
জাপান, পূর্ব এশিয়ার অন্যতম উন্নত দেশ, একসময় ছিল প্রযুক্তি আর শিল্পখাতে বিশ্বের অগ্রগামী শক্তি। কিন্তু বর্তমান সময়ে দেশটি ভয়াবহ জনসংখ্যা সংকটের মুখোমুখি। কম জন্মহার এবং দীর্ঘায়ুর ফলে বৃদ্ধ জনগোষ্ঠীর সংখ্যা বৃদ্ধি জাপানের অর্থনীতি ও সমাজব্যবস্থায় মারাত্মক প্রভাব পড়ছে। জাতিসংঘের তথ্য অনুযায়ী, ২০৫০ সালের মধ্যে জাপানের এক-তৃতীয়াংশ জনগণ হবে ৬৫ বছরের বেশি বয়সী। এই প্রবণতা শুধু অর্থনৈতিক নয়, বরং সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রেও গভীর সংকটের ইঙ্গিত দেয়। এটি জাপানের জন্য সত্যি একটি বড় কঠিন বাস্তবতা।
জনসংখ্যা কমার কারণ কী?
জাপানে জন্মহার কমে যাওয়ার মূল কারণগুলো বেশ স্পষ্ট। দেশটির তরুণ প্রজন্ম ক্যারিয়ার গড়ে তোলার দিকে বেশি মনোযোগী। উচ্চশিক্ষা গ্রহণ, চাকরি নিশ্চিতকরণ এবং স্থিতিশীল ক্যারিয়ার গড়ার আগে অধিকাংশ তরুণ-তরুণী বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হতে চান না। এছাড়া, সন্তানের লালন-পালনের খরচ এবং শহরকেন্দ্রিক জীবনযাত্রার ব্যয় অনেক বেশি, যা পরিবার গঠনের ক্ষেত্রে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
নারীদের কর্মক্ষেত্রে অত্তাধিক অংশগ্রহণ এবং স্বাধীন জীবনের প্রতি আগ্রহও বেড়ে যাওয়া একটি বড় কারণ। আধুনিক জীবনে নারী-পুরুষ উভয়ই সমানভাবে কর্মব্যস্ত থাকায়, শিশুর দেখাশোনার জন্য পর্যাপ্ত সময় বের করা কঠিন হয়ে পড়ে। এর ফলে বিবাহ বন্ধনে আবধ্য হলেও সন্তান নিতে দেরি ও অনাগ্রহের সংখ্যা বেশি থাকে। আর যাদের সন্তান আছে তারাও ঠিকভাবে সময় না দিতে পারায় এই প্রজন্ম হয়ে উঠছে স্নেহ ও ভালবাসা হীন ভাবে। সরকারের পক্ষ থেকে মাতৃত্বকালীন সুযোগ-সুবিধা থাকলেও, কর্মজীবনের চাপে অনেক নারীই সন্তান গ্রহণে আগ্রহী নন।
অর্থনীতিতে এর প্রভাব ব্যাপক
কর্মক্ষম জনগোষ্ঠী কমে যাওয়ায় জাপানের অর্থনীতি বড় ধরনের সংকটের মুখে পড়ছে। উৎপাদন খাতে কর্মীর অভাব স্পষ্ট হচ্ছে, যা দেশটির শিল্প ও প্রযুক্তিখাতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। ২০২৫ সাল নাগাদ জাপানের মোট শ্রমশক্তির প্রায় ২০ শতাংশ হ্রাস পাবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। এর ফলে জাপানের জিডিপি প্রবৃদ্ধি হ্রাস পাওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।
পাশাপাশি, বৃদ্ধ জনগোষ্ঠীর সংখ্যা বৃদ্ধির ফলে পেনশন ব্যবস্থা এবং স্বাস্থ্যখাতে ব্যয় উল্লেখযোগ্য হারে বাড়ছে। সরকারের বাজেটের বড় অংশই এখন এই খাতে ব্যয় করতে হচ্ছে। স্বাস্থ্যসেবার উন্নতি এবং দীর্ঘায়ু হওয়ার কারণে জাপানের প্রবীণ জনগোষ্ঠী দীর্ঘ সময় জীবিত থাকছেন, যা সামাজিক সেবার ওপর বাড়তি চাপ সৃষ্টি করছে।
সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংকট সৃষ্টি
জাপানের এই জনসংখ্যা সংকট গ্রামীণ অঞ্চলে ব্যাপক প্রভাব ফেলেছে। জনশূন্য হয়ে পড়া গ্রামগুলোতে স্কুল বন্ধ হচ্ছে, হাসপাতালগুলো কর্মী সংকটে ভুগছে। অনেক জায়গায় বাড়িঘর খালি পড়ে আছে, কারণ সেখানে বাস করার মতো মানুষই নেই। নতুন প্রজন্ম শহরমুখী হওয়ায় গ্রামীণ সমাজ ক্রমেই বিলুপ্তির পথে যাচ্ছে। এর ফলে প্রজন্ম প্রকৃতি থেকে ধীরে ধীরে সরে গিয়ে যান্ত্রিক হয়ে যাচ্ছে। পাশাপাশি, ঐতিহ্যবাহী সংস্কৃতি হারিয়ে যাওয়ার ঝুঁকিও দেখা দিয়েছে। স্থানীয় উৎসব, পারিবারিক ঐতিহ্য, এবং সামাজিক বন্ধন ক্রমেই দুর্বল হয়ে পড়ছে।
সমাধানের চেষ্টা চলছে
জাপান সরকার এই সংকট মোকাবিলায় বেশ কিছু পদক্ষেপ নিয়েছে। নারীদের কর্মক্ষেত্রে আরও সুযোগ তৈরি, সন্তান লালন-পালনের জন্য আর্থিক প্রণোদনা এবং অভিবাসী শ্রমিক আনার পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে। ২০১৯ সালে সরকার নতুন এক অভিবাসন নীতি প্রণয়ন করেছে, যার মাধ্যমে দক্ষ কর্মীদের জাপানে স্থায়ীভাবে কাজ করার সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে।
প্রযুক্তিগত উদ্ভাবনের ব্যবহারের দিকে মনোযোগ
জনশক্তির ঘাটতি মোকাবিলায় জাপান প্রযুক্তি খাতে বিপ্লব ঘটাচ্ছে। অটোমেশন এবং রোবোটিক্স ব্যবহারের মাধ্যমে শিল্প উৎপাদনে দক্ষতা বাড়ানো হচ্ছে। বৃদ্ধ জনগোষ্ঠীর সেবায় রোবট নার্সের ব্যবহার এবং স্মার্ট হোম প্রযুক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে স্বাস্থ্যসেবাকে আরও সহজলভ্য করা হচ্ছে।
জাপানের ইকোসিস্টেমকে টিকিয়ে রাখতে সরকার ‘স্মার্ট সিটি’ ধারণা চালু করেছে, যেখানে বৃদ্ধ ও কর্মক্ষম জনগোষ্ঠী একসঙ্গে বসবাস করবে এবং প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্যসেবা ও সামাজিক সেবা ডিজিটাল পদ্ধতিতে পরিচালিত হবে।
আন্তর্জাতিক শিক্ষা ও অভিবাসন প্রসার মাধ্যমে সমাধানের চেষ্টা
জাপান তার উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থীর সংখ্যা বাড়ানোর পরিকল্পনা নিয়েছে। এছাড়া, অভিবাসী কর্মীদের স্থায়ী নাগরিকত্ব প্রদানের শর্ত শিথিল করা হচ্ছে। এতে কর্মশক্তির ঘাটতি পূরণের পাশাপাশি দেশটির অর্থনৈতিক প্রবাহ ধরে রাখা সম্ভব হবে।
সকলের জন্য শিক্ষণীয় বার্তা
জাপানের এই সংকট শুধু তাদের জন্যই নয়, বরং বিশ্বব্যাপী উন্নত অর্থনীতির দেশগুলোর জন্যও একটি সতর্কবার্তা। সময়মতো প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ না নিলে অর্থনীতি এবং সামাজিক কাঠামো ভেঙে পড়তে পারে। প্রযুক্তি এবং উন্নত জীবনমান নিশ্চিত করলেই একটি সমাজ টিকে থাকতে পারে না; জনসংখ্যার ভারসাম্য রক্ষা করাও সমান গুরুত্বপূর্ণ।
জাপানের অভিজ্ঞতা আমাদের শিখিয়েছে যে, শুধু প্রযুক্তি বা অর্থনৈতিক অগ্রগতি নয়, সমাজের ভারসাম্য রক্ষায় জনসংখ্যার সুস্থ বৃদ্ধি অপরিহার্য। ভবিষ্যৎ পৃথিবীকে টেকসই ও ভারসাম্যপূর্ণ রাখতে এই সংকট থেকে আমাদের শিক্ষা নিতে হবে।
সবসময় মনে রাখতে হবে যে সৃষ্টিকর্তার নির্দেশনার বাইরে গিয়ে সিদ্ধান্ত কখনোই কল্যাণকর হয় না।
মোঃ জামাল হোসেন (শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালক) ন্যাশনাল গার্লস মাদ্রাসা, ফেনী।