
বহুবিবাহ বা একাধিক স্ত্রী রাখা বিষয়ে ইসলামি শরিয়তে একটি সুস্পষ্ট অবস্থান রয়েছে। তবে এই বিষয়ে অনেকেই বিভ্রান্ত হন—ইসলাম কি একাধিক বিবাহকে উৎসাহ দেয়, না কি এটি নির্দিষ্ট পরিস্থিতির জন্য একটি ব্যতিক্রমী অনুমতি? চলুন, কোরআন ও সহিহ হাদিসের আলোকে সহজ ভাষায় বিষয়টি বিশ্লেষণ করা যাক।
কোরআনে বহুবিবাহের অনুমতির মূল আয়াত হলো:
“আর যদি তোমরা আশঙ্কা কর যে, এতিমদের ব্যাপারে ইনসাফ করতে পারবে না, তাহলে যাদেরকে ভালো লাগে, তাদের মধ্যে থেকে দুই, তিন বা চারজনকে বিয়ে করো। আর যদি আশঙ্কা করো যে, তাদের মধ্যে ইনসাফ করতে পারবে না, তাহলে একজনকেই (বিয়ে করো)…”— সূরা আন-নিসা: আয়াত ৩। এই আয়াতে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআ’লা স্পষ্ট করে দিয়েছেন— একাধিক (সর্বোচ্চ চার) স্ত্রী রাখার অনুমতি রয়েছে, কিন্তু এটি শর্তসাপেক্ষ। মূল শর্ত: সব স্ত্রীর প্রতি ন্যায়বিচার করা। অন্যথায়, একজনকেই বিয়ের পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।
আল্লাহ নিজেই কোরআনের অন্য আয়াতে বলেছেন:
“তোমরা যতই চাও না কেন, স্ত্রীদের মধ্যে সম্পূর্ণ ন্যায়বিচার করতে কখনোই সক্ষম হবে না।”
— সূরা আন-নিসা: আয়াত ১২৯
এই আয়াত ইঙ্গিত দেয়, একাধিক স্ত্রীর মধ্যে পূর্ণ সমতা রক্ষা অত্যন্ত কঠিন কাজ। তাই এমন বিয়ে করতে হলে একজন পুরুষকে হতে হবে অত্যন্ত দায়িত্ববান ও আত্মনিয়ন্ত্রণে সক্ষম।
বহুবিবাহ নবী করিম (সা.)-এর জীবনে একটি বাস্তবতা ছিল, তবে তিনি কখনো এটিকে সাধারণ মুসলমানদের জন্য উৎসাহব্যঞ্জক উপায়ে উপস্থাপন করেননি। বরং তাঁর জীবনের বেশ কিছু হাদিস আমাদের এই বিষয়ে সাবধান করে:
এক সাহাবি বললেন, “আমি সব স্ত্রীদের প্রতি সমান আচরণ করি।” তখন রাসুল (সা.) বললেন: “যে ব্যক্তি দুই স্ত্রী রাখে এবং তাদের মধ্যে একটির প্রতি পক্ষপাত করে, কিয়ামতের দিন সে এমন অবস্থায় আসবে যে, তার একটি দিক হবে অবশ।” — তিরমিযী, হাদিস: ১১৪১
আরেক হাদিসে তিনি বলেন: “দুনিয়ার সকল জিনিসই ভোগ করার উপযোগী। কিন্তু সবচেয়ে উত্তম সম্পদ হচ্ছে ধার্মিক স্ত্রী।” — সহিহ মুসলিম, হাদিস: ১৪৬৭
এতে বোঝা যায়, ইসলামের মূল লক্ষ্য একটি সুস্থ, শান্তিপূর্ণ, দায়িত্বশীল পারিবারিক জীবন নিশ্চিত করা।
নবী করিম (সা.)-এর অধিকাংশ বিবাহ ছিল সামাজিক, রাজনৈতিক এবং মানবিক উদ্দেশ্যে। যেমন: বিধবা নারীদের আশ্রয় দেওয়া (উম্মে সালমা, সাওদা), যুদ্ধবিধ্বস্ত পরিবারকে সহায়তা (জয়নাব বিনতে জাহশ), বিভিন্ন গোত্রের সঙ্গে সম্পর্ক জোরদার করা (জুহাইনা, মাকজুন, ইত্যাদি গোত্র)। কোনোটিই কেবল ব্যক্তিগত চাহিদা পূরণের জন্য ছিল না।
ইসলাম একাধিক বিয়েকে মূল উৎসাহপ্রদ কাজ হিসেবে উপস্থাপন করে না। বরং: এটি নিয়ন্ত্রিত ও শর্তযুক্ত অনুমতি, ব্যতিক্রমী বা বিশেষ পরিস্থিতির জন্য উপায় হিসেবে বিবেচিত।
ইসলাম বিবাহে দায়িত্ব, ন্যায়বিচার, ও ত্যাগকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেয়। তাই কাউকে বহুবিবাহ করতে হলে তাঁকে হতে হবে অত্যন্ত ন্যায়পরায়ণ, দৃঢ়চেতা ও আত্মসংযমী।
বর্তমান সমাজে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই একাধিক বিয়ে করতে গিয়ে দেখা যায়: স্ত্রীর অধিকার ক্ষুণ্ন হয়, পরিবারে অশান্তি ছড়ায়, ন্যায়বিচার হয় না।
তাই বর্তমান সময়ে একাধিক বিয়ের অনুমতি থাকলেও, তা ব্যবহার করা উচিত অনেক ভেবে-চিন্তে, দ্বীন ও দুনিয়ার ভারসাম্য বুঝে।
ইসলাম একাধিক বিবাহকে নিষিদ্ধ করেনি, তবে এটি কখনোই বাধ্যতামূলক বা অধিক উৎসাহিত বিষয় নয়। বরং, এটি বিশেষ পরিস্থিতির জন্য বৈধ করা হয়েছে, ন্যায়বিচার ও দায়িত্ব পালনের কঠিন শর্তসহ। যারা এটি করবেন, তাঁদের জন্য রয়েছে ভয়াবহ জবাবদিহির আশঙ্কা।
তাই বলা যায়—ইসলামে একাধিক বিবাহ একটি ব্যতিক্রমী অনুমতি, নিয়ম বা আদর্শ নয়।