার্ট লিটার বক্স বিড়ালের মূত্র ও মলের পরিমাণ ও গঠন বিশ্লেষণ করে যেকোনো অস্বাভাবিকতা শনাক্ত করতে পারে।

উদাহরণস্বরূপ, যদি কোনো বিড়াল সাধারণত দিনে ৬ বার প্রস্রাব করে, আর হঠাৎ সেটা বেড়ে ১২ বার হয়ে যায়, তাহলে এটি মূত্রনালীর জটিলতার ইঙ্গিত হতে পারে। এমন ক্ষেত্রে মাত্র ২০ থেকে ৫০ ইউয়ানের ওষুধ বা সাপ্লিমেন্ট দিয়েই বড় ধরনের চিকিৎসা ব্যয় বা যন্ত্রণাদায়ক রোগ প্রতিরোধ করা সম্ভব।

যেসব পরিবারে একাধিক বিড়াল থাকে, সেখানে অসুস্থ বিড়ালটিকে শনাক্ত করতে Petkit ব্যবহার করছে উন্নত ফেসিয়াল রিকগনিশন প্রযুক্তি। এমনকি তাদের ‘ইউরিন মনিটর ক্যাট লিটার’-এর মাধ্যমে মূত্রের অ্যাসিডিটি, লুকানো রক্ত বা সুগারের উপস্থিতি শনাক্ত করা যায় — যা কিনা কিডনির পাথর, সংক্রমণ বা ডায়াবেটিসের মতো গুরুতর অবস্থার প্রাথমিক সতর্কতা দিতে পারে।

চীনের মতো বিশাল জনসংখ্যার দেশে পোষাপ্রাণীর যত্নে প্রযুক্তিনির্ভরতার এই উত্থান নিছক বিলাসিতা নয় — বরং সময় ও বাস্তবতার দাবি। তরুণ প্রজন্মের প্রযুক্তিমুখী জীবনধারায় স্মার্ট পোষা ডিভাইস যেন আবেগ আর দায়িত্বের সেতুবন্ধন তৈরি করছে।

এই রূপান্তর শুধু ব্যবসায়িক লাভেই সীমাবদ্ধ নয়; বরং এটি পোষাপ্রাণীর স্বাস্থ্য, মানুষের সঙ্গে মানসিক সংযোগ এবং টেকসই যত্ন ব্যবস্থার ক্ষেত্রেও এক যুগান্তকারী অগ্রগতি — যা আগামী দিনের পোষাপ্রাণী শিল্পকে আরও মানবিক, আরও বুদ্ধিদীপ্ত এবং আরও লাভজনক করে তুলছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *