
ঈদ সামনে রেখে বাড়ছে চাহিদা, প্রাকৃতিক পদ্ধতিতে স্বাস্থ্যবান পশু উৎপাদনে সফল খামারিরা
আসন্ন ঈদ-উল-আযহাকে সামনে রেখে রাজশাহীর বিভিন্ন গ্রামে গরু মোটাতাজাকরণ কার্যক্রম আবারও প্রাণবন্ত হয়ে উঠেছে। কাঙ্ক্ষিত লাভের প্রত্যাশায় গ্রামের মানুষরা পুরোদমে নেমেছেন এই কার্যক্রমে, যা তাদের ভাগ্য উন্নয়নের দিকেও ইতিবাচক প্রভাব ফেলছে।
গত কয়েক দশক ধরে পশুসম্পদ সমৃদ্ধ করার মাধ্যমে গ্রামীণ মানুষের জীবনযাত্রার মান উন্নয়নে এই গরু মোটাতাজাকরণ কার্যক্রম অসামান্য অবদান রেখে চলেছে। স্থানীয় চাহিদা পূরণের পর এই ব্যবসা দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে গরু সরবরাহের নতুন সম্ভাবনা তৈরি করেছে। পাশাপাশি দেশীয় গবাদিপশুর উৎপাদন বৃদ্ধির মাধ্যমে এই অঞ্চল গবাদি পশু উৎপাদনে অনেকটাই স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়ে উঠেছে।
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে দেশের বিভিন্ন পশুর হাটে দেশীয় গরুর প্রতি ক্রেতাদের আগ্রহ বেড়েছে। রাজশাহীতেও এর ব্যতিক্রম নয়।
প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের বিভাগীয় পরিচালক ড. আনন্দ কুমার অধিকারী বার্তা সংস্থা বাসস-কে জানান, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে স্থানীয় পশুপালন খাতে যে বৈপ্লবিক অগ্রগতি হয়েছে, তা এই অঞ্চলের শত শত মানুষের ভাগ্য পরিবর্তনে ভূমিকা রেখেছে। তিনি বলেন, “গ্রামীণ পরিবারগুলোর অনেকেই এখন বাণিজ্যিকভাবে ষাঁড় পালন ও মোটাতাজাকরণ করে প্রতি বছর বিপুল মুনাফা অর্জন করছে। নারীসহ কিছু দরিদ্র ও প্রান্তিক মানুষ এই খাতে অসাধারণ সাফল্য অর্জন করেছে।”
এই অগ্রগতির কারণে বর্তমানে গরুর বাজারে অভাবনীয় হারে গৃহপালিত পশুর সরবরাহ দেখা যাচ্ছে। একই সঙ্গে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক গ্রামবাসীকে প্রাকৃতিক উপায়ে ষাঁড় মোটাতাজাকরণ করতে দেখা গেছে। তারা এখন স্টেরয়েড বা ইনজেকশনের পরিবর্তে খড়, গুড়, খইল, ছোলা, কালো ছোলা, সবুজ ঘাস এবং গমের ভুসি ব্যবহার করছেন।
রাজশাহীর চারঘাট উপজেলার হালিদাগাছি গ্রামের ৪৫ বছর বয়সী মাবিয়া খাতুন বলেন, “আমি নিজে নিজে খড়, ঘাস ও অন্যান্য গরুর খাবার তৈরি করি।” তার প্রতিবেশী ৫৩ বছর বয়সী আবদুস সাত্তার জানান, এলাকায় অন্তত ৪৩টি পরিবার লাভজনক কোরবানির গরুর বাজার ধরার জন্য গরু মোটাতাজা করছে। তিনি বলেন, “আমরা ষাঁড় মোটাতাজা করার জন্য গ্রামে একটি উপার্জনশীল পরিবেশ দেখতে পাচ্ছি।”
এখনকার গ্রামবাসীরা তাদের ঐতিহ্যবাহী গার্হস্থ্য গরু পালন পদ্ধতিকে আধুনিক ও বাণিজ্যিক পদ্ধতিতে রূপান্তর করেছেন। পাশাপাশি তারা ব্যাংক থেকে গরু কেনার জন্য ঋণ নিচ্ছেন এবং যথাসময়ে তা পরিশোধও করছেন।
রাজশাহীর দুর্গাপুর ও পুঠিয়া উপজেলায় বর্তমানে ২৫০টিরও বেশি গরু মোটাতাজাকরণ খামার রয়েছে। এসব খামারে প্রাকৃতিক পদ্ধতিতে প্রায় ১০ হাজার ষাঁড় মোটাতাজা করা হচ্ছে। একইসঙ্গে গ্রামবাসীরা স্বাস্থ্যকর উপায়ে ২৫ হাজারেরও বেশি ছাগল পালন করছেন।
ডা. আনন্দ অধিকারী এই পদ্ধতিকে জনস্বাস্থ্যের জন্য ইতিবাচক বলে অভিহিত করে বলেন, প্রাণিসম্পদ বিভাগ কৃষকদের এই কার্যক্রমে প্রয়োজনীয় সহায়তা প্রদান করে আসছে। তিনি বলেন, “আমরা কোরবানির মৌসুমে তাৎক্ষণিক লাভের জন্য হরমোন ও স্টেরয়েডসহ ক্ষতিকর ওষুধ ব্যবহার করে গরু মোটাতাজাকরণে খামারিদের নিরুৎসাহিত করছি।”
নন্দীগ্রামের একটি ষাঁড় মোটাতাজাকরণ খামারের মালিক তোজাম্মেল হক জানান, কৃষকরা বর্তমানে নতুন, উন্নত পদ্ধতি ও প্রযুক্তি গ্রহণ করছেন, যা উৎপাদন ও উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধিতে অবদান রাখছে।
বড় ও ছোট বেসরকারি কোম্পানিগুলোর সক্রিয় ভূমিকার কারণে বাজারের আকারও ক্রমশ সম্প্রসারিত হচ্ছে। এই সংস্থাগুলোর সহায়তায় মাঠপর্যায়ের লাইন এজেন্সিগুলো এখন স্থানীয় পরিষেবা প্রদানকারীদের (এলএসপিএস) সক্রিয়ভাবে সহায়তা করছে।
এই এলএসপিএস-রা প্রতি মাসে গড়ে ৪ হাজার ৫০০ টাকা আয় করে থাকেন। তারা উৎপাদকদের প্রশিক্ষণ, পরামর্শ ও ইনপুট প্রদান করে এবং নিয়মিতভাবে প্রদর্শনীর মাধ্যমে নতুন প্রযুক্তি পৌঁছে দিচ্ছেন খামারিদের দ্বারপ্রান্তে।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের পশুচিকিৎসা ও প্রাণিবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক জালাল উদ্দিন সরদার বলেন, “রাজশাহীতে গরু মোটাতাজাকরণের উদ্যোগ সফল প্রমাণিত হয়েছে, যা গ্রামীণ জীবিকা ও স্থানীয় অর্থনীতির উন্নয়নে বড় ভূমিকা রেখেছে।” তিনি আরও বলেন, “প্রান্তিক পুরুষ ও নারীসহ অনেক কৃষক এটিকে একটি লাভজনক ও টেকসই আয়ের উৎসে পরিণত করেছে। প্রাণিসম্পদ বিভাগের মতো সংস্থাগুলোর আধুনিক প্রযুক্তি, প্রশিক্ষণ ও সহায়তার মাধ্যমে এই পথ চলা আরও সহজতর হয়েছে।”