
সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মেজর সিনহা মো. রাশেদ খান হত্যা মামলায় প্রধান দুই আসামি টেকনাফ থানার তৎকালীন ওসি প্রদীপ কুমার দাশ এবং পরিদর্শক মো. লিয়াকত আলীর মৃত্যুদণ্ড বহাল রেখেছেন হাইকোর্ট। একইসঙ্গে বাকি ছয় আসামিকে দেওয়া যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের রায়ও বহাল রেখেছেন আদালত।
আজ সোমবার (৩ জুন) বিচারপতি মোহাম্মদ মোস্তাফিজুর রহমান ও বিচারপতি মোহাম্মদ সগীর হোসেনের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ এ রায় ঘোষণা করেন।
এর আগে ২০২৪ সালের ২৯ মে বহুল আলোচিত এই মামলার ডেথ রেফারেন্স ও দণ্ডিতদের করা আপিলের শুনানি শেষ হয়। শুনানি শেষে আদালত রায়ের জন্য ৩ জুন তারিখ নির্ধারণ করেন।
গত ২৩ মে থেকে টানা কার্যদিবসগুলোতে উচ্চ আদালতে এ মামলার শুনানি চলে। শুনানিতে মামলার এফআইআর, চার্জশিট, সাক্ষ্যপ্রমাণ, জেরা, মামলার পেপারবুক, ১৬৪ ধারায় সাক্ষী ও আসামিদের জবানবন্দি উপস্থাপন করা হয়। এরপর অভিযোগ গঠন ও বিচারিক আদালতের রায় পাঠের পর রাষ্ট্রপক্ষ ও আসামিপক্ষ যুক্তিতর্ক উপস্থাপন করেন।
২০২০ সালের ৩১ জুলাই রাত সাড়ে ৯টার দিকে কক্সবাজার-টেকনাফ মেরিন ড্রাইভ সড়কের শামলাপুর তল্লাশিচৌকিতে পুলিশের গুলিতে নিহত হন অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা মো. রাশেদ খান। গুলি চালান পুলিশের বাহারছড়া তদন্তকেন্দ্রের তৎকালীন পরিদর্শক মো. লিয়াকত আলী। তৎকালীন টেকনাফ থানার ওসি প্রদীপ কুমার দাশ ছিলেন পুরো ঘটনার নেতৃত্বে।
ঘটনার দুই বছর পর ২০২২ সালের ৩১ জানুয়ারি কক্সবাজারের জেলা ও দায়রা জজ আদালত রায় দেন। তাতে প্রদীপ ও লিয়াকতের মৃত্যুদণ্ড এবং ছয় আসামির যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হয়।
ছয়জন যাবজ্জীবন কারাদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি হলেন: টেকনাফ থানার এসআই নন্দ দুলাল রক্ষিত, কনস্টেবল রুবেল শর্মা, কনস্টেবল সাগর দেব, বাহারছড়া ইউনিয়নের মারিশবুনিয়া গ্রামের মো. নুরুল আমিন, মোহাম্মদ আইয়াজ ও মো. নিজাম উদ্দিন।
কোনো মামলায় বিচারিক আদালত যদি আসামির মৃত্যুদণ্ড দেন, তাহলে সেটি কার্যকর করতে হাইকোর্টের অনুমোদন প্রয়োজন হয়। এটি ‘ডেথ রেফারেন্স’ নামে পরিচিত। একইসঙ্গে আসামিরা মৃত্যুদণ্ড বা অন্য দণ্ডাদেশের বিরুদ্ধে আপিল করতে পারেন, যার মধ্যে রয়েছে জেল আপিল, নিয়মিত আপিল এবং অন্যান্য আবেদন। সাধারণত এই ডেথ রেফারেন্স এবং আপিলের শুনানি একসঙ্গে অনুষ্ঠিত হয়।
সিনহা হত্যা মামলার রায়ের পর, ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে রায়সহ মামলার নথিপত্র হাইকোর্টে পৌঁছায়। এরপর সেটি ডেথ রেফারেন্স হিসেবে নথিভুক্ত হয়। একই বছরের মধ্যে দণ্ডপ্রাপ্ত আসামিরা পৃথকভাবে জেল আপিল এবং অন্যান্য আবেদন করেন।
পরে মামলার প্রস্তুতি হিসেবে পেপারবুক (মামলার বিস্তারিত বিবরণ) তৈরি করা হয় এবং প্রয়োজনীয় আনুষঙ্গিক প্রক্রিয়া শেষে প্রধান বিচারপতির অনুমোদনে এটি বিচারপতি মো. মোস্তাফিজুর রহমান ও বিচারপতি মো. সগীর হোসেনের বেঞ্চে শুনানির জন্য নির্ধারণ করা হয়।
হাইকোর্টের রায় স্পষ্টভাবে জানিয়ে দিল, রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার অপব্যবহার এবং মিথ্যা ঘটনা সাজিয়ে নাগরিক হত্যা কোনোভাবেই বরদাশতযোগ্য নয়। সিনহা হত্যা মামলায় উচ্চ আদালতের এই রায় শুধু ন্যায়বিচারের উদাহরণ নয়, বরং আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের জন্যও এক গুরুত্বপূর্ণ বার্তা — দায়িত্ব পালনের নামে বেআইনি কাজের কোনো ছাড় নেই।