
সৈয়দ মুজিবুর রহমান দুলাল, লাকসাম: কুমিল্লার মনোহরগঞ্জের আশিরপাড় বাজারে আধিপত্যবিস্তার নিয়ে দুই গ্রামবাসীর মধ্যে দফায় দফায় রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে অন্তত ২০জন আহত হয়েছেন। এ সময় বাজারের কমপক্ষে ১২টি দোকান ভাংচুর ও লুটপাট করে হামলাকারীরা। পরে পুলিশ ও সেনাবাহিনীর হস্তক্ষেপে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আসে।
মঙ্গলবার রাত সাড়ে ৮টার দিকে উপজেলার মৈশাতুয়া ইউনিয়নের আশিরপাড় বাজারে এ সংঘর্ষের ঘটনাটি ঘটেছে।
এদিকে আহতদের উদ্ধার করে মনোহরগঞ্জ ও লাকসাম উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সসহ বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। এ ছাড়া, আশঙ্কাজনক অবস্থায় ৪জনকে কুমিল্লা ও ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে।
পুলিশ ও এলাকাবাসী সূত্রে জানা গেছে, উপজেলার মৈশাতুয়া ইউনিয়নের আশিরপাড় বাজারে আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে ইউনিয়নের খানাতুয়া এবং আশিরপাড় গ্রামবাসীর মধ্যে বিরোধ চলছিলো। কয়েক মাস আগে আশিরপাড় উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে খেলাধুলা নিয়ে খানাতুয়া গ্রামের কয়েকজন কিশোরের সঙ্গে আশিরপাড় গ্রামের কয়েকজন কিশোরের কাটাকাটি ও বাকবিতন্ডা হয়। একপর্যায়ে খানাতুয়া গ্রামের কিশোররা আশিরপাড় গ্রামের দু’জনকে কুপিয়ে রক্তাক্ত জখম করে। এ নিয়ে উভয়পক্ষের মধ্যে উত্তেজনা দেখা দেয় এবং দফায় দফায় হামলা পাল্টা হামলার ঘটনা ঘটে। পরে মনোহরগঞ্জ থানা পুলিশ এ ঘটনা মিমাংসার জন্য উভয় গ্রামের সর্দার-মাতব্বরসহ গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গকে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়ার আহবান জানান।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে আশিরপাড় গ্রাম ও বাজারের একাধিক ব্যক্তি জানান, এমন অনভিপ্রেত ঘটনার যেনো পূণর্বৃত্তি না ঘটে সেজন্য আশিরপাড়সহ আশেপাশের গ্রামের গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গ পদক্ষেপ নেন। কিন্তু খানাতুয়া গ্রামের লোকজন এতে সাড়া দেয়নি। ওই ঘটনার জের ধরে মঙ্গলবার (২৯ এপ্রিল) রাতে খানাতুয়ার গ্রামের কয়েকজন কিশোর ও যুবক দেশীয় অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে অতর্কিতভাবে হামলা চালায়। এ সময় হামলাকারীরা আশিরপাড় বাজারের ফল দোকানদার আরাফাত (২২), রাকিব (২৮) ও পারভেজকে (৩২) কুপিয়ে আহত করে। এ সময় আহতদের উদ্ধারে এগিয়ে আসলে হামলাকারীরা মোরশেদ আলম মানিক (৩৮) এবং আবু ছায়েদ (৪৫) নামে দু’জনকেও কুপিয়ে আহত করে।
এ সংবাদ ছড়িয়ে পড়লে মূহুর্তের মধ্যে উভয় গ্রামের লোকজন উত্তেজিত হয়ে দেশীয় অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়েন। এতে উভয়পক্ষের অন্তত ২০জন আহত হয়। আহতদের মনোহরগঞ্জ, লাকসাম, কুমিল্লা ও ঢাকার বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে।
আহত অন্যান্যদের মধ্যে রয়েছে, লাকসাম উপজেলা বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক আশিরপাড় গ্রামের মো. শাহ আলমের ছেলে আরাফাত (২৫), একই গ্রামের আনোয়ার হোসেন (৩৩), সিয়াম (১৪) ও খানাতুয়া গ্রামের সামছুল হক (৫০), আবুল কালাম (৪৫), ফয়সাল হোসেন (২১), নজির আহমেদ (৩০), আবদুস সাত্তার, সিদ্দিকুর রহমানসহ আরো ৬জন।
এদিকে দুই গ্রামবাসীর সংঘর্ষের ঘটনার পর থেকে এলাকায় থমথমে অবস্থা বিরাজ করছে। বাজারের অনেক দোকান-পাট বন্ধ রয়েছে।
দুই গ্রামের সংঘর্ষের ঘটনায় বাজারের একাধিক ব্যবসায়ী জানান, এলাকার গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গের সমন্বয়ে আলোচনাক্রমে এ ঘটনার স্থায়ী মিমাংসা হওয়া দরকার। তা না হলে ভবিষ্যতে পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ রূপ ধারণ করবে বলে আশংকা করছেন তাঁরা।
আশিরপাড় বাজারের ওষুধ ব্যবসায়ী মো. হুমায়ুন জানান, রাত সাড়ে ৮টার দিকে আশিরপাড় গ্রামের ৩/৪জন ছেলে আমার ফার্মেসীর পাশের ফল দোকানদার আরাফাতের সঙ্গে দাঁড়িয়ে কথা বছিলো। এ সময় ৬/৭ যুবক ও কিশোর দেশীয় অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে আকস্মিক ভাবে অতর্কিত হামলা চালিয়ে ফল ব্যবসায়ী আরাফাতসহ ৩জনকে কুপিয়ে আহত করে। ওই স্থানীয় দু’জন লোক এদের থামাতে চাইলে হামলাকারীরা তাঁদেরকেও কুপিয়ে আহত করে।
তিনি জানান, হামলাকারীদের হাতে দেশীয় অস্ত্রশস্ত্র দেখে প্রণভয়ে বাজারের ব্যবসায়ীরা দ্রুত দোকান-পাট বন্ধ করে ফেলেন। বাজারের ক্রেতা-বিক্রেতাসহ পথচারীরা প্রাণভয়ে দিগবিদ্বিগ ছুটাছূটি শুরু করেন। এ খবর ছড়িয়ে পড়লে উভয়পক্ষের লোকজন দেশীয় অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে তুমুল সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে।
আশিরপাড় গ্রামের বাসিন্দা মোরশেদ আলম মানিক জানান, কিছু কেনাকাটা করতে বাজারে আসি। হঠাৎ দেখি ফল ব্যবসায়ী আরাফাতকে পাশের খানাতুয়া গ্রামের শামিম, ফয়সাল, হৃদয়, শাহাবুদ্দিন, মহিনসহ কয়েকজনে মিলে মারধর করছে। এমতবস্থায় আমিসহ আরো দু’জন এগিয়ে গিয়ে কি হয়েছে জানতে চাই এবং গন্ডগোল করতে তাদের বারণ করি। এ সময় তারা ক্ষিপ্ত হয়ে আমাকেসহ আমার ছেলে সিয়াম, ভাতিজা আরাফাত এবং আবু ছায়েদকে কুপিয়ে রক্তাক্ত জখম করে। এ ছাড়াও তাদের হামলায় আমাদের গ্রামের ১০/১২জন আহত হন। এ ছাড়াও হামলাকারীরা বাজারের ১২/১৩টি দোকানে ভাংচুর ও লুটপাট চালায়।
এদিকে খানাতুয়া গ্রামের বাসিন্দা নুর মোহাম্মদ জানান, আশিরপাড় বাজারে অধিকাংশ ব্যবসায়ীর বাড়ি খানাতুয়া গ্রামে। আশিরপাড় গ্রামের লোকজন বেশ কিছু দিন বাজারটি নিজেদের নিয়ন্ত্রণে রাখার পাঁয়তারা করছে।বাজারের আশপাশের সরকারি জায়গা দখলে চেষ্টা চালাচ্ছে। এসব বিষয়ে নিয়ে আমরা প্রতিবাদ করলে তাঁরা আমাদের ওপর হামলা চালায়।
তিনি জানান, ওইসব ঘটনার জের ধরে পূর্ব পরিকল্পিত ভাবে মঙ্গলবার (২৯ এপ্রিল) রাতে আশিরপাড় গ্রামের কয়েকজন যুবক আমাদের গ্রামের লোকজনকে বাজারে পেয়ে কুপিয়ে আহত করে। এতে প্রায় ১০ জন আহত হয়। তন্মধ্যে মধ্যে ২জনকে আশঙ্কাজনক অবস্থায় ঢাকার একটি হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। এ ছাড়াও আমাদের গ্রামের ব্যবসায়ীদের কমপক্ষে ১০টি দোকানে হামলা চালিয়ে ভাংচুর করেছে। হামলাকারীরা দোকানের মালামাল ও নগদ টাকা লুটপাট করে নিয়ে গেছে।
এই ব্যাপারে মনোহরগঞ্জ থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) বিপুল চন্দ্র দে বুধবার (৩০ এপ্রিল) রাতে কালের কন্ঠকে জানান, আশিরপাড় বাজারে দুই গ্রামবাসীর মধ্যে পূর্বের ঘটনার জের ধরে সংঘর্ষের সূত্রপাত ঘটে।
সংবাদ পেয়ে সেনাবাহিনী ও পুলিশ দ্রুত ঘটনাস্থলে গিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনেন। এ ঘটনায় বেশ কয়েকজন আহত হয়েছেন বলে জানা গেছে। এখন পর্যন্ত কেউ থানায় কোনো অভিযোগ করেননি। অভিযোগ পেলে প্রয়োজনীয় আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।