Wednesday, May 7
Shadow

ভুট্টার শিষে সোনালি স্বপ্ন: টাঙ্গাইলে আশাব্যঞ্জক ফলনে উচ্ছ্বসিত কৃষকরা

সরকারি সহায়তা, অনুকূল আবহাওয়া ও আধুনিক প্রযুক্তিতে চাষ বেড়েছে লক্ষ্যমাত্রার চেয়েও বেশি

টাঙ্গাইলের যমুনার চরাঞ্চল জুড়ে এখন শুধু সোনালি শিষের ভুট্টা আর কৃষকের মুখে হাসি। চলতি রবি মৌসুমে আশাতীত ফলন আর সরকারি প্রণোদনায় টাঙ্গাইলের ভুট্টা চাষিরা স্বপ্ন দেখছেন সোনালি দিনের। জেলার লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে বেশি জমিতে চাষ, আধুনিক কৃষি প্রযুক্তির ব্যবহার এবং আবহাওয়ার অনুকূলতা—সব মিলিয়ে এই মৌসুমে জেলার ভুট্টা চাষে এসেছে অভাবনীয় সাফল্য।

সরেজমিনে দেখা যায়, জেলার যমুনার চরাঞ্চলের বিস্তীর্ণ এলাকায় ব্যাপক হারে ভুট্টার আবাদ হয়েছে। কৃষকরাও অধীর আগ্রহে জমিতে ভুট্টা চাষ করছেন, কারণ তারা জানেন, এবারকার ফলন তাদের জীবনে সুখের সুবাতাস বয়ে আনবে।

জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, জেলার ১২টি উপজেলায় চলতি রবি মৌসুমে ভুট্টা আবাদের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৭ হাজার ৮০০ হেক্টর জমি। অথচ বাস্তবে আবাদ হয়েছে ৮ হাজার ৮১৫ হেক্টরে—লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ১ হাজার ২৫১ হেক্টর বেশি।

বিশেষ করে জেলার চরাঞ্চলের প্রান্তিক কৃষকরা গত কয়েক বছর ধরে আগাম জাতের হাইব্রিড ভুট্টা চাষ করে লাভবান হচ্ছেন। চরাঞ্চলে অন্যান্য ফসলের তুলনায় ভুট্টা চাষ বেশি হচ্ছে, কারণ এতে কম খরচে বেশি লাভ হয়। ফলে দিন দিন এই চাষে কৃষকদের আগ্রহ বাড়ছে।

কৃষকদের ভাষ্যমতে, বর্তমানে গমের পাশাপাশি ভুট্টার ব্যবহারও অনেক বেড়েছে। এটি গো-খাদ্য ও পোলট্রি ফিড হিসেবেও ব্যবহৃত হয়। যেখানে প্রতি বিঘা জমিতে ধানের ফলন হয় ১৫-১৬ মণ, সেখানে ভুট্টা উৎপাদন হয় ৪০ থেকে ৪৫ মণ। বিঘা প্রতি আট থেকে দশ হাজার টাকা খরচ করেই কৃষকরা ৩০ থেকে ৫০ হাজার টাকার ভুট্টা বিক্রি করতে পারেন।

ভূঞাপুর উপজেলার গাবসারা, গোবিন্দাসী, নিকরাইল ও অজুনা ইউনিয়নের মাঠজুড়ে এখন শুধু ভুট্টার চাষ। এখানকার কৃষকরা জানিয়েছেন, মাটি ও আবহাওয়া অনুকূলে থাকায় ফলন ভালো হয়েছে। সরকারি কৃষি অফিস থেকে প্রাপ্ত বীজ ও সার সহায়তা এবং নিয়মিত পরামর্শ তাদের সাফল্যের পেছনে বড় ভূমিকা রেখেছে।

গোপালপুর উপজেলার আলমনগর চর নলহড়া গ্রামের কৃষক হায়দার আলী জানান, “আমি কৃষি বিভাগ থেকে প্রণোদনা হিসেবে যুবরাজ ও গঙ্গা-পদ্মা জাতের হাইব্রিড ভুট্টার বীজ পেয়েছিলাম। আমার দুই বিঘা জমিতে ভুট্টা চাষ করেছি। ভালো ফলন পেয়েছি।”

কালিহাতী উপজেলার বেলেটিয়া গ্রামের কৃষক আব্দুল আউয়াল বলেন, “এখানকার মাটি ভুট্টা চাষের উপযোগী হওয়ায় আমাদের চরাঞ্চলে ভুট্টার বাম্পার ফলন হয়। এ বছর আমি ৪ বিঘা জমিতে ভুট্টার চাষ করেছি। আশা করছি বিঘা প্রতি ৩৫ থেকে ৪০ মণ ভুট্টা পাব। গত বছর ফলন ভালো হওয়ায় এবার আরও বেশি জমিতে আবাদ করেছি। আমার দেখাদেখি যারা আগে ভিন্ন ফসল করত তারাও এ বছর ভুট্টা চাষে এসেছে।”

ভুট্টা চাষে কৃষকদের সঠিক দিকনির্দেশনা দিতে মাঠ পর্যায়ে কাজ করছেন কৃষি কর্মকর্তারা। গোপালপুর উপজেলার আলমনগর ইউনিয়নের বাগুয়াটা ব্লকের উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা মো. নুরুল ইসলাম বলেন, “বিগত কয়েক বছর ধরে ক্রমাগতভাবে ভুট্টার আবাদ বাড়ছে। কৃষক যেন নতুন এই ফসলে সমস্যায় না পড়ে, সেজন্য আমরা তাদের প্রশিক্ষণ দিচ্ছি এবং চাষাবাদের পদ্ধতি হাতে ধরে শেখাচ্ছি। রোগবালাই হলে সেটি দমন নিয়েও আমরা পরামর্শ দিচ্ছি।”

টাঙ্গাইল কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক কৃষিবিদ মো. আশেক পারভেজ বলেন, “ভুট্টা এখন এই জেলার একটি গুরুত্বপূর্ণ অর্থকরী ফসলে পরিণত হয়েছে। কৃষি বিভাগ সার্বক্ষণিকভাবে ভুট্টার রোগ, পোকামাকড় দমন এবং অধিক ফলনের জন্য কৃষকদের প্রশিক্ষণ ও প্রযুক্তিগত সহায়তা দিয়ে যাচ্ছে।”

তিনি আরও বলেন, “বিশেষ করে যমুনার চরাঞ্চলের মাটি ভুট্টা চাষের জন্য খুবই উপযোগী। আমরা কৃষকদের প্রণোদনা এবং কারিগরি সহায়তা দিয়েছি। এতে করে উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রার চেয়েও বেশি ফলন পাওয়া যাবে বলে আশা করছি।”

কৃষিবিদ আশেক পারভেজ বলেন, “ভুট্টা এখন শুধু খাদ্যশস্য নয়, বরং পোলট্রি শিল্পের কাঁচামাল হিসেবেও এর চাহিদা ব্যাপক। ফলে বাজারে দাম ও চাহিদা দুটোই কৃষকের পক্ষে কাজ করছে। আর সে কারণেই ভুট্টা চাষে সাফল্য এনে দিচ্ছে নতুন আশার আলো।”

ভবিষ্যতে যদি এই সহায়তা, আবহাওয়া ও বাজার স্থিতিশীল থাকে, তাহলে টাঙ্গাইলের চরাঞ্চল হয়ে উঠতে পারে দেশের অন্যতম প্রধান ভুট্টা উৎপাদন এলাকা—এমনটাই প্রত্যাশা করছেন এখানকার কৃষক ও কৃষি কর্মকর্তারা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *