
নিউইয়র্কের বিলাসবহুল একটি টাউনহাউজে প্রতি মাসে ৪০ হাজার ডলার ভাড়ায় বসবাস করছিলেন মাইকেল ভ্যালেনটিনো টিওফ্রাস্টো কারচুরান। ক্রিপ্টোকারেন্সি থেকে আসা বিপুল আয়ের ফলেই এমন আড়ম্বরপূর্ণ জীবনযাপন করছিলেন তিনি। কিন্তু মে মাসে তার সেই ১৭ কক্ষের বাড়িটিই এক বিভীষিকাময় বন্দিশালায় পরিণত হয়।
কারচুরানকে অপহরণ করে সেখানে ১৭ দিন ধরে আটকে রাখে জন ওয়েল্টজ ও উইলিয়াম ডুপ্লেসি নামের দুই ব্যক্তি। তাদের লক্ষ্য ছিল কারচুরানের বিটকয়েন ওয়ালেটের নিয়ন্ত্রণ নেওয়া, যার মধ্যে প্রায় ২৮ মিলিয়ন ডলারের সমপরিমাণ ক্রিপ্টোকারেন্সি ছিল বলে ধারণা করা হয়।
কারচুরানকে নির্যাতনের জন্য তারা ভয়াবহ পন্থা অবলম্বন করে—তাকে ভবনের ছাদ থেকে ঝুলিয়ে রাখা হয়, বৈদ্যুতিক তার দিয়ে শক দেওয়া হয় এবং এমনকি তাকে করাত দিয়ে কেটে ফেলার হুমকিও দেওয়া হয়। সর্বশেষে তাকে জোর করে ক্র্যাক কোকেন খাওয়ানো হয়।
তবে এসব ভয়ঙ্কর নির্যাতনের পরও তারা সফল হতে পারেনি। দুই সপ্তাহেরও বেশি সময় পরে কারচুরান কোনোমতে পালিয়ে যেতে সক্ষম হন। পরে পুলিশ ওয়েল্টজ ও ডুপ্লেসিকে গ্রেফতার করে এবং তাদের বিরুদ্ধে অপহরণ ও নির্যাতনের অভিযোগ আনা হয়।
এটি ছিল সাম্প্রতিক সময়ের এক ‘রেঞ্চ অ্যাটাক’ বা ‘বাঁধাকাঠিন্যপূর্ণ হামলা’র অংশ—যার মধ্যে অন্যতম হলো ‘ক্রিপ্টো অপহরণ’। এতে আধুনিক প্রযুক্তিভিত্তিক ডিজিটাল চুরির সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে পুরনো দিনের নির্মম অপরাধপ্রবণতা। বিশ্বব্যাপী এরকম আরও অনেক ঘটনা ঘটছে।
হ্যাঁ। ৩১ মে ফ্রান্সের প্রসিকিউটররা জানায়, দেশটির ক্রিপ্টোকারেন্সি অঙ্গনের এক গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিকে অপহরণ করার চেষ্টার সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে ২৬ জনকে অভিযুক্ত করা হয়েছে।
প্যারিসে ১৩ মে ‘পেইমিয়াম’ নামের এক ক্রিপ্টো ফার্মের সিইও’র মেয়ে ও নাতিকে অপহরণের চেষ্টার ঘটনাটি কেন্দ্র করে তদন্ত শুরু হয়েছিল। এর আগের দিনও একই লক্ষ্য নিয়ে একটি ব্যর্থ অপচেষ্টা চালানো হয়েছিল। ২ জুন পশ্চিম ফ্রান্সের নঁতে শহরের কাছে আরেকটি অপচেষ্টাও হয়।
প্যারিসের সরকারি প্রসিকিউটরের অফিস জানিয়েছে, “এই মামলায় ১৮ জনকে প্রি-ট্রায়াল হেফাজতে নেওয়া হয়েছে, ৩ জন বিচার স্থগিত রাখার অনুরোধ করেছে এবং ৪ জনকে বিচারিক পর্যবেক্ষণে রাখা হয়েছে।” অভিযুক্তদের বয়স ১৬ থেকে ২৩ বছরের মধ্যে।
সাম্প্রতিক মাসগুলোতে ফ্রান্সে একাধিক প্রভাবশালী ক্রিপ্টো উদ্যোক্তার ওপর হামলার ঘটনা ঘটেছে। তবে কেবল ফ্রান্সেই নয়, অন্য দেশগুলোতেও এমন অপহরণ ঘটেছে।
প্যারিসের সাম্প্রতিক ঘটনার বাইরে, জানুয়ারিতে ফ্রান্সের মধ্যাঞ্চলে ‘লেজার’ নামের ক্রিপ্টোকারেন্সি প্রতিষ্ঠানের সহ-প্রতিষ্ঠাতা ডেভিড বালান্ড ও তার স্ত্রীকে অপহরণ করে একদল অপরাধী।
ভয়াবহভাবে, অপহরণকারীরা বালান্ডের একটি আঙুল কেটে ফেলে এবং সেই দৃশ্য ধারণ করে ‘লেজার’ কোম্পানির কাছে পাঠায়। তবে ফরাসি পুলিশের দ্রুত অভিযান চালিয়ে মাত্র দুই দিনের মধ্যেই দম্পতিকে উদ্ধার করে। এ ঘটনায় ৯ জনের বিরুদ্ধে তদন্ত চলছে।
২০২৪ সালের ডিসেম্বরে বেলজিয়ামে ক্রিপ্টো বিনিয়োগকারী ও অনলাইন প্রভাবক স্তেফান উইংকেলের স্ত্রীকে অপহরণ করা হয়। পরে পুলিশের এক নাটকীয় ধাওয়ায় অপহরণকারী গাড়ি দুর্ঘটনায় পড়লে তাকে উদ্ধার করা সম্ভব হয়।
কানাডা ও অস্ট্রেলিয়াতেও একাধিক উচ্চ-প্রোফাইল অপহরণ ঘটেছে, যেখানে ক্রিপ্টো ব্যবসায়ী ও বিনিয়োগকারীদের অপহরণ করে ডিজিটাল মুদ্রায় ৪০ হাজার থেকে ১০ লাখ ডলার পর্যন্ত মুক্তিপণ আদায়ের চেষ্টা হয়েছে।
তবে এখন পর্যন্ত এই অপহরণগুলো কোনো একটি সংঠনের সঙ্গে সম্পৃক্ত কি না, তা পরিষ্কার নয়।
২০০৯ সালের জানুয়ারিতে প্রথম চালু হয় বিটকয়েন, যা বিশ্বের প্রথম ক্রিপ্টোকারেন্সি। এটি এমন এক আর্থিক ব্যবস্থা, যেখানে ব্যাঙ্ক বা প্রচলিত লেনদেন পদ্ধতির প্রয়োজন পড়ে না। বর্তমানে এটি একটি কার্যকর বিকেন্দ্রীকৃত মুদ্রা ব্যবস্থা, যেটির ব্যবহারকারী কয়েক শত মিলিয়নেরও বেশি।
২০০৯ সালে বিটকয়েনের দাম ছিল মাত্র $0.004। গতকাল বিটকয়েনের মূল্য দাঁড়িয়েছে প্রায় $101,576, যা এক বছরে ৫৩ শতাংশ বেড়েছে এবং ২০০৯ সালের তুলনায় প্রায় ২৫ লক্ষ কোটি শতাংশেরও বেশি বৃদ্ধি পেয়েছে।
প্রথমদিকে, ইন্টারনেট-ভিত্তিক স্বাধীনতাপন্থী ব্যক্তিরাই এটির প্রতি বেশি আকৃষ্ট ছিলেন—তারা মনে করতেন অর্থব্যবস্থা হওয়া উচিত সরকারের নিয়ন্ত্রণমুক্ত। পরে ধীরে ধীরে এটি মূলধারার বিনিয়োগকারীদের মনোযোগ পায় এবং মূল্যও বাড়তে থাকে।
সম্প্রতি মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প একাধিক ক্রিপ্টোকারেন্সি সরকারিভাবে মুদ্রণের উদ্যোগ নিয়েছেন, যাতে করে সেগুলোর দাম আরও বাড়ে। এসব মুদ্রা যুক্ত হবে একটি “ক্রিপ্টো স্ট্র্যাটেজিক রিজার্ভ”-এ।
ক্রিপ্টোকারেন্সি চুরির ঘটনা নতুন কিছু নয়। অতীতে এসব চুরি হতো মূলত ডিজিটাল অ্যাকাউন্ট হ্যাক করে। যেমন ২০২২ সালে বিশ্বের সবচেয়ে বড় ক্রিপ্টো এক্সচেঞ্জ ‘বিন্যান্স’ থেকে প্রায় ৫৭০ মিলিয়ন ডলার চুরি হয়েছিল।
তবে বিটকয়েনসহ অন্যান্য ডিজিটাল সম্পদের মূল্য বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে অপরাধীরা এখন অনলাইন হ্যাকিং ছেড়ে সরাসরি অপহরণ ও নির্যাতনের মতো বাস্তব জগতে ফিরে এসেছে। ডিজিটাল সঞ্চয় হাতিয়ে নিতে তারা ব্যবহার করছে বন্দুক, করাত এবং শারীরিক নির্যাতনের ভয়াবহ পদ্ধতি।