Sunday, July 27
Shadow

জুলাই প্রকল্পে দুর্নীতি ও লুটপাট, ২৫ লাখ টাকার লিফট হয়েছে প্রায় ১ কোটি টাকা

জুলাই মাসের গণঅভ্যুত্থানে শহীদ পরিবারের সদস্যদের আবাসন সুবিধা দেওয়ার জন্য ‘৩৬ জুলাই’ নামে একটি বিশেষ প্রকল্প গ্রহণ করে জাতীয় গৃহায়ন কর্তৃপক্ষ। তবে কোনো নিয়মনীতি না মেনে, তড়িঘড়ি করে প্রকল্পটি বাস্তবায়নের চেষ্টা চলছে। এই প্রকল্পে প্রতিটি উপাদান কেনার ক্ষেত্রে খরচ দেখানো হয়েছে প্রকৃত মূল্যের তুলনায় অনেক বেশি—সর্বনিম্ন আড়াই গুণ থেকে শুরু করে সর্বোচ্চ ৪৫ গুণ পর্যন্ত। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই প্রকল্পের কেনাকাটায় অনিয়মের মাত্রা যেন বিখ্যাত ‘বালিশ কাণ্ড’-কেও ছাড়িয়ে যাচ্ছে।

প্রস্তাবিত প্রকল্পের প্রতিটি ধাপে ও প্রতিটি উপকরণে রয়েছে ভয়াবহ অনিয়ম ও অস্বাভাবিক ব্যয়। সংশ্লিষ্টদের মতে, বিগত সরকারের সময়ে যেভাবে প্রকল্পের আড়ালে দুর্নীতি ও লুটপাট হয়েছে, ঠিক সেই পুরোনো ‘ভূত’ যেন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সময়েও ফিরে এসেছে।

প্রকল্প সূত্রে জানা গেছে, ৭৬১ কোটি ১৬ লাখ টাকা ব্যয়ে ‘৩৬ জুলাই’ নামের এই প্রকল্প বাস্তবায়ন করবে জাতীয় গৃহায়ন কর্তৃপক্ষ। এর আওতায়, জুলাই গণঅভ্যুত্থানের শহীদ পরিবারের সদস্যদের জন্য সম্পূর্ণ বিনামূল্যে ৮ শতাধিক ফ্ল্যাট বরাদ্দ দেওয়ার পরিকল্পনা রয়েছে। প্রকল্পটি পুরোপুরি সরকারি অর্থায়নে বাস্তবায়ন হওয়ার কথা।

তবে প্রকল্প ব্যয়ের খুঁটিনাটি বিশ্লেষণে দেখা গেছে, প্রকৃত মূল্যের তুলনায় কয়েক গুণ বেশি দাম দেখিয়ে কেনাকাটার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। যেমন: প্রকল্পের জন্য ব্যবহৃত আরসিসি পিলার, যার প্রকৃত মূল্য ৯০০ টাকা, সেটির দাম ধরা হয়েছে ৪০ হাজার টাকা। ২৫ লাখ টাকার একটি লিফটের মূল্য দেখানো হয়েছে ৯২ লাখ টাকা। ১২ লাখ টাকার একটি সাবস্টেশনের মূল্য ধরা হয়েছে ৬৩ লাখ টাকা। ৯৫ হাজার টাকার একটি পানির পাম্পের জন্য ব্যয় ধরা হয়েছে সাড়ে ৪ লাখ টাকা।

সূত্র আরও জানিয়েছে, প্রকল্পে ১ হাজার কেজি ধারণক্ষমতার ১৮টি বেড লিফট কেনার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে ১৬ কোটি ৭২ লাখ ৯২ হাজার টাকায়। এতে প্রতিটি লিফটের গড় দাম দাঁড়ায় ৯২ লাখ ৯৪ হাজার টাকা, যা প্রকৃত মূল্যের তুলনায় প্রায় চারগুণ বেশি।

এ ছাড়া, ৮০০ কেজি ক্ষমতার ১২টি প্যাসেঞ্জার লিফট কেনার জন্য ১০ কোটি ২ লাখ ৬০ হাজার টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। প্রতিটি লিফটের গড় মূল্য দেখানো হয়েছে ৮৩ লাখ ৫৫ হাজার টাকা, যা প্রকৃত মূল্যের তুলনায় তিনগুণ বেশি।

প্রকল্পে বিদ্যুৎ সরবরাহের জন্য ১ হাজার কেভিএ ক্ষমতার ৬টি সাবস্টেশন ট্রান্সফরমার কেনার জন্য মোট খরচ ধরা হয়েছে ৫ কোটি ৯১ লাখ ৬০ হাজার টাকা। এতে প্রতিটির দাম পড়ে ৯৮ লাখ ৬০ হাজার টাকা—যা প্রকৃত দামের প্রায় আড়াই গুণ।

এ ছাড়া, ২৫০ কেভিএ ক্ষমতার ১২টি সাবস্টেশনের জন্য খরচ দেখানো হয়েছে ৭ কোটি ৫৫ লাখ ৪০ হাজার টাকা। এতে প্রতিটির গড় দাম দাঁড়ায় ৬২ লাখ ৯৫ হাজার টাকা, যা বাস্তব দামের তুলনায় পাঁচ গুণেরও বেশি। শুধু তাই নয়, প্রকল্পে সীমানা প্রাচীর ও পানির পাম্পের মূল্যও দেখানো হয়েছে যথাক্রমে ৪৫ গুণ ও পাঁচ গুণ বেশি।

আরও উদ্বেগজনক বিষয় হলো, প্রকল্পটি বাস্তবায়নের জন্য এখন পর্যন্ত কোনো নীতিমালা, মাস্টারপ্ল্যান কিংবা পূর্ণাঙ্গ নকশা পর্যন্ত প্রণয়ন করা হয়নি।

এই সব অনিয়ম ও অস্বাভাবিক ব্যয় সম্পর্কে জানতে চাইলে জাতীয় গৃহায়ন কর্তৃপক্ষের সচিব মনদিপ ঘরাই, প্রকল্প তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী হারিজুর রহমান এবং পরিকল্পনা উইংয়ের নির্বাহী প্রকৌশলী আবু হোরায়রা—তাঁরা কেউই এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।

এদিকে, প্রকল্পে অতিরিক্ত ব্যয়ের প্রস্তাব এবং দুর্নীতির আশঙ্কা নিয়ে সংবাদ মাধ্যমে প্রতিবেদন প্রকাশিত হওয়ার পর, রোববার (২৭ জুলাই) জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটি (একনেক) সভায় প্রকল্পটি অনুমোদন দেওয়া হয়নি। অর্থাৎ সরকার এই মুহূর্তে প্রকল্পটি ফিরিয়ে দিয়েছে।

এ বিষয়ে সরকারের পরিকল্পনা উপদেষ্টা ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ বলেন, “আমরা মনে করি প্রকল্পটির যথাযথ মূল্যায়ন হওয়া উচিত। জুলাই যোদ্ধাদের সব প্রকল্প এক জায়গায় এনে সমন্বিতভাবে পরিচালনা করা দরকার। এজন্য ভালো ও পরিকল্পিত নকশা প্রয়োজন।”

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *