
দেশে চলমান মূল্যস্ফীতি ও আর্থিক চাপে পড়া সাধারণ মানুষের আয়-ব্যয়ের ভারসাম্য অনেকটাই নষ্ট হয়ে গেছে। এর প্রভাব পড়েছে জাতীয় সঞ্চয়পত্রের বিক্রিতেও। আগের মতো মানুষ আর সঞ্চয়পত্রে আগ্রহ দেখাচ্ছে না। বরং আগের কেনা সঞ্চয়পত্র ভেঙে ফেলছেন অনেকেই। যার ফলে এ খাতে নেতিবাচক প্রবৃদ্ধি দেখা দিয়েছে—অর্থাৎ নতুন বিক্রি কম, বরং ভাঙানো বাড়ছে।
সরকারের জন্য এটি একটি বড় আর্থিক চাপ হয়ে দাঁড়িয়েছে। কারণ, নতুন বিক্রির চেয়ে বেশি সুদ ও আসল পরিশোধ করতে হচ্ছে।
ব্যাংক ও ট্রেজারি বন্ডে সুদের হার আগের তুলনায় বেড়েছে। ফলে সঞ্চয়পত্রের চেয়ে এখন অনেকেই ব্যাংক বা সরকারি বন্ডে বিনিয়োগকে নিরাপদ ও লাভজনক মনে করছেন। বর্তমানে এক বছর মেয়াদি ট্রেজারি বিলের সুদের হার প্রায় ১১.৬০ শতাংশ। ব্যাংকের অনেক আমানত হিসাবেও ১০ শতাংশ বা তার বেশি সুদ পাওয়া যাচ্ছে। এসব কারণেই সঞ্চয়পত্র থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন অনেক গ্রাহক।
সোনালী ব্যাংকের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, “সঞ্চয়পত্রে আগে যে আস্থা ছিল, এখন তার বড় অংশটাই ব্যাংকের দিকে ফিরে গেছে। সেখান থেকে ভালো রিটার্নও পাওয়া যাচ্ছে।”
ব্যাংকাররা বলছেন, মানুষের হাতে আগে যেমন বাড়তি টাকা থাকত, এখন তা নেই। জীবনযাত্রার খরচ বেড়ে যাওয়ায় সঞ্চয়ের সুযোগ কমে গেছে। অনেকে সংসারের খরচ চালাতেই আগের সঞ্চয়পত্র ভাঙছেন। কেউ আবার মেয়ের বিয়ে বা ছেলেকে বিদেশে পাঠানোর খরচ জোগাতে ভাঙছেন সঞ্চয়পত্র।
একজন গ্রাহক বলেন, “আগে মেয়াদ শেষ হলে আবারও সঞ্চয়পত্র কিনতাম। এখন প্রয়োজনেই ভাঙতে হচ্ছে। নতুন করে কেনা সম্ভব হচ্ছে না।”
জাতীয় সঞ্চয় অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রথম সাত মাসে (জুলাই-জানুয়ারি) সঞ্চয়পত্র বিক্রি হয়েছে ৩৬ হাজার ৪৬৩ কোটি টাকার। অথচ একই সময়ে ভাঙানো হয়েছে ৪৩ হাজার ৪৭৬ কোটি টাকার সঞ্চয়পত্র। অর্থাৎ ৭ হাজার ১৩ কোটি টাকা বেশি পরিশোধ করতে হয়েছে সরকারকে।
গত ২০২৩-২৪ অর্থবছরেও সঞ্চয়পত্র খাতে একই রকম চিত্র দেখা গেছে। বিক্রির তুলনায় ৭ হাজার ৩৫০ কোটি টাকা বেশি সুদ ও আসল পরিশোধ করতে হয়েছে সরকারকে। এতে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে, এই খাত থেকে সরকারের প্রকৃত ঋণ সংগ্রহের সুযোগ কমে গেছে।
সরকার এ কারণে চলতি অর্থবছরে সঞ্চয়পত্র বিক্রির লক্ষ্যমাত্রাও কমিয়ে এনেছে। ২০২৩-২৪ সালে যেখানে নিট ঋণ সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ১৮ হাজার কোটি টাকা, ২০২৪-২৫ সালে তা কমিয়ে ১৫ হাজার ৪০০ কোটি টাকায় আনা হয়েছে।
অর্থনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, দীর্ঘমেয়াদে সরকারের জন্য সঞ্চয়পত্রে উচ্চ সুদ দিয়ে টাকা ধার করা অর্থনীতির ওপর চাপ তৈরি করে। একজন বিশ্লেষক বলেন, “সঞ্চয়পত্রের মাধ্যমে সঞ্চয় বাড়ানো একটা সময়ের জন্য হতে পারে, তবে দীর্ঘমেয়াদে এটি সরকারের ঋণ ভার বাড়ায়। তার চেয়ে ভালো বিকল্প হলো পুঁজিবাজার বা ব্যাংকের মাধ্যমে বেসরকারি খাতে বিনিয়োগের সুযোগ তৈরি করা।”
বর্তমানে অনেকেই লাভের জন্য বিকল্প খুঁজছেন। ব্যাংক ও বন্ডের পাশাপাশি স্বর্ণেও বিনিয়োগ করছেন অনেকে। একজন গ্রাহক বলেন, “স্বর্ণের দাম প্রতিদিন বাড়ছে। তাই গহনা তৈরি করেই বিনিয়োগ করছি। প্রয়োজনে ব্যবহারও করা যায়, আবার ভবিষ্যতে দামও বাড়ে।”
বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র আরিফ হোসেন খান বলেন, “অনেকে এখন বন্ড, ট্রেজারি বিল কিংবা ব্যাংকের আমানতে টাকা রাখছেন। কারণ এগুলোর সুদহার ভালো। সঞ্চয়পত্রের কিছু সীমাবদ্ধতা আছে যেমন মেয়াদ পূর্ণ হওয়ার আগে ভাঙানো কঠিন, সেই তুলনায় ব্যাংকে নমনীয়তা বেশি।”
দেশের সঞ্চয় সংস্কৃতিতে যে পরিবর্তন এসেছে, তা মূল্যস্ফীতি, মানুষের আর্থিক সক্ষমতা কমে যাওয়া এবং লাভজনক বিকল্প বিনিয়োগের সন্ধান—সব মিলিয়ে যৌথভাবে দায়ী। সরকার ও নীতিনির্ধারকদের এখন ভাবতে হবে—কীভাবে জনগণকে পুঁজি গঠনের নিরাপদ ও লাভজনক উপায় দেখানো যায়, যাতে সঞ্চয়ও হয়, বিনিয়োগও হয়, আবার সরকারের ওপরও বাড়তি চাপ না পড়ে।