কার্ত্তিক দাস-নড়াইল: নদী পথে নড়াইল থেকে খুলনার দূরত্ব ৫০ মাইল । এই পথেই নড়াইল থেকে খুলনায় পৌছাতে ১৬টি জোয়ার ভাটার জন্য অপেক্ষা করতে হয় । একটি ভাটা চলে গেলে পরের ভাটা আসার অপেক্ষায় বসে থাকতে হয় নদীর মধ্যে । নিদারুন কষ্টের মধ্যে ১৬টি দিন নদীতেই কাটাতে হয় । খাওয়া-দাওয়া ছাড়া্ বাহ্যিক কাজগুলোও সেরে নিতে হয় নদীতেই । এমন মানবেতর কথাগুলো বললেন নড়াইল থেকে খুলনায় নদী পথে বাশ বয়ে নেওয়া বাদশা মিয়া ।
বাদশার বাড়ি নড়াইল সদর উপজেলার চন্ডিবরপুর ইউনিয়নের ফেদি গ্রামে । শুধু বাদশা মিয়াই নয় । এমন দূর্বিসহ অভিজ্ঞতা একই ইউনিয়নের চালিতাতলা গ্রামের টুলু মোল্যা,মহিষখোলা গ্রামের বাবু শেখেরও রয়েছে । তারা বলেন,২০ বছর ধরে এ পেশার সঙ্গে জড়িত । তাদের জীবনটা মনে হয় জোয়ার-ভাটার সঙ্গে গাথা । আমাদের মত প্রায় শতাধিক মানুষ খুলনায় বাশ আনা নেওয়া কাজ জড়িত ।
জানতে চাইলে বাদশা মিয়া বলেন,প্রতি চালানে এক হাজার থেকে দুই হাজার পিস বাশ নিতে হয় । মালিক পক্ষ পথের দূরত্ব অনুযায়ী একটি বাশের জন্য ১০ থেকে ১৫ টাকা করে দিয়ে থাকেন । এ কাজে তেমন একটা ঝুকি না থাকলেও রোদ-বৃষ্টিতে ভিজে গন্তব্যস্থলে পৌছাতে হয় । তিনি বলেন,নদী পথে যাবার সময় অন্য কোন যানের সঙ্গে যাতে আঘাত না লাগে সেদিকে নজর রাখতে হয় ।
জেলা কৃষি বিভাগ সূত্রে জানা গেছে,বাশ উৎপাদনের জন্য নড়াইলের মাটি বেশ উপযোগি । এখানে তল্লা,ভালকো এবং কুড়য়া বাশ বেশি জন্মে থাকে । জেলায় ২০২৩-২৪ অর্থ বছরে ২৯১ হেক্টর জমিতে ১৬ লাখ ৯৩ হাজার ৯৮৪ পিস বাশ উৎপাদন হয় । ২০২৪-২৫ অর্থ বছরে ২৯৬ হেক্টর জমিতে ১৭ লাখ ৩১ হাজার ৫৬০ পিস বাশ উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ।
সূত্র জানায়,নড়াইলের বাশগ্রাম,চাচুড়ি,সীমানন্দপুর,ভুমুরদিয়া,চন্দ্রপুর,চৌগাছা,তুলারামপুর,নলদী,রায়খালি,ফেদি,চাপুলিয়া,রতডাঙ্গা,পাইকমারি,পলইডাঙ্গা,আউড়িয়া,এড়েন্দা,বল্লারটোপ,ভবানীপুরসহ বিভিন্ন এলাকায় বাশ বিক্রির হাট গেড়ে উঠেছে । এসব বাজার নবগঙ্গা,চিত্রা নদীর তীরে অবস্থিত । স্থানীয়রা জানান, এই ২০টি বাশ বিক্রির হাট থেকে প্রায় দেড় হাজার মানুষের কর্মসংস্থান হচ্ছে ।
সরেজমিন দেখা গেছে,চিত্রার পাড়ে নড়াইল সদর উপজেলার ভদ্রবিলা ইউনিয়নের পলইডাঙ্গা গ্রাম । এই গ্রামে ১২ একর জায়গা নিয়ে বসেছে বাশের হাচ । এখানে প্রতি রোববার ২০ থেকে ২৫ লাখ টাকার বাশ কেনাবেচা হয় । যশোর-খুলনাসহ বিভিন্ন জেলা থেকে অর্ধশত ব্যাপারি এ হাটে আসেন বাশ কেনার জন্য । এখানে প্রায় দেড়’শ শ্রমিক ট্রলার নৌকা কিংবা নদীর জোয়ার-ভাটার মাধ্যমে বহনের জন্য কাজ করছে ।
শ্রমিক ছলেমান ফকির জানায়, দূর দূরান্ত থেকে আনা বাশ পরিবহন থেকে নামানো এবং নির্দ্দিষ্ট স্থানে তা ন্তুপ করে রাখার জন্য একজন শ্রমিক ৩৫০ থেকে ৫০০ টাকা রোজগার করে থাকে ।
খুলনার পাইকগাছা থেকে আসা ব্যাপারি হোসেন আলী জানান,তিনি এক যুগ ধরে এই হাট থেকে পাইকারি দামে বাশ কিনে নদী পথে ট্রলার কিংবা জোয়ার-ভাটার সাহায্যে খুলনায় নিয়ে যাই । সেখান থেবে বাগেরহাট,সাতক্ষীরা জেলার বিভিন্ন হাটে নিয়ে বিক্রি করি । তিনি বলেন,নদী পথে পরিবহন ব্যয় কম হওয়ায় লাভও বেশি হয় । প্রতিটি বাশ এখন সর্বনিম্ন ২২৫ টাকা থেকে সর্বোচ্চ ৫৫০ টাকায় পাইকারি দরে কিনে থাকি । আকার ভেদে এই বাশ খুলনায় ৩৫০ থেকে ৬৫০ টাকা দরে বিক্রি হয় । তিনি আরো বলেন,নদী পথে বহন সহজ, ঝুকিমুক্ত ও পরিবহন ব্যয় কম হওয়ায় সময় সাপেক্ষ হলেও আমার মতো অনেক ব্যবসায়ী নদী পথে দেশের দক্ষিণাঞ্চলের বাশ বহন করে থাকে ।
ভদ্রবিলা ইউনিয়নের পলইডাঙ্গা গ্রামের রহমত কাজী বলেন,প্রতি রোববার ভোরে বাশ কাটা এবং বাজারে আনা ও বিক্রি করার পাশাপাশি তা ব্যবসায়ীর পরিবহনে উঠানো নিয়ে এই গ্রামে একটি উৎসবের আমেজ তৈরি হয় । তিনি বলেন,প্রতিদিন একজন শ্রমিক ৫০০ থেকে ৮০০ টাকা আয করে থাকে । স্থানীয় শ্রমিক আবু বক্কর শেখ,মফিজ মিয়া শহীদ খানসহ প্রায় ২০ জন শ্রমিক ব্যবসায়ীদের এসব বাশ নদী পথে খুলনার বিভিন্ন হাটে নিয়ে যান । তারা বলেন,দূরত্ব অনুযায়ী বাশ প্রতি ১৫ থেকে ২০ টাকা করে দেন । এখান থেকে তাদের একটি ভালো উপার্জন হয় ।
নড়াইল জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক মো.জসিম উদ্দীন বলেন,নড়াইল একটি উচু জেলা । বাশ উৎপাদনের জন্য এখানকার মাটি বেশ উপযুক্ত । এই জেলায় প্রচুর পরিমাণে বিভিন্ন জাতে বাশ উপাদন হয়ে থাকে । তিনি বলেন,অপরিকল্পিতভাবে এখানে বাশ উৎপাদন হয়ে আসছে । বাশ উৎপাদনে এখানকার চাষীরা যাতে পরিকল্পনা মাফিক চাষ করে থাকেন সে জন্য কৃষি বিভাগ কাজ করে আসছে । তিনি বলেন,নড়াইলের চাহিদা মিটিয়ে অনেক বাশ দেশের অন্যান্য জেলা শহর ছাড়াও গ্রামগন্জে চলে যাচ্ছে । গৃহ নির্মাণ ছাড়াও পানের বরজ ও সবজি চাষে মাচা তৈরি জেলেদের মাছ ধরার সরন্জাম হন্তশিল্প তৈরিসহ বিভিন্ন কাজে বাশের ব্যাপক চাহিদা রয়েছে ।#২৭/০৭/২৫ ছবি আছে।