Wednesday, June 18
Shadow

প্রাণহীন মরুভূমিকে যেভাবে সম্পদে পরিণত করেছে চীন

বিশ্বের বৃহত্তম মরুভূমিগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো চীনের তাকলামাকান, গোবি এবং বাদাইন জারান। একসময় এই বিশাল মরুভূমিগুলো চীনের পরিবেশ ও অর্থনীতির জন্য এক বিরাট চ্যালেঞ্জ ছিল। বালির বিস্তার, মরুকরণ এবং অনুর্বর ভূমি কৃষিকে ব্যাহত করছিল, যার ফলে স্থানীয় জনগোষ্ঠীর জীবনযাপন ছিল অত্যন্ত কঠিন। কিন্তু গত কয়েক দশক ধরে চীন সরকার মরুভূমিকে কেবল একটি বাধা হিসেবে না দেখে, সেটিকে একটি বিশাল সম্ভাবনাময় সম্পদ হিসেবে রূপান্তরিত করার এক অসাধারণ প্রচেষ্টা চালিয়েছে। মরুভূমিকে কাজে লাগিয়ে চীন এখন সবুজ বিপ্লব, নবায়নযোগ্য শক্তি উৎপাদন এবং নতুন অর্থনৈতিক অঞ্চল তৈরির এক সাহসী যাত্রায় এগিয়ে চলেছে।

মরুকরণ প্রতিরোধে চীনের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য উদ্যোগ হলো “সবুজ মহাপ্রাচীর” (Great Green Wall) প্রকল্প। এটি একটি বিশাল বনায়ন প্রকল্প, যার লক্ষ্য হলো মরুভূমির বিস্তার রোধ করা এবং বালুঝড় থেকে কৃষিভূমিকে রক্ষা করা। গাছ লাগানোর পাশাপাশি, এই প্রকল্পে ঘাস এবং অন্যান্য গুল্ম রোপণ করা হচ্ছে যা মাটির ক্ষয় রোধ করে। এই প্রকল্প লক্ষ লক্ষ হেক্টর জমিকে মরুকরণের হাত থেকে রক্ষা করেছে এবং মরুভূমির পরিবেশকে স্থিতিশীল করতে সাহায্য করেছে। স্থানীয় কৃষকদের জন্য এটি নতুন আয়ের উৎস তৈরি করেছে, কারণ তারা গাছ পরিচর্যা এবং সংশ্লিষ্ট কাজে জড়িত হতে পারছে।

নবায়নযোগ্য শক্তির বিশাল উৎস:

চীনের মরুভূমিগুলো নবায়নযোগ্য শক্তি উৎপাদনের জন্য এক বিশাল সম্ভাবনাময় ক্ষেত্র। মরুভূমিতে পর্যাপ্ত সূর্যালোক এবং প্রবল বায়ুপ্রবাহ রয়েছে, যা সৌর ও বায়ুশক্তি উৎপাদনের জন্য আদর্শ।

চীনের মরুভূমিগুলোতে বিশাল আকারের সৌর বিদ্যুৎকেন্দ্র (Solar Power Plants) স্থাপন করা হচ্ছে। উদাহরণস্বরূপ, গোবি মরুভূমিতে নির্মিত কিছু সৌর প্রকল্প বিশ্বের বৃহত্তম সৌরবিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোর মধ্যে অন্যতম। এই কেন্দ্রগুলো লক্ষ লক্ষ মানুষের জন্য বিদ্যুৎ সরবরাহ করছে এবং চীনের কার্বন নির্গমন কমাতে সাহায্য করছে।

পাশাপাশি মরুভূমির উন্মুক্ত পরিবেশে বায়ুপ্রবাহের গতি বেশি থাকে, যা বায়ু টারবাইন (Wind Turbines) স্থাপনের জন্য উপযুক্ত। চীনের সিনচিয়াং এবং মঙ্গোলিয়ার মরুভূমি অঞ্চলে বিশাল আকারের বায়ুবিদ্যুৎ কেন্দ্র গড়ে উঠেছে, যা দেশের নবায়নযোগ্য শক্তি উৎপাদন ক্ষমতাকে বাড়িয়ে দিচ্ছে।

এখানেই শেষ নয়, মরুভূমিকে কৃষিক্ষেত্রে ব্যবহারের জন্য চীন উদ্ভাবনী পদ্ধতি গ্রহণ করেছে। যদিও সাধারণ কৃষি এখানে অসম্ভব, তবে বিশেষ ধরণের ফসল, যা শুষ্ক আবহাওয়া সহনশীল, সেগুলোর চাষ করা হচ্ছে।

মরুভূমির উপযোগী ফসল: চীন এমন কিছু ফসল চাষ করছে যা কম পানি ব্যবহার করে জন্মায়, যেমন – কিছু বিশেষ ধরণের আপেল, খেজুর, ঔষধি গাছ, এবং স্যাক্সাউল ঝোপ (Saxaul shrubs)। স্যাক্সাউল ঝোপ মরুভূমির বালু আটকে রাখতে সাহায্য করে এবং জ্বালানি হিসেবেও ব্যবহৃত হয়।

ভূগর্ভস্থ সেচ ব্যবস্থা ও উন্নত প্রযুক্তি: আধুনিক সেচ পদ্ধতি যেমন – ড্রিপ ইরিগেশন (Drip Irrigation) ব্যবহার করা হচ্ছে, যা পানির অপচয় কমায়। এছাড়াও, বিজ্ঞানীরা লবণাক্ত মাটিতে ফসল ফলানোর জন্য বিশেষ গবেষণা চালাচ্ছেন, যা মরুভূমির কৃষিক্ষেত্রে নতুন দিগন্ত উন্মোচন করছে।

পর্যটন ও অর্থনৈতিক উন্নয়ন:

মরুভূমিগুলো এখন কেবল অনুর্বর ভূমি নয়, বরং পর্যটকদের জন্য আকর্ষণীয় গন্তব্য হয়ে উঠেছে।

মরুভূমি পর্যটন: তাকলামাকান এবং গোবি মরুভূমির কিছু অংশে মরুভূমি সাফারি (Desert Safari), উটের পিঠে চড়া, এবং বালির টিলায় চড়ার মতো অ্যাডভেঞ্চার কার্যক্রম জনপ্রিয় হয়েছে। এর ফলে স্থানীয় অর্থনীতিতে নতুন গতি এসেছে এবং কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়েছে।

বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল: চীনের সিনচিয়াং প্রদেশের কিছু মরুভূমি অঞ্চলে বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ে তোলা হচ্ছে, যা বাণিজ্য ও বিনিয়োগ আকর্ষণ করছে।

বিজ্ঞান ও গবেষণার কেন্দ্র:

মরুভূমি পরিবেশ নিয়ে গবেষণার জন্য চীন অনেক বিনিয়োগ করছে। বিজ্ঞানীরা বালু নিয়ন্ত্রণ, মরুকরণ প্রতিরোধ এবং মরুভূমির বাস্তুতন্ত্র বোঝার জন্য কাজ করছেন। এসব গবেষণা ভবিষ্যতের জন্য আরও কার্যকর সমাধান খুঁজে বের করতে সাহায্য করছে।

চীনের মরুভূমিকে কাজে লাগানোর এই মডেল বিশ্বজুড়ে অন্যান্য মরুকরণ-প্রবণ দেশগুলোর জন্য একটি অনুপ্রেরণামূলক উদাহরণ। এটি প্রমাণ করে যে সঠিক পরিকল্পনা, বিনিয়োগ এবং উদ্ভাবনী পদ্ধতির মাধ্যমে প্রতিকূল পরিবেশকেও সম্ভাবনার এক বিশাল ভান্ডারে পরিণত করা সম্ভব।

সূত্র :- সিএমজি

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *