
রায়হান মাহমুদ একজন আইটি উদ্যোক্তা। গড়ে তুলেছেন একাধিক আইটি কোম্পানি,স্টার্টআপ। সেখানে শতাধিক মানুষের কর্মসংস্থানের সুযোগ হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় ফ্রিল্যান্সিং দিযে তার যাত্রা শুরু হলেও এখন তিনি কর্মসংস্থান সৃষ্টির একজন কারিগর। লিখেছেন মুহাম্মদ শফিকুর রহমান।
বাবা-মা, স্ত্রী, একটি সন্তান, ১ ভাই ও ১ বোন নিয়ে রায়হানের পরিবার। তিনি জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অনার্স এবং মাস্টার্স (পলিটিক্যাল সায়েন্স) করেছেন। এরপর ওয়ারটন স্কুল অফ ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়া থেকে অন্টারপ্রিনারশীপ এ ডিপ্লোমা, ইউনিভার্সিটি অব মালয়া থেকে ক্যালিগ্রাফিতে ডিপ্লোমা, আইডিবি থেকে ফুল স্কলারশীপে মোশন গ্রাফিক্স এন্ড এনিমেশন এ হায়ার ডিপ্লোমা করেন। পরিবার নিয়ে ঢাকার উত্তরাতে থাকেন।

শুরু যেভাবে
পড়াশোনা করার সময় রায়হান শুধু বইয়ের পাতায় বুদ হয়ে থাকতেন না। তার কাছে যে কোন স্কিল ডেভলপমেন্ট বেশ গুরুত্ব পেত। ঠিক এ কারণেই অর্নাস,মার্স্টাস পড়ার পুরো সময়টাতে তিনি গ্রাফিক ডিজাইনের কাজ রপ্ত করেন। এই গ্রাফিক ডিজাইন দিয়েই ২০১৩ সালে তার ফ্রিল্যান্সিংয়ের যাত্রা শুরু। এরপর মোশন গ্রাফিক্স এ তখনকার সময়ে ওডেস্ক এখন এই মার্কেটপ্লেসের নাম আপওয়ার্কে কাজ শুরু করেন। কিছুদিনের মধ্যেই টপ রেটেড ফ্রিল্যান্সার ব্যাজ অর্জন করেন। ফ্রিল্যান্সিং করতে করতেই অনেক ক্লায়েন্টের সাথে ভালো যোগাযোগ হয়। ২০১৭ সালে কোন প্ল্যাটফর্ম ছাড়াই ডিজাইনেক্স নামে একটা ডিজাইন এজেন্সি চালু করে তার ব্যানারে কাজ করেন। এরপর আর রায়হানকে পিছন ফিরে তাকাতে হয়নি। যেখানেই হাত দিয়েছেন সফলতার দেখা পেয়েছেন।
ডিজাইনেক্স দিয়ে শুরু
রায়হানের প্রথম প্রতিষ্ঠিত কোম্পানি ডিজাইনেক্স। তার একক এবং যৌথ উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত বিজনেস গুলো হচ্ছে-ডিজাইনেক্স, বুস্ট বেঙ্গল, ইসওদা, নাগালে সার্ভিসেস লিমিটেড, কোডস ব্রেক লিমিটেড, অ্যাড ই-কমার্স । বর্তমানে তিনি চেয়ারম্যান- নাগাল সার্ভিসেস লিমিটেড, ম্যানেজিং ডিরেক্টর-কোডস ব্রেক লিমিটেড, কো-ফাউন্ডার (হেড অব কমিউনিকেশন)-অ্যাড ই-কমার্স হিসাবে কাজ করছেন।
কেন আইটি উদ্যোক্তা হলেন
ছোটবেলা থেকেই মাহমুদ কিছুটা স্বাধীনচেতা । সব সময় নিজের কিছু করার ইচ্ছা তার মধ্যে ছিলো। আর ডিজাইন এবং টেকনোলজির প্রতি এক ধরনের ভালোলাগা তো অনুভব করতেনই। এসব কারণে ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হয়ে দ্বিতীয় মাসেই তিনি একটা আইটি প্রতিষ্ঠান থেকে ৬ মাসের গ্রাফিক ডিজাইনে স্কিল ডেভেলপ করেন। নটা পাচটা চাকুরী বিষয়ে তেমন আগ্রহ বোধ করতেন না তিনি।
কোডস ব্রেক
কোডস ব্রেক থেকে ৩৬০ ডিগ্রী আইটি সলিউশন প্রোভাইড করা হয়। কোডস ব্রেক লিমিটেড, একটি প্রাইভেট লিমিটেড কোম্পানি এবং ২০২৩ সালের শেষ দিক যাত্রা শুর করে। এখানে ১৫ জনের একটি টিম কাজ করে।
নাগালে সার্ভিসেস লিমিটেড
নাগালে সার্ভিসেস লিমিটেড, মূলত এটি আমাদের একটি স্টার্টআপ। ২০২১ সালে রায়হান একজন পার্টনারকে নিয়ে এটি প্র্রতিষ্ঠা করেন। নাগালের মাধ্যমে মানুষের শর্টটার্ম থাকার ব্যবস্থা, গাড়ি ভাড়া, পার্কিং এবং স্কিল শেয়ারের মাধ্যমে উপার্জন এর সমাধান করা হয়। এখানে পাচ জনের একটি টেকনিকাল টিম আছে।
অ্যাড ই-কমার্স
অ্যাড ই-কমার্স এর মাধ্যমে রায়হানরা আমেরিকাতে পার্টনারশিপের মাধ্যমে এমাজন,ইবে,ওয়ালমার্ট, স্টোর পরিচালনায় লজিস্টিক সাপোর্ট দেন। এটি একটি পার্টনারশিপ ফার্ম। এই ফার্মের কার্যক্রম ২০২১ থেকে শুরু হলেও রায়হান যুক্ত হন ২০২৪ সালে। এই টিমে বাংলাদেশ, পাকিস্তান, ইন্ডিয়া সব মিলিয়ে ৩০ প্লাস টিম মেম্বার কাজ করছে।
প্রথম আয়
কাজের জন্য আবেদন করে রায়হান বিছানায় গা এলিয়ে দেন। এমন সময় টুং করে একটা শব্দ হয়। তিনি তখন ঢুকে দেখলেন যে কাজটার জন্য আবেদন করেছেন সেটা পেয়ে গেছেন। সে রাতেই কাজটি শেষ করেক্লায়েন্টকে বুঝিয়ে দেন। বিনিময়ে একটি বড়সড় পজেটিভ রিভিউ আর ৫০ ডলার পান। এই ৫০ ডলারই হলো কর্মজীবনের তার প্র্রথম আয়। কাজটি ছিলো বিজনেস কার্ড ডিজাইনের। রায়হান বলেন, যদিও টাকাটা ছিল খুবই কম, তবে সেই প্রথম উপার্জনের আনন্দ ছিল অসীম! সেই ৫০ ডলার আমাকে সামনে এগিয়ে যাবার জন্য জন্য অনেক বেশি অনুপ্রাণিত করেছিল।
আইটি উদ্যোক্তার চ্যালেঞ্জ
অনেকগুলো প্র্রতিষ্ঠানের কর্নধার হলেও শুরুতে নানা চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে হয়েছে রায়হানকে। কিছু চ্যালেঞ্জ এর কথা তিনি বলেন। যা এখনকার নতুন আইটি উদ্যোক্তাদের জন্য প্রয়োজনীয় হতে পারে।
এক, ব্যাবসা সম্পর্কে ভালো প্লানিং না থাকা ও শুধুমাত্র আবেগকে প্রাধান্য দিয়ে বিজনেস শুরু করা এবং শুরুর দিকে প্রয়োজনীয় ফাইন্যান্সিং না পাওয়া ।
দুই, দক্ষ এবং বিশ্বস্ত- টেকনিক্যাল স্কিলড টিম তৈরি করা একটি বড় চ্যালেঞ্জ।
তিন, বড় শহর গুলোর বাইরে হাই স্পীড ইন্টারনেট ও আইটি রিসোর্সের অভাব।
চার, আমাদের বাংলাদেশ এ ক্লায়েন্টদের মাঝে আইটি সার্ভিসের গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা এবং এটার অর্থনীতিক মূল্য সম্পর্কে সচেতনতার অভাব, যেটা বাংলাদেশের প্রেক্ষিতে একজন আইটি উদ্যোগতার প্রতিদিনকার একটা চ্যালেঞ্জ।
পাচ, ক্রমাগত নতুন নতুন কোম্পানি আসার কারণে বাজারে টিকে থাকা এবং নিজের অবস্থান শক্ত করা একটি বড় চ্যালেঞ্জ।
ছয়, আমাদের দেশে ব্যবসায়িক রেজিস্ট্রেশন, ট্যাক্স-ভ্যাট ফাইলিং ইত্যাদি বিষয় গুলোও বেশ চ্যালেঞ্জিং।

আনন্দ বেদনার কাব্য
টিম মেম্বারা যখন তার প্র্রতি আস্থা রেখে কাজ করে। খুশী থাকে। ক্লায়েন্ট তাদের কাজ এ সন্তষ্ট হয়। তখন টিম লিডার হিসাবে রায়হান এর খুব ভালো লাগে। ২০২০ এর দিকে এক ক্লায়েন্ট খুব ভালোবেসে তাকে একটি আইফোন উপহার দেয়। এটাও তার জীবনের আনন্দের ঘটনাগুলোর মধ্যে একটি। টিম মেম্বারা তার প্র্রতি আস্থা হারালে তখন রায়হানের মন খারাপ হয়।
মানবিক রায়হান
রায়হান একজন মানবিক মানুষ। তিনি মানবতার মিশন ফাউন্ডেশন এর ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। ওই সংস্থায় থাকার সময়ে অসহায় মানুষদের জন্য খাদ্য, দরিদ্র শিক্ষার্থীদের জন্য শিক্ষা উপকরণ এবং বৃত্তি, সাধারণ মানুষদেরকে প্রাথমিক স্বাস্থ্য সেবা প্রদান, প্রাকৃতিক পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষার জন্য কয়েক হাজার বৃক্ষ রোপণ সহ নানাবিধ সামাজিক কার্যক্রম এর উদ্যোগ গ্রহণ করেছেন তিনি।
যত পুরুস্কার
পুরুস্কার হলো এক ধরনের স্বীকৃতি। এমন স্বীকৃতি রায়হানের ভাগ্যে অসংখ্যবার জুটেছে। তিনি ব্যাবসা-বাণিজ্য ও সমাজ সেবায় বিশেষ অবদান রাখার জন্য শেরে-বাংলা এ কে ফজলুল হক গবেষণা পরিষদ কতৃক শেরে বাংলা গোল্ডেন অ্যাওয়ার্ড-২০২৪ পেয়েছেন। এছাড়া তিনি আর যে পুরুস্কারগুলো পেয়েছেন তা হলো সামাজিক অবদানের জন্য চ্যাম্পিয়ন অব চেঞ্জ-২০২৩,ইরান কালচারাল সেন্টার কতৃক টপ পারফরমার ২০২৯,শিখবে সবাই থেকে টপ ফ্রিল্যান্সার এওয়ার্ড,ডেফেঅডিল ইন্টারন্যাশনাল ইনস্টিটিউট থেকে টপ আর্টিস্ট এওয়ার্ড ইত্যাদি।
স্বপ্ন ১ কোটি মানুষের কর্মসংস্থান
রায়হানের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা হলো বাংলাদেশের ১ কোটি মানুষের কর্ম সংস্থান এর ব্যবস্থা করা এবং সামাজিক কার্যক্রমগুলোর মাধ্যমে বাংলাদেশকে একটি অর্থনৈতিকভাবে শক্তপোক্ত জাতিতে রূপান্তর করা।