
মোঃ জামাল হোসেন, শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালক, ন্যাশনাল গার্লস মাদরাসা, ফেনী।
আজ প্রকৃত শিক্ষালাভের জন্য আমরা আমাদের সন্তানকে সবসময়ই নোটবই, গাইড বই, কোচিং, বইয়ের থলে আর ব্লাকবোর্ডের সাথে লাগিয়ে রাখব না। সত্যিকারের শিক্ষা শুধু ঐতিহাসিক কিছু তথ্য মুখস্থ করা কিংবা কয়েকটি গণিতের সমাধান করা নয়, বা গ্রামারের কিছু নিয়ম জানা নয়। শিক্ষা হচ্ছে একধরনের জীবনব্যাপী ইন্টারএকটিভ পদ্ধতি যেখানে থাকবে প্রশ্ন করা, আলোচনা করা, ক্রিটিক্যালি কোনো কিছু চিন্তা করা, কোনো প্রচলিত বিষয়ের মধ্যে নতুন অর্থ খুঁজে বের করা এবং প্রতিটি অবস্থায় অর্জিত জ্ঞান বাস্তবে প্রয়োগ করা ইত্যাদি।

ধরুন, টেলিভিশনে সরাসরি সম্প্রচারিত একটি খেলা দেখছেন। বিষয়টি কেমন? অবশ্যই মজার। কিন্তু ধরুন আপনি স্টেডিয়ামে বা মাঠে সমর্থক কর্তৃক বেষ্টিত হয়ে খেলা দেখছেন। দুটোতে কি একই ধরনের মজা পাবেন? বাস্তব অভিজ্ঞতার বর্ণনা কোনোভাবেই টেলিভিশনে বা প্রতিবিম্বের বা ইমেজের মাধ্যমে দেখানো সম্ভব নয়। শিক্ষার বিভিন্ন ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। শ্রেণিকক্ষে যে শিক্ষা দান করা হয়, তা অনেক সময়ই বাস্তব অবস্থার সাথে মিল থাকে না। আমাদের অনেক বিদ্যালয়েই বিজ্ঞান পড়ানোর যন্ত্রপাতি নেই, থাকলেও ব্যবহার করা হয় না। ফলে শিক্ষার্থীরা বিজ্ঞান পড়ার প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলছে দিন দিন। শিক্ষার্থীরা প্রথমদিকে যখন ল্যাবটেরিতে কাজ শুরু করে তখন খুব উত্তেজিত থাকে; কিন্তুু কিছুদিন যাওযার পর অনেক এক্সপেরিমেনেন্টের বাস্তবের সাথে মিল থাকে না বলে তারা আগ্রহ হারিয়ে ফেলে।
বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে শিক্ষার্থীদের বাস্তব জ্ঞান আহরণের জন্য শ্রেণিকক্ষের চারদেয়ালের বাইরে যাওয়া একটি আবশ্যকীয় শর্ত । আমরা যদি উচুঁমানের শিক্ষা প্রদান নিশ্চিত করতে চাই, তাহলে শ্রেণিকক্ষের শিক্ষার সাথে বাইরের শিক্ষার সমন্বয় সাধন করতে হবে। শ্রেণিকক্ষের বাইরে গিয়ে শেখা শিক্ষার্থীদের অনুসন্ধান করার দক্ষতা বৃদ্ধি করে, মূল্যায়ন বিশ্লেষণ করার এবং কোনো বিষয় পরিস্কারভাবে ব্যাখ্যা করা ও সমস্যা সমাধানের দক্ষতা বৃদ্ধি করে। শ্রেণিকক্ষের বাইরের অভিজ্ঞতা শিক্ষার্থীদের নিজেদের দায়িত্ব সম্পর্কে সচেতন করে এবং ধীরে ধীরে তারা দায়িত্বশীল নাগরিক হিসেবে গড়ে ওঠে। এখানে একটি কথা বলে রাখি বেশির ভাগ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান শ্রেণীকক্ষের বাইরে নিইয়ে গেলেও তা বছরে একবার এবং সেটা শুধুই বিনোদনের উদ্দেশে। মূল কথা হল শ্রেণিকক্ষের বাইরের শিক্ষাকে যথাযথ ভাবে অর্জনের জন্য বিনোদন নয় শিক্ষার উদ্দেশে শিক্ষার্থীদের স্বাধীন ভাবে ছেড়ে দিতে হবে যাতে তাদের মধ্যেকার সুপ্ত প্রতিভা প্রস্ফটিতো হতে পারে।

ধরুন, কয়েকদিন ধরে আবহাওযা খারাপ ছিল, ঝড়, বৃষ্টি ছিল কিংবা মেঘলা আকাশ ছিল , গুমোট পরিবেশ বিরাজ করছিল। তারপর মেঘ কেটে গিয়ে আবহাওয়া ভালো হলো, প্রকৃতি হাসতে শুরু করল আমরা ক্লাস শুরু করলাম সেই চার দেয়ালের মাঝে । বাস্তব চিন্তা করে দেখুন আপনার বা আমার কতটা ভালো লাগবে! প্রকৃতিগতভাবে দেখবেন শিক্ষার্থীরা বার বার বাইরে তাকাচ্ছে। প্রকৃতি তাদের হাতছানি দিয়ে ডাকছে বাইরে আসার জন্য। এ সময় আমরা তাদেরকে ক্লাসরুমের ভেতরে কতক্ষণ আটকিয়ে রাখতে পারবো? হ্যাঁ, আটকিয়ে রাখতে পারবো তাদের দেহটাকে, কিন্তু তাদের মন বাইরে চলে যাবেই কারণ তাদের মনের ওপর আমার বা আমাদের নিয়ন্ত্রণ নেই। আর প্রকৃত শিক্ষা ঘটে থাকে তখনই যখন শরীর ও মনের ইচ্ছে একই বিন্দুতে অবস্থান করে। আমি বা আপনি যদি তাদের মনের ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে চাই বা চান, তাহলে আমাকে বা আপনাকে অবশ্যই তাদের মনের ভাব বুঝতে হবে, আর বুঝতে পারাটাই হচ্ছে প্রকৃত শিক্ষকের কাজ। আমি সকল শিক্ষককে এবং সাথে অভিভাবকদের বলবো “আপনি যা পড়াচ্ছিলেন তাই পড়ান, কিন্তু শিক্ষার্থীদের মাঠে নামতে দিন, বিদ্যালয়ের আশেপাশে নিয়ে যান। দেখবেন প্রকৃতিগতভাবেই কতক্ষন পরে তাদের স্বাদ মিটে যাবে এবং নিজেরাই আবার ক্লাসরুমে ফিরে আসতে চাইবে। আর না চাইলেও কতক্ষণ পরে আপনি তাদের নিয়ে আসেন, তারা আসবে কারণ মানব প্রকৃতি সব সময়ই পরিবর্তন চায়”।
শ্রেণিকক্ষের বাইরের শিক্ষা দেওয়ার বা গ্রহণ করার কয়েক ধরনের সুবিধা আছে।
১) এখানে শিক্ষা বাস্তব পরিবেশে ঘটে বলে শিক্ষার্থীদের ঐ বিষয়ের ওপর স্বচ্ছ একটা ধারণা জন্মে।
২) শিক্ষাগ্রহণ হয় বাস্তব এবং প্রাসঙ্গিক।

যে বিষয়ের ধারণা শিক্ষার্থীরা শ্রেণিকক্ষের ভেতরে তৈরি করতে পারে না; উন্মুক্ত ও বিস্তৃত প্রকৃতির কোলে তা তারা সহজেই বুঝতে পারে। ধরুন, আপনি মূল, কাণ্ড, পাতা, ফুল ও ফল ইত্যাদি পড়াচ্ছেন হয় ছবি এঁকে বা উদাহরণ দিয়ে। তা না করে আপনি যদি বিদ্যালয়ের পাশে কোনো বাগানে নিযে সরাসরি গাছ দেখাতে পারেন, তা হলে সে সহজে ব্যাপারগুলো বুঝতে পারবে এবং ওই শিক্ষার কথা তারা সহজে ভুলবে না। শিক্ষার্থীদের শ্রেণিকক্ষের বাইরে নিয়ে যাওয়ার অর্থ হচ্ছে আপনি তাদের পাখার ক্লিপ কিংবা বাঁধন খুলে দিলেন। তাদের মন উন্মুক্ত হলো এবং উন্মুক্ত মন এমন কিছু সৃষ্টি করবে যা সম্পর্কে আপনি প্রস্তুত ছিলেন না, আপনি আবিস্কার করতে পারেননি যে, ঐ শিক্ষার্থীরা কী কী করতে পারে। এতদিন তারা পরিবেশ পায়নি বলে করতে পারেনি। আপনি যে বিষয়েই পড়ান না কেন, সব বিষয়ের ক্ষেত্রে একই ঘটনা ঘটবে।

শ্রেণিকক্ষের বাইরে শিক্ষাদানের আরেকটি লাভজনক দিক হলো বিনা পয়সায় অবারিত শিক্ষা উপকরণের ব্যবহার। এই উপকরণগুলো আপনাকে কিনতে হচ্ছে না। আর উপকরণ ছাড়া শিক্ষা তো সম্পূর্ন হয় না। কিন্তু এখন আমরা কী দেখছি , কী করছি বা কী চাচ্ছি? শিক্ষার্থীরা শুধু একটি ভালো গ্রেড পেলেই সবাই বাহবা দিচ্ছে, সবাই খুশি হচ্ছে, গ্রেডই হচ্ছে সবকিছু বিচারের মানদণ্ড। অথচ এটির সাথে বাস্তব জগতের খুব একটা মিল খুঁজে পাওয়া যায় না। আপনি নিশ্চিত নন যে, শুধু গ্রেডের বদৌলতে একজন শিক্ষার্থী জীবনে অনেকদূর আগাবে। বরং যেসব শিক্ষার্থী বাস্তবজগত সম্পর্কে জ্ঞান অর্জন করেছে, বাস্তবের মুখোমুখি হয়ে অভিজ্ঞতা অর্জন করেছে তারাই জীবনে সামনের দিকে এগিয়ে যায়। বাস্তব জগতে এর অনেক প্রমাণ আছে। আমরা অনেক সময় বলে থাকি অমুক ছেলেটি ক্লাসে তেমন ভালো ছিলনা অথচ সে-ই জীবনে ভালো করেছে। আসলে তার মধ্যে সুপ্ত প্রতিভা ছিল, আমরা তা আবিস্কারও করতে পারিনি কিংবা আবিস্কারের পরিবেশও তৈরি করতে পারিনি। এটি আমাদের সম্মিলিত ব্যর্থতা।