Thursday, June 19
Shadow

শাংহাইয়ের নগর পরিকল্পনার মানচিত্র দেখে মুগ্ধ বাংলাদেশের তরুণ প্রতিনিধিদল

জুন ১৭, সিএমজি বাংলা: সরকারি নীতিমালা বাস্তবায়ন ও দূরদর্শী সংস্কার চিন্তার হাত ধরে চাইলেই যে ‘চোখের পলকে’ একটি সাধারণ ভূখণ্ডকে চকচকে বাণিজ্যিক কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত করা যায়, সেটারই জলজ্যান্ত উদাহরণ চীনের শাংহাই। গগনচুম্বি অট্টালিকা, সুনিপুণ নগর ব্যবস্থাপনায় আদর্শ এই মডেল নগরীর শুরুর দিকের পরিকল্পনাটা কেমন ছিল? কী করে একটার পর একটা মাস্টারপ্ল্যানের বাস্তবায়নে জেলেপল্লী হয়ে গেল বিশ্ব-বাণিজ্যের ব্যস্ততম কেন্দ্র—চীন সফরে এসে এবার সেসবই ‘হাতে-কলমে’ দেখেছেন বাংলাদেশ থেকে আসা একঝাঁক তরুণ তুর্কি।

বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, গবেষণাকর্মী, শীর্ষ ছাত্র সংগঠনের নেতা ও সংবাদকর্মীদের সমন্বয়ে ২২ জনের একটি দল গত ১৫ জুন (রোববার) চীনের শাংহাই আরবান প্ল্যানিং এক্সিবিশন সেন্টার পরিদর্শন করেন। এর আগে তারা ১১ জুন কুয়াংচৌ শহরে পৌঁছান। সফরটি আয়োজন করে শাংহাই ইনস্টিটিউট ফর ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজ ও সেন্টার ফর চায়না স্টাডিজ।

পরিদর্শনের সময় নগর পরিকল্পনা প্রদর্শনী কেন্দ্রের বিভিন্ন ফ্লোর ঘুরে দেখেন তরুণ প্রতিনিধিরা। শুরুতেই তারা এক ঝলকে দেখে নেন সুবিশাল ডিসপ্লেতে ১৭ হাজার বর্গকিলোমিটার জুড়ে থাকা শাংহাইয়ের দীর্ঘ সাড়ে ছয় হাজার বছরের ইতিহাস এবং বিভিন্ন সময়ে শাংহাইয়ের জন্য তৈরি করা নগর-পরিকল্পনার মাস্টারপ্ল্যান।

চারটি স্তরে ভাগ করা এই প্রদর্শনী কেন্দ্রের মিনিয়েচার অংশে রয়েছে শাংহাইয়ের বিভিন্ন অঞ্চলের খুদে সংস্করণ। তাতে অগমেন্টেড রিয়েলিটি (এআর) প্রযুক্তি ব্যবহার করে ডিসপ্লেতে দেখানো হয় শাংহাইয়ের নানা রূপ।

ইয়াংজি নদীর অববাহিকায় পরিবেশ ও প্রতিবেশকে সঙ্গী করে শাংহাইয়ের এগিয়ে চলার নানা পরিকল্পনার সঙ্গে বাংলাদেশি তরুণ প্রতিনিধিদলকে পরিচয় করিয়ে দেন কেন্দ্রটির পরিদর্শনের গাইড। এ সময় শাংহাইয়ের উন্নয়নে জনগণের সম্পৃক্ততা ও নগরীর মানবকেন্দ্রিক উন্নয়ন-চিন্তার বিষয়গুলোও তুলে ধরেন তিনি।

এরপর প্রতিনিধিদল উপভোগ করে শাংহাই নগরীর একটি অনবদ্য ভার্চুয়াল ট্যুর। ডিসপ্লে ও উন্নত ক্যামেরা প্রযুক্তিতে দর্শনার্থীরা নিমজ্জিত হয়ে যান শাংহাই নগরীর নদী, সবুজ ও আকাশছোঁয়া ভবনের পাশ দিয়ে যাওয়া পরিকল্পিত সড়কগুলো। সুবিশাল বাঁকানো ডিসপ্লের ওপর দাঁড়াতেই মনে হবে দর্শক নিজেও ডুব দিয়েছেন শাংহাই নগরীর প্রাণকেন্দ্রে।

শাংহাইয়ের মতো এমন নগর পরিকল্পনা প্রদর্শনী কেন্দ্র বাংলাদেশেও করা যেতে পারে বলে সিএমজি বাংলাকে জানিয়েছেন তরুণ প্রতিনিধিদলের টিম লিডার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ম্যানেজমেন্ট ইনফরমেশন সিস্টেমস বিভাগের অধ্যাপক ড. রাকিবুল হক।

অধ্যাপক রাকিবুল হক বলেন, ‘আমরা আমাদের চট্টগ্রাম ও সিলেটে এ ধরনের সেন্টার করতে পারি। এগুলো আমাদের টুরিস্ট জোন এবং এখানে নগর পরিকল্পনা প্রদর্শনী কেন্দ্র নির্মাণ করাও সহজ হবে। ঢাকায় ঘনবসতির কারণে অনেক চ্যালেঞ্জ রয়েছে।’

শাংহাই আরবান প্ল্যানিং এক্সিবিশন সেন্টারের মতো প্রতিষ্ঠান কেন দরকার এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, ‘এ ধরনের কেন্দ্র থাকলে আমরা আমাদের নগরীর বর্তমান চিত্র ও ভবিষ্যতে কী করতে যাচ্ছি সেটা জনগণকে দেখাতে পারব। অন্যরা তখন এটা দেখে যার যার আইডিয়া শেয়ার করতে পারবে। এতে করে আরো বেশি ইন্টারেক্টিভ নগর পরিকল্পনার একটা সম্ভাবনা তৈরি হবে। আর এ ধরনের কেন্দ্রের নির্মাণ পরিকল্পনা নিয়ে নতুন করে ভাবার কিছু নেই। পুরো কাজটা চীন করে দিলে, তাদের গাইডও করতে হবে না। তাদের বিল্ট-ইন টেকনোলজি আমরা নিয়ে আসতে পারি।’

তিনি আরও বলেন, চীনের অর্থায়নে ঢাকায় বর্জ্য ব্যবস্থাপনা, পানির বণ্টন ও পয়োনিষ্কাশন নিয়ে প্রকল্প চলছে। তাই আমাদের নগর পরিকল্পনা নিয়ে কিন্তু তাদের ভালো ধারণা আছে। এসব কাজে তারা যথেষ্ট ভালো ভবিষ্যদ্বাণীও করতে পারবে।

নগর পরিকল্পনা নিয়ে শাংহাইয়ের এমন এক অনবদ্য আয়োজন দেখে তরুণ প্রতিনিধিরাও প্রকাশ করেছেন তাদের মুগ্ধতা।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক এম. আলি সিদ্দিকি জানালেন, ‘শাংহাই প্রশাসন কী করে বাস্তুসংস্থান ও শহুরে জীবনের মধ্যে একটি ভারসাম্য প্রতিষ্ঠা করলো সেটা দেখলাম এখানে। তাছাড়া, নগরীর একটি টেকসই ভবিষ্যতের পাশাপাশি একটি কমিউনিটির প্রয়োজনীয়তা পূরণের আবহ পাওয়া যায় এখানে। ২০৩৫ সাল পর্যন্ত শাংহাই প্রশাসন যে পরিকল্পনা করেছে তা অন্যান্য বড় শহরগুলোর জন্য একটি ভিশন বা নির্দেশনা দিতে পারে।’

ঢাবির অর্গানাইজেশন স্ট্র্যাটেজি অ্যান্ড লিডারশিপ বিভাগের লেকচারার মেহনাজ সাদেক বললেন, ‘শাংহাই একটি রিভার ডেলটা। ভৌগলিকভাবে আমাদের দেশের সঙ্গে মিল আছে। তাই এখানকার নগর পরিকল্পনা সম্পর্কে যদি আমরা এখানে এসে শিখে নিতে পারি, তবে সেটা নিজেদের দেশেও প্রয়োগ করতে পারবো।’

বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদি ছাত্রদলের সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট এ এ এম ইয়াহিয়া জানালেন, ‘শাংহাইয়ের এই ভার্চুয়াল ট্যুর এককথায় ইমপ্রেসিভ। একটি ভবনের ভেতরই গোটা শাংহাই দেখানো হলো।’

বাংলাদেশ ইসলামি ছাত্রশিবিরের সেক্রেটারি জেনারেল নুরুল ইসলাম। তিনি জানালেন, ‘আমরা দেখেছি চীন সরকার কী করে শাংহাইকে একদম নতুন করে সাজিয়েছে। পরিচ্ছন্ন একটা নগরী গড়ে তোলার জন্য যে ধরনের পরিকল্পনা দরকার এবং টেকসই কৌশলে সে কাজগুলো এগিয়ে নেওয়া দরকার, সেগুলো চীন খুব কৌশলে ও দক্ষতার সঙ্গে করেছে। এ পরিকল্পনার প্রতিটি অংশ দেখে আমরা আসলেই মুগ্ধ।’

অন্যদিকে ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় কমিটির জয়েন্ট সেক্রেটারি মো. রাসেল মিয়ার মতে, বাংলাদেশের সঙ্গে এ ধরনের প্রদর্শনী ও কৌশলের বিনিময় বেশি দরকার। এতে করে আমাদের নগরবিদরাও আরও আইডিয়া পাবেন। তিনি জানালেন, ‘এই প্রতিনিধিদলকে শাংহাই কর্তৃপক্ষ যে পুরো নগর পরিকল্পনার আদ্যপান্ত দেখালো, এটাও কিন্তু এক ধরনের বিনিময়। তারা মূলত দেখাতে চাইলো যে, একটি সুন্দর পরিকল্পনা থাকলে একটি নদী ব্যবহার করেও উন্নত শহর গড়ে তোলা যায়।’

বাংলাদেশের তরুণ নেতৃত্বে সমৃদ্ধ নতুন রাজনৈতিক দল ন্যাশনাল সিটিজেন পার্টির (এনসিপি) যুগ্ম মূখ্য সংগঠক (উত্তরাঞ্চল) মো. আসাদুল্লাহ আল গালিফ জানালেন, ‘একটা দেশ আসলে কতটা আধুনিক চিন্তা করতে পারে, সেটা এখানে আসলেই বোঝা যায়। চীন আজ থেকে ৩০-৪০ বছর আগে যে পরিকল্পনা করেছিল, সেগুলো এখন দৃশ্যমান। আমার কাছে মনে হয়, আমরা যদি এরকম করে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা করে এগোতে পারি, তবে আমাদের পক্ষেও বাংলাদেশকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া সম্ভব।’

ইউনাইটেড পিপলস বাংলাদেশ-এর কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য দেলোয়ার হাসান শিশির জানালেন, ‘একটি গ্রামকে শূন্য থেকে যে কোথায় নিয়ে যাওয়া যায় সেটাই আমরা চীনের এই প্রদর্শনীতে দেখলাম। আমার তো মনে হচ্ছে, কখন দেশে ফিরে এমন কিছু নিয়ে কাজ শুরু করবো। আমার অনুধাবনটা হলো, তরুণদের মধ্যে যারা এখন রাজনীতি করতে চায়, তাদের সারা বিশ্বের এসব অগ্রগতির গল্পগুলো জানতে হবে, এর জন্য প্রচুর পড়তেও হবে।’

তাই, শাংহাইয়ের এই রূপান্তর শুধু চীনের অর্থনৈতিক অগ্রগতির দৃষ্টান্তই নয়, বরং এটি দূরদর্শী পরিকল্পনা, সুদৃঢ় রাজনৈতিক সদিচ্ছা এবং নিরলস বাস্তবায়নের এক উজ্জ্বল উদাহরণ। বাংলাদেশের তরুণ প্রতিনিধি দলের এই সফর নিঃসন্দেহে দেশের ভবিষ্যৎ নীতি নির্ধারক ও নগর পরিকল্পনাবিদদের জন্য শাংহাইকে একটি অনুকরণীয় মডেল হিসেবে উপস্থাপন করবে, যা ভবিষ্যতে বাংলাদেশের নগর উন্নয়নে নতুন দিনের সূচনা করবে।

এই তরুণ প্রতিনিধি দলে বাংলাদেশের বিভিন্ন ক্ষেত্রের বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ এবং তরুণ নেতারা অন্তর্ভুক্ত রয়েছেন। দলে রয়েছেন, অধ্যাপক মো. রাকিবুল হক (গ্রুপ লিডার ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক), সহকারী অধ্যাপক এম. আলী সিদ্দিকী (ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়), এ. এ. এম. ইয়াহিয়া (জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট), শেখ মাহবুবুর রহমান নাহিয়ান (ইসলামী ছাত্র আন্দোলন বাংলাদেশ-এর সেক্রেটারি জেনারেল), নুরুল ইসলাম (বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির-এর সেক্রেটারি জেনারেল), তাওসিফ এহসান (ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রভাষক), মেহনাজ সাদিক (ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রভাষক), মো. রাসেল মিয়া (বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল-এর যুগ্ম সম্পাদক), ফয়সাল আবদুল্লাহ (চায়না মিডিয়া গ্রুপ-এর ফিচার এডিটর), দেলোয়ার হাসান (ইউনাইটেড পিপলস বাংলাদেশ-এর কেন্দ্রীয় সদস্য), মো. আসাদুল্লাহ আল গালিব (ন্যাশনাল সিটিজেন পার্টি-এর উত্তরাঞ্চলীয় যুগ্ম প্রধান সংগঠক), মো. আব্বাস (ডেইলি স্টার-এর প্রতিবেদক), আব্দুল করিম (নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রভাষক), সাজ্জাদুল করিম (নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রভাষক), মো. নাসিমুল হুদা (বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থা (বাসস)-এর এডিটিং অ্যাসোসিয়েট), নুর আহমেদ (বিআইআইএসএস-এর গবেষণা কর্মকর্তা), প্রীতিলতা খন্দকার হক (সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ-এর প্রোগ্রাম অ্যাসোসিয়েট), মো. সাইফুল ইসলাম (দ্য ডেইলি ক্যাম্পাস-এর সহ-প্রতিষ্ঠাতা), প্রমি দেওয়ান (সবুজ খাম-এর সহ-প্রতিষ্ঠাতা), মো. সাইফুল ইসলাম (বাংলাদেশ ডেমোক্রেটিক স্টুডেন্ট কাউন্সিল-এর যুগ্ম আহ্বায়ক), মো. মাহবুব আলম (ন্যাশনাল সিটিজেন পার্টি-এর যুগ্ম আহ্বায়ক), মো. সাইব (সাইনো-বাংলা ইমপ্যাক্ট-এর গবেষণা ও প্রকাশনা সম্পাদক)।

শাংহাই থেকে ফয়সল আবদুল্লাহ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *