Monday, June 30
Shadow

শিশুদের স্ক্যাবিস: ছোট্ট শরীরের বড় চুলকানি, প্রতিকার ও প্রতিরোধে চাই সচেতনতা

গ্রীষ্মের উষ্ণতা বাড়ার সাথে সাথে শিশুদের ত্বকে দেখা দিচ্ছে এক অনাকাঙ্ক্ষিত অতিথি – স্ক্যাবিস বা খোসপাঁচড়া। ছোট্ট সোনামণিদের সারাদিন হাসি-খেলার বদলে যখন তীব্র চুলকানিতে অস্থির দেখা যায়, তখন বাবা-মায়ের দুশ্চিন্তার শেষ থাকে না। এই ছোঁয়াচে চর্মরোগটি কেবল শারীরিক অস্বস্তিই নয়, শিশুদের মানসিক স্বাস্থ্যের উপরও প্রভাব ফেলে। কিন্তু সঠিক জ্ঞান, সময়োপযোগী পদক্ষেপ এবং সচেতনতাই পারে এই মাইট-বাহিত সংক্রমণ থেকে আমাদের শিশুদের রক্ষা করতে।স্ক্যাবিস: এক অদৃশ্য শত্রুর আনাগোনা

স্ক্যাবিস কোনো সাধারণ চুলকানি নয়। এটি সারকোপ্টেস স্ক্যাবিই (Sarcoptes scabiei) নামক এক ক্ষুদ্র পরজীবী মাইটের কারণে হয়, যা খালি চোখে দেখা যায় না। এই মাইটগুলো শিশুদের নরম ত্বকের উপরের স্তরে গর্ত করে বাসা বাঁধে এবং ডিম পাড়ে। এর প্রতিক্রিয়ায় শরীর চুলকানি এবং ফুসকুড়ি তৈরি করে। শিশুরা যেহেতু খেলাধুলা করে, একে অপরের সংস্পর্শে আসে এবং তাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাও পুরোপুরি বিকশিত হয় না, তাই তারা এই রোগের সহজ শিকার। স্কুল, ডে-কেয়ার বা এমনকি পরিবারের মধ্যেই একজন থেকে অন্যজনে এটি দ্রুত ছড়িয়ে পড়তে পারে।লক্ষণ: যখন চুলকানি অসহনীয় হয়ে ওঠে

স্ক্যাবিসের সবচেয়ে পরিচিত লক্ষণ হলো তীব্র চুলকানি, যা রাতে বিছানায় উষ্ণতার কারণে আরও বেড়ে যায়। শিশুরা ঘুমাতে পারে না, অস্থির হয়ে ওঠে এবং অতিরিক্ত চুলকানোর ফলে ত্বকে লালচে ফুসকুড়ি, ছোট ছোট দানা বা এমনকি ঘাও তৈরি হতে পারে। এই ফুসকুড়িগুলো সাধারণত আঙ্গুলের ফাঁকে, কব্জিতে, বগলে, কোমরে, হাঁটুতে এবং পায়ের তলায় বেশি দেখা যায়। তবে শিশুদের ক্ষেত্রে মুখ, গলা, হাতের তালু ও পায়ের পেছনেও এর লক্ষণ প্রকাশ পেতে পারে। অনেক সময় ত্বকে মাইটের চলাচলের কারণে আঁকাবাঁকা, সুড়ঙ্গের মতো দাগও দেখা যায়। এই লক্ষণগুলো দেখলে দ্রুত চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া জরুরি, কারণ সময়মতো চিকিৎসা না করালে সেকেন্ডারি ব্যাকটেরিয়াল ইনফেকশন হতে পারে।চিকিৎসা: সঠিক পথেই মুক্তি

স্ক্যাবিস নিজে থেকে সেরে যায় না। এর জন্য প্রয়োজন চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী সঠিক চিকিৎসা। সাধারণত, চিকিৎসকরা পারমেথ্রিন (Permethrin) নামক একটি ক্রিম বা লোশন ব্যবহারের পরামর্শ দেন। এটি ঘাড় থেকে নিচে পুরো শরীরে লাগাতে হয় এবং নির্দিষ্ট সময় পর ধুয়ে ফেলতে হয়। অনেক সময় কয়েকদিন পর দ্বিতীয়বার প্রয়োগের প্রয়োজন হতে পারে। কিছু গুরুতর ক্ষেত্রে বা যখন বাহ্যিক চিকিৎসায় কাজ হয় না, তখন মুখে খাওয়ার আইভারমেক্টিন (Ivermectin) ওষুধও ব্যবহার করা হয়, তবে এটি শিশুদের জন্য চিকিৎসকের কঠোর তত্ত্বাবধানেই দেওয়া হয়।চিকিৎসার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো, আক্রান্ত শিশুর পরিবারের সকল সদস্য এবং যারা তার ঘনিষ্ঠ সংস্পর্শে এসেছেন, তাদের সবার একই সময়ে চিকিৎসা গ্রহণ করা। এমনকি যদি তাদের কোনো লক্ষণ নাও থাকে, তবুও চিকিৎসা নেওয়া উচিত। এতে পুনরায় সংক্রমণের ঝুঁকি এড়ানো যায় এবং রোগের বিস্তার রোধ করা সম্ভব হয়।প্রতিরোধ: পরিচ্ছন্নতাই মূলমন্ত্র

স্ক্যাবিস প্রতিরোধে পরিচ্ছন্নতা এবং সচেতনতাই প্রধান হাতিয়ার।

-নিয়মিত পরিচ্ছন্নতা: শিশুদের প্রতিদিন উষ্ণ পানি ও সাবান দিয়ে গোসল করানো উচিত। তাদের নখ ছোট রাখা জরুরি, যাতে চুলকানোর সময় ত্বকে ক্ষত তৈরি না হয় এবং মাইট বা ময়লা জমে না থাকে।

-পোশাক ও বিছানাপত্র: আক্রান্ত শিশুর ব্যবহৃত সকল পোশাক, বিছানার চাদর, বালিশের কভার এবং তোয়ালে গরম পানি দিয়ে ধুয়ে উচ্চ তাপে শুকাতে হবে। যেসব জিনিস ধোয়া সম্ভব নয় (যেমন খেলনা), সেগুলো একটি সিল করা প্লাস্টিক ব্যাগে অন্তত ৭২ ঘণ্টা রেখে দিলে মাইট মারা যায়।

-ব্যক্তিগত জিনিসপত্র: শিশুদের শেখাতে হবে যেন তারা তাদের ব্যক্তিগত তোয়ালে, পোশাক বা অন্যান্য জিনিসপত্র অন্যের সাথে ভাগাভাগি না করে।

-পরিবেশ সচেতনতা: স্কুল, ডে-কেয়ার সেন্টার এবং পরিবারগুলোতে স্ক্যাবিস সম্পর্কে সচেতনতা বাড়ানো প্রয়োজন। কোনো শিশুর মধ্যে লক্ষণ দেখা দিলে দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়া উচিত, যাতে সংক্রমণ অন্য শিশুদের মধ্যে ছড়িয়ে না পড়ে।

-দ্রুত চিকিৎসা: শিশুর মধ্যে স্ক্যাবিসের কোনো লক্ষণ দেখা দিলে দেরি না করে দ্রুত চর্মরোগ বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নেওয়া উচিত। যত দ্রুত চিকিৎসা শুরু হবে, তত দ্রুত শিশু সুস্থ হয়ে উঠবে এবং রোগের বিস্তার রোধ করা যাবে।

স্ক্যাবিস একটি বিরক্তিকর এবং কষ্টদায়ক রোগ হলেও, এটি প্রতিরোধযোগ্য এবং নিরাময়যোগ্য। সঠিক জ্ঞান, সময়োপযোগী চিকিৎসা এবং পরিচ্ছন্নতার অভ্যাস গড়ে তোলার মাধ্যমে আমরা আমাদের শিশুদের এই অদৃশ্য শত্রুর আক্রমণ থেকে রক্ষা করতে পারি। আসুন, সচেতন হই এবং আমাদের সোনামণিদের সুস্থ ও হাসিখুশি শৈশব উপহার দিই।

ডা: রিফাত আল মাজিদ

জনস্বাস্থ্য গবেষক ও চিকিৎসক, 

কমিউনিটি মেডিসিন বিভাগ, 

রাজশাহী মেডিকেল কলেজ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *