
অভ্যুত্থানের নয় মাস পেরিয়ে গেলেও বাংলাদেশ এখনও কাঙ্ক্ষিত রাজনৈতিক ও প্রাতিষ্ঠানিক পরিবর্তনের কাছাকাছি পৌঁছাতে পারেনি। শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের অধীনে সংস্কার প্রক্রিয়া শুরু হলেও নানাবিধ জটিলতা ও মতবিরোধের কারণে সেই অগ্রগতি বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। নির্বাচন, বিচারব্যবস্থা এবং সংবিধান সংস্কারের জন্য গঠিত একাধিক কমিশন কাজ চালিয়ে গেলেও জাতীয় ঐকমত্য প্রতিষ্ঠা এখনও দুষ্কর হয়ে আছে।
শেখ হাসিনার শাসনামলের নিপীড়ন ও দমন-পীড়নের পুনরাবৃত্তি রোধ করতে রাজনৈতিক বিভাজন ভুলে সব দলের পক্ষ থেকেই গণতান্ত্রিক সংস্কারের দাবি ক্রমশ জোরালো হয়ে উঠছে। তবে বাস্তবতায়, অভ্যুত্থানের নয় মাস পরও কাঙ্ক্ষিত পরিবর্তন অধরাই রয়ে গেছে। সম্প্রতি বৃটেনের প্রভাবশালী সাময়িকী দ্য ইকোনমিস্ট এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছে, রাজনৈতিক সংস্কার প্রক্রিয়া শুরু হলেও কাঙ্ক্ষিত সফলতা এখনও দৃশ্যমান নয়।
২০২৪ সালের আগস্টে গণ-অভ্যুত্থানের মাধ্যমে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব নেন নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ ড. মুহাম্মদ ইউনূস। ক্ষমতা গ্রহণের পর তিনি উল্লেখ করেন, ‘যা কিছু ধ্বংস হয়েছে, আমরা তা ঠিক করার চেষ্টা করছি। আমরা সঠিক পথে এগোচ্ছি, জনগণ আমাদের সঙ্গে আছে। আমরা আশাবাদী।’
ড. ইউনূসের নেতৃত্বে নতুন সরকারের প্রথম পদক্ষেপ ছিল নির্বাচন, বিচারব্যবস্থা ও সংবিধান সংস্কারের জন্য একাধিক কমিশন গঠন করা। এসব কমিশনে সুশীল সমাজ ও শিক্ষাবিদদের অন্তর্ভুক্ত করা হয়, যাতে স্বচ্ছ ও গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া নিশ্চিত হয়। এ কমিশনের সুপারিশগুলো পর্যালোচনা ও সমন্বয়ের জন্য একটি পৃথক সংস্থা ‘জাতীয় ঐকমত্য কমিশন’ গঠন করা হয়েছে।
জাতীয় ঐকমত্য কমিশন ইতোমধ্যে ১৬৬টি প্রস্তাব একত্রিত করে একটি স্প্রেডশিটে তালিকাভুক্ত করেছে। এসব প্রস্তাব নিয়ে ৩৫টি রাজনৈতিক দল তাদের মতামত জানিয়েছে। কমিশন এখন যৌথভাবে একটি ‘জুলাই সনদ’ প্রণয়নের কাজ করছে, যা আগামী নির্বাচনের পথ সুগম করবে এবং ‘নতুন বাংলাদেশের’ সূচনা করবে বলে আশা করা হচ্ছে।
তবে প্রস্তাবগুলোর বিষয়ে ঐকমত্যে পৌঁছানো সহজ হচ্ছে না। কমিশনের কার্যক্রম শুরুর পর থেকেই রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে মতবিরোধ স্পষ্ট। বিশেষ করে কোন কোন ক্ষেত্রে কমিশন থাকা উচিত সে বিষয়ে দলে দলে মতপার্থক্য রয়েছে। কেউ কেউ বলছে, বাংলাদেশের অর্থনীতির মূল চালিকা শক্তি তৈরি পোশাক খাতকে উপেক্ষা করা হয়েছে। অন্যদিকে, শিক্ষাখাতেও সংস্কার প্রস্তাব যথাযথভাবে অন্তর্ভুক্ত হয়নি বলে সমালোচনা রয়েছে।
সবচেয়ে বেশি বিতর্ক সৃষ্টি করেছে নারী সংস্কার কমিশনের সুপারিশ। ইসলামী উত্তরাধিকার আইনে পরিবর্তন এনে নারীদের অধিক অধিকার দেওয়ার প্রস্তাব রাখা হয়েছে, যা ইসলামপন্থি দলগুলোর তীব্র বিরোধিতার মুখে পড়েছে। তাদের মতে, এই পরিবর্তন ধর্মীয় বিধানের সাথে সাংঘর্ষিক। ফলে এই কমিশনের কাজ শুরু হওয়া থেকেই রাজনৈতিক অঙ্গনে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে।
জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সহ-সভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ জানান, ১৫ মে’র পর সংলাপের দ্বিতীয় ধাপ শুরু হবে। আগস্টের মধ্যেই একটি চূড়ান্ত সনদ প্রণয়ন সম্ভব হবে বলে তিনি আশাবাদী। এই পরিকল্পনা অনুযায়ী অগ্রগতি হলে চলতি বছরের ডিসেম্বরেই নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
ড. ইউনূসও জোর দিয়ে বলেছেন, ২০২৬ সালের জুনের পরে নির্বাচন কোনোভাবেই পেছানো হবে না এবং তিনি নিজে সেই নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবেন না। তবে সংস্কার প্রক্রিয়ার বিলম্ব ইতোমধ্যে কিছু মূল্য চাপিয়ে দিচ্ছে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার মূল্যস্ফীতি ও ব্যাংক খাত স্থিতিশীল করতে সক্ষম হলেও অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি এখনো দুর্বল।
এক জরিপে দেখা গেছে, জনগণের প্রায় ৬০ শতাংশ মনে করে, সরকার পরিবর্তনের পরও আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির তেমন উন্নতি হয়নি। রাস্তায় বিক্ষোভ নিত্যদিনের চিত্র হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিক্ষোভকারীদের মূল দাবি হলো, আওয়ামী লীগের বিচারের মুখোমুখি হওয়া।
গত ১২ মে নির্বাচন কমিশন আওয়ামী লীগের নিবন্ধন বাতিল করেছে। ফলে দলটি আর কোনো নির্বাচনে অংশ নিতে পারবে না। যদিও দলটির বিরুদ্ধে ব্যাপক ক্ষোভ ও ঘৃণা রয়েছে, তবু একটি ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠী এখনো তাদের প্রতি সমর্থন জানিয়ে যাচ্ছে। দলের জ্যেষ্ঠ নেতা মোহাম্মদ আরাফাত দাবি করেছেন, ‘আওয়ামী লীগ ছিল জনগণের ম্যান্ডেটপ্রাপ্ত সরকার। জিহাদিরা সহিংস উপায়ে তাদের ক্ষমতাচ্যুত করেছে। আওয়ামী লীগ আবারও বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে ফিরে আসবে।’
ক্ষমতার বাইরে থাকলেও রাজনৈতিক অঙ্গনে আওয়ামী লীগ এখনো অস্থিরতা সৃষ্টি করতে সক্ষম বলে ধারণা করছেন বিশ্লেষকরা।