Saturday, April 26
Shadow

কেন বাড়ছে এই জেনারেশন কনফ্লিক্ট

সময়ের সাথে সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে জেনারেশন কনফ্লিক্ট। একটা জেনারেশন আরেকটা জেনারেশনকে সহ্য করতে পারছে না। একটা জেনারেশন আরেকটা জেনারেশনকে বিভিন্ন কারণে দোষারোপ করছে, সৃষ্টি হচ্ছে জেনারেশন কনফ্লিক্ট বা বিভাজনের। একটা জেনারেশন বিচ্ছিন্ন হচ্ছে আরেকটা জেনারেশন থেকে। ক্রমাগত দূরে সরে যাচ্ছে একটা প্রজন্ম আরেকটা প্রজন্ম থেকে।

আমরা পৃথিবীর মানুষরা সময়ের স্রোতে ভেসে ভেসে এমন একটা সময়ের এসে পৌঁছেছি যখন একই সঙ্গে বিভিন্ন সময়ের মানুষ একত্রে বসবাস করছি। কারো প্রযুক্তি ছাড়া চলে না আবার অনেকের প্রযুক্তি সম্পর্কে কোন ধারণাই নেই। আমাদের আশেপাশে এখনো এমন অনেক মানুষ আছে যাদের প্রযুক্তি সম্পর্কে কোন প্রকার ধারণা নেই। তাদের বেশিরভাগই সারাদিনের কর্ম ক্লান্তি শেষে রাতে দুমুঠো খেয়ে সকালের অপেক্ষায় ঘুমিয়ে পড়ে। সকাল হলে আবার তারা মাঠে গিয়ে ফসল ফলাতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। আরেকটা শ্রেণি আছে যারা অর্ধেক আধুনিক প্রযুক্তি সংশ্লিষ্ট এবং অর্ধেক প্রাচীন জীবনের ধারায় অভ্যস্ত অর্থাৎ কিছুটা প্রযুক্তির সাথে পরিচয় ঘটেছে এমন মানুষ। আরেকটা শ্রেণি আছে যারা সম্পূর্ণ প্রযুক্তি নির্ভর ডিজিটাল সময়ের মানুষ। যাদেরকে আমরা জেনারেশন জেন-জি নামে চিনি। যাদের ধ্যান ধারনা সম্পূর্ণ প্রযুক্তি নির্ভর যারা বেড়ে উঠছে পাবজি, মাবজি, বিভিন্ন ইনডোর ও মোবাইল ফোন এবং প্রযুক্তির উপর নির্ভর করে। তাদের প্রযুক্তি ছাড়া চলেই না। প্রযুক্তি তাদের কাছে ভাত মাছের মত অবিচ্ছেদ্য অংশ।

একই সাথে এই তিনটি জেনারেশন এক সাথে একই সোসাইটিতে বসবাস করছে। অথচ একটি জেনারেশন আরেকটি জেনারেশন থেকে আকাশ মাটির মত বিচ্ছিন্ন। আমাদের সমাজে একই সাথে এত ভিন্ন ভিন্ন সময়ের মানুষ একত্রে বসবাস করছে সেক্ষেত্রে জেনারেশন কনফ্লিক্ট তো খুবই স্বাভাবিক ব্যাপার। কিন্তু এই জেনারেশন কনফ্লিক্টকে স্বাভাবিক ও বন্ধুত্বপূর্ণ সহনশীল সখ্যতায় পরিনত করতে যে চর্চা দরকার সেটা আমাদের মাঝে নেই বললেই চলে। আমরা একটা শ্রেণী আরেকটা সময়ের মানুষকে দেখতে পারিনা, সহ্য করতে পারিনা, মানতে পারি না। একটা জেনারেশন আরেকটা জেনারেশন থেকে পালিয়ে পালিয়ে পাশ কাটিয়ে চলে।

এই বেশিদিন দিন আগের কথা নয়, প্রযুক্তি তখনো এখানে তার সাবালকত্বতার পরিপূর্ণ প্রকাশ ঘটায়নি। তখন দেখতাম কোন বিশেষ স্থানকে কেন্দ্র করে, যেমন বড় কোন বট বৃক্ষ বা ছায়া সমৃদ্ধ কোন স্থান এমন সব জায়গায় বাচ্চা, বৃদ্ধ, নারী পুরুষ সকলে মিলে এক সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে গল্প করছে হাসি ঠাট্টা করছে, মন খুলে গান গাইছে। কিন্তু এখন তেমনটা আর চোখে পড়ে না। একটা জেনারেশন আরেকটা জেনারেশনের কাছে আসার প্রক্রিয়া হচ্ছে তাদের মাঝে গল্প হওয়া, আড্ডা হওয়া, গানের জায়গা থাকা কিন্তু সেই জায়গাটা আমাদের এখন ক্রমশ নষ্ট হওয়ার পথে। এই গল্প, আড্ডা, গান একটা জেনারেশনকে আরেকটা জেনারেশনের কাছে গ্রহণযোগ্য ও প্রাণবন্ত করে তোলে। একে অন্যের মধ্যে সম্পর্কের ক্ষেত্র তৈরি করে কিন্ত এখন সেটা নেই বললেই চলে। চারপাশ জুড়ে শুধু বিচ্ছিন্নতার শুকনো তালপাতার খসখসে শব্দে সবকিছু কেমন যেন বিষাদিত ও বিবর্ণ। প্রখর চৈত্রের তাপিত বায়ু তাপে সব যেন পুড়ে ছারখার হয়ে গেছে।

বর্তমানের তরুণ প্রজন্ম এমন কিছু বৈশ্বিক বৈশিষ্ট্য আপনা আপনিই লাভ করছে যেটা অনেকের চোখে দৃষ্টিকটু। আর এই দৃষ্টিকটুতার কারণ হিসেবে একটা প্রজন্ম বেড়ে ওঠে একটা আলাদা সময়ের ফ্লেভার নিয়ে যে প্রজন্ম যে সময়ের ফ্লেভার নিয়ে বেড়ে ওঠে সে সেটাতে আটকে যায়, সে প্রজন্ম অন্য একটা আলাদা প্রজন্মকে খুব সহজভাবে গ্রহণ করতে চায় না যা তার মনের অজান্তেই এটা ঘটে থাকে। আবার নতুন যে প্রজন্ম বেড়ে ওঠে তারাও পুরাতনদের গ্রহণ করতে চায় না বা করে না। কারণ সে যে সময়ের ছোঁয়ায় বড় হয় সেই সময়ের ফ্লেভারকেই সে সঠিক ও এপ্রোপ্রিয়েট বলে মনে করে। এটা অনবরত চলতেই থাকে। এটা মূলত একটা রিসাইকলের মত চললাম প্রক্রিয়া। আমরা যদি একটা নতুন জেনারেশনের মনস্তাত্ত্বকে ধরতে চাই তাহলে আমাদেরকে আমাদের সময় থেকে বেড়িয়ে তাদের সময়ে বিচরণ করতে হবে এবং এই প্রক্রিয়াকে বলে সময়ের সাথে নিজেকে ভাসিয়ে দেওয়ার ভাসমান মানসিকতা তৈরির করা। যারা যত বেশি সময়কে ধরতে পেরেছে তারা ঠিক তত বেশি নতুন জেনারেশনকে অনুধাবন করতে পেরেছে। আমরা মোটামুটি একটা জেনারেশন থেকে আরেকটা জেনারেশন অনেক বেশি বিচ্ছিন্ন। এর মূল কারণই হচ্ছে একে অন্যকে গ্রহণ করার মানসিকতা তৈরি না করতে পারার অক্ষমতা।

বর্তমানে যারা কিশোর তাদের বেশিরভাগ শ্রেণীই বড়দের থেকে নিজেকে লুকিয়ে বা এড়িয়ে চলে, নিজেদের গুটিয়ে রাখে নির্দিষ্ট জীবনের গন্ডিতে। এর পেছনে যে কারণ রয়েছে তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে তারা কোন ভাবেই অযাচিত কোন প্রশ্ন বা কৈফিয়ত দিতে চায় না। তারা মনে করে প্রবীণদের কাছে গেলেই তারা হয়তো বিভিন্ন প্রশ্ন করবে এমন সব প্রশ্ন করবে যা তাদের লজ্জা বা শঙ্কার কারণ হতে পারে এজন্য বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই তারা প্রবীণ জেনারেশনকে এড়িয়ে চলে মুখোমুখি হতে চায় না তাদের। আমি নিজের চোখে অনেককে দেখিছি, প্রবীণরা বাচ্চাদের সাথে এমন ভাবে ট্রিট করে যেন তারা পৃথিবীর সবচেয়ে জ্ঞানী ও বিজ্ঞজন আর তাদের জ্ঞান ছাড়া কোন কিছুই সম্ভব না। তাদের জ্ঞান ছাড়া কেউ চলতে পারবে না। বাচ্চাদের সাথে তারা কথা বলার সময় বাচ্চাদের ছোট করে কথা বলে এবং নিজেদের বড় বিজ্ঞ করে দেখাতে চায়। বাচ্চাদের সাথে বেশিরভাগই ভয়মিশ্রিত অসমীহ আচরণ করে। একটা তুচ্ছ তাচ্ছিল্যের সুরে তাদের সাথে কথা বলে। প্রবীণদের এই মানসিকতা থেকে বেড়িয়ে আসতে হবে। আপন করে নিতে হবে শিশু- কিশোরদের তাদের সাথে গল্প করতে হবে সে গল্প হবে প্রশ্ন বা কৈফিয়তহীন আনন্দপূর্ণ ও সাবলীল।

বড়দের যেমন ছোটদের প্রতি স্নেহ কোমল আচরণের প্রাকটিস করতে হবে, তেমনি ছোটদেরও বড়দের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হতে হবে, বড়দের অভিজ্ঞতা সমৃদ্ধ বক্তব্যকে গ্রহণ করতে হবে। একটা জেনারেশন আরেকটা জেনারেশনের এই দোষারোপ নীতি থেকে বের হয়ে আসতে হবে। একটি জেনারেশন আরেকটি জেনারেশনকে বন্ধুত্বপূর্ণ সহনশীলতায় কাছে টানতে হবে। একে অন্যের প্রতি এই আচরণের ভারসাম্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

আমরা যদি এখনো এই বিচ্ছিন্নতার ঢেউকে প্রশমিত করতে না পারি তাহলে ভবিষ্যতে এ ঢেউয়ের আঘাত বাংলার বুকে যে বিরাট তীব্র ক্ষতের সৃষ্টি করবে এতে কোন সন্দেহ নেই। তাই এখনই সময় প্রতিটি জেনারেশন প্রতিটি জেনারেশনের কাছে প্রাণবন্ত হয়ে কাছে আসুক। গল্প, আড্ডা, গানের তালে দূর হোক সকল জেনারেশন কনফ্লিক্ট।

কাজী বনফুল- লেখক ও প্রাবন্ধিক

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *