
বিএনপি ও জামায়াতের শীর্ষ নেতাদের সাম্প্রতিক বৈঠকে কী আলোচনা হয়েছে, তা এখনও আনুষ্ঠানিকভাবে জানা যায়নি। লন্ডন কিংবা ঢাকা—কোনো স্থান থেকেই এ বিষয়ে মুখ খোলেনি কোনো দল। ফলে বিষয়টি ঘিরে তৈরি হয়েছে ব্যাপক কৌতূহল।

দু’দলের মধ্যে যে দূরত্ব সৃষ্টি হয়েছিল, সেই ব্যবধান কি কিছুটা হলেও কমেছে? কেন সেই দূরত্ব তৈরি হলো, কারা দায়ী—এসব প্রশ্ন ঘিরে নেতারা নিজেদের মধ্যে আলোচনা করেছেন, খুঁজেছেন জবাব। চলমান রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট ও ভবিষ্যতের নির্বাচন নিয়ে দীর্ঘ আলোচনা হলেও কোনো নির্দিষ্ট সিদ্ধান্তে পৌঁছাননি তারা।
পর্যবেক্ষকদের মতে, পরস্পরবিরোধী অবস্থান থেকে এক কক্ষে বসার ঘটনাটিই ইতিবাচক। কারণ, দীর্ঘদিনের দূরত্ব, মনঃক্ষোভ ও প্রতিদ্বন্দ্বিতার আবহে দুই দল একে অপরকে প্রতিপক্ষ হিসেবে দেখছিল। এমন এক পরিস্থিতিতে গেল সপ্তাহে বিএনপি ও জামায়াতের শীর্ষ নেতারা এক মানবিক বৈঠকে মিলিত হন।
এক ঘণ্টাব্যাপী ওই বৈঠকে রাজনৈতিক আলাপই ছিল মুখ্য। অসুস্থ বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে দেখতে জামায়াতের আমীর ডা. শফিকুর রহমান যান বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের লন্ডনের বাসভবনে। যদিও এ বৈঠক পূর্বঘোষিত ছিল না, বরং তা ঘটে যায় খানিকটা নাটকীয়ভাবে।
ডা. শফিকুর রহমান তখন ইউরোপীয় ইউনিয়নের আমন্ত্রণে ব্রাসেলসে অবস্থান করছিলেন। সেখানে ইউরোপীয় নেতাদের সামনে জামায়াতের অবস্থান তুলে ধরেছেন তিনি। বৈঠক শেষে দলীয় ও ঘনিষ্ঠ মহলে এ বৈঠককে ‘সফল’ হিসেবেই আখ্যা দিয়েছেন জামায়াতের নেতারা।
বেগম জিয়ার সঙ্গে বৈঠক নিয়ে পূর্বে কোনো গুঞ্জন ছিল না। তবে দু’দলের শুভাকাঙ্ক্ষীরা বেশ আগে থেকেই এমন একটি বৈঠকের পক্ষে তাগিদ দিয়ে আসছিলেন। এ বৈঠকের আগে দু’দলের মধ্যে ফোনালাপও হয়। তারেক রহমান নিজেই জামায়াত আমীরকে আন্তরিকভাবে স্বাগত জানান এবং তার বাসায় নিজ হাতে আপ্যায়ন করেন।
আলোচনার সূচনা হয় আবেগঘন পরিবেশে। খালেদা জিয়ার শারীরিক অবস্থা ও দিনযাপনের খোঁজখবর নেন ডা. শফিক। জানতে চান, তিনি কবে দেশে ফিরতে পারবেন। এরপর ধীরে ধীরে বৈঠক গড়ায় রাজনীতির আঙিনায়।
২০০১ সালের নির্বাচনে বিএনপি-জামায়াতের নেতৃত্বে গঠিত চারদলীয় জোট ক্ষমতায় আসে, আর তখনই প্রথমবারের মতো সরকারে অন্তর্ভুক্ত হয় জামায়াত। দলের নেতারা—মতিউর রহমান নিজামী ও আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ—মন্ত্রী হন। এতে বিএনপি নানা মহলে তীব্র সমালোচনার মুখে পড়ে।
ওয়ান-ইলেভেনের আগ পর্যন্ত দুই দলের মধ্যে সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক বজায় থাকলেও, পরবর্তীতে সেই সম্পর্কে ফাটল ধরে। খালেদা জিয়া কারাবরণ করেন, জামায়াতের শীর্ষ নেতাদের ফাঁসি কার্যকর হয়। একে অপরকে প্রকাশ্যেই দায়ী করতে থাকে দুই পক্ষ। সেই সুযোগে ফ্যাসিবাদী আওয়ামী লীগ সরকার রাজনৈতিকভাবে লাভবান হয়।
লন্ডনের এই বৈঠকে খালেদা জিয়া কম কথা বলেন, তবে তার কণ্ঠে ছিল ঐক্যের সুর। আলোচনার ভার মূলত তুলে নেন তারেক রহমান। এ সময় ডা. শফিক বলেন, “কোথা থেকে কী হলো জানি না, তবে আমাদের পক্ষ থেকে কখনোই ঐক্য ভাঙার চেষ্টা ছিল না।” বিএনপি নেতাদের বক্তব্য ও বিবৃতি পর্যালোচনা করলে এর জবাব পাওয়া যাবে বলেও তিনি মন্তব্য করেন।
তারেক রহমান বলেন, “এত বড় দলে কে কী বলেছে তা মনিটর করা সবসময় সম্ভব হয় না। তবে দলীয় সিদ্ধান্তের বাইরে কিছু হয়েছে বলে আমার জানা নেই।” এরপর খালেদা জিয়া খুব সংক্ষেপে বিএনপি-জামায়াত ঐক্যের পটভূমি তুলে ধরেন, যা বৈঠকের আবহকে কিছুটা বদলে দেয়।
এরপর ডা. শফিক আলোচনার গতিপথ ঘুরিয়ে বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে কথা বলেন। দেশীয় রাজনীতিতে ‘ঘোলা পানিতে মাছ শিকার’ করতে একটি বিদেশি শক্তির ষড়যন্ত্র নিয়েও আলোচনা হয়। এ বিষয়ে দুই দল একমত পোষণ করে।
ভবিষ্যতের নির্বাচন কবে হতে পারে, তা নিয়েও দীর্ঘ সময় ধরে আলোচনা হয়। যদিও নির্বাচনের সময়সীমা ও বিষয়ভিত্তিক অবস্থান দু’দলের মধ্যে এখনো মিলছে না, তবে দূরত্ব কমাতে কিছু কার্যকর পদক্ষেপ নিয়ে আলোচনা হয়েছে। দুই দলের নেতারা আরও ধৈর্য ও সংযমের ওপর গুরুত্ব দেন।
ঢাকার একটি নির্ভরযোগ্য সূত্র জানিয়েছে, দুই দলের কেউই ভবিষ্যতে এমন কিছু করবেন না যা সম্পর্কের মধ্যে আবারও ফাটল ধরাতে পারে—এই বিষয়ে একপ্রকার অলিখিত বোঝাপড়ায় পৌঁছেছেন তারা।