Thursday, May 8
Shadow

শাহ আলমের জমি কারসাজি: রেলের সম্পদে গড়েছেন সাম্রাজ্য

আরমান আহমেদ, প্রধান প্রতিবেদক: ফ্যাসিবাদি হাসিনা সরকারের পতন হলেও এখনও সংস্কার হয়নি বন্দরনগরী চট্টগ্রামের সেন্ট্রাল রেলওয়ে বিল্ডিং (সিআরবি)-এর অনেক চক্র। এখনও সেখানে আতঙ্কের নাম শাহ আলম সিন্ডিকেট। পূর্বাঞ্চল রেলের জমি লিজ নেয়াই যেন মূল পেশা। কখনো নিজের নামে, কখনো স্ত্রী ইয়াসমিন আলমের নামে তিনি চতুরভাবে রেলের জায়গা ও দোকানপাট হাতিয়ে নেন। এসব জমিতে কখনো তৈরি করেন রেস্টুরেন্ট, কখনো স্কুল, আবার কখনো বিশাল মার্কেট—যা পরে তিনি তৃতীয় পক্ষকে ভাড়া দিয়ে মোটা অঙ্কের টাকা আয় করেন। এসব কার্যক্রমে তিনি রেল বিভাগের বিভিন্ন শাখা ও ক্ষমতাধর মহলের সহায়তা নিয়ে থাকেন বলে অভিযোগ রয়েছে।

শাহ আলমের দাপটে চলছে গোটা রেলওয়ের টেন্ডার, ইজারা ও দখল বাণিজ্য। অভিজ্ঞতার ভুয়া সনদ দিয়ে প্রভাব খাটিয়ে রেল সচিবালয় ভবন ও পদ্মা রেল প্রজেক্টের মতো স্পর্শকাতর প্রকল্পের কাজও বাগিয়ে নিয়েছে এই চক্রে জড়িত অদক্ষ ঠিকাদাররা।

জানা যায়, সাবেক রেলমন্ত্রী সুজনের আত্মীয় শাহ আলম এখন বিএনপির সঙ্গে সখ্যতা গড়ার চেষ্টায় আছেন

চট্টগ্রামের সিআরবি এলাকায় স্ত্রীর নামে ৫০০-৬০০ বর্গফুট রেল জমি লিজ নিয়ে তৈরি করেছেন তাসফিয়া গার্ডেন নামের একটি রেস্টুরেন্ট। আইস ফ্যাক্টরি রোড এলাকায় রেলের জমিতে স্থাপন করেছেন স্বপ্নীল গ্রামার স্কুল, যেখানে তিনি নিজেই প্রতিষ্ঠাতা অধ্যক্ষ।

এ ছাড়া এক বছরের জন্য ২.৩ একর জমি লিজ নিয়ে নির্মাণ করেছেন “শাহ আমানত মার্কেট”। অথচ শর্ত ছিল, এই জমিতে কোনো স্থায়ী বা পাকা স্থাপনা নির্মাণ করা যাবে না।

রেলের ভূসম্পদ বিভাগ জানিয়েছে, উক্ত লাইসেন্স ছিল পুরোপুরি অস্থায়ী। প্রয়োজন হলে রেল কর্তৃপক্ষ এক মাসের নোটিশে জমি দখলে নিতে পারবে। কিন্তু শাহ আলম মার্কেট নির্মাণ করে দীর্ঘমেয়াদি দোকান বিক্রয় করেছেন—যার প্রতিটির মূল্য ১৫ থেকে ২৫ লাখ টাকা পর্যন্ত বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীরা।

দুদকের একটি টিম ইতোমধ্যে সরেজমিন পরিদর্শন করেছে। জানা গেছে, কম মূল্যে ইজারা নিয়ে নিয়ম লঙ্ঘন করে মার্কেট গড়া হয়েছে। এমনকি, শাহ আলম নাকি রেলের তৎকালীন জেনারেল ম্যানেজারের স্বাক্ষর জাল করে জমি ইজারা নিয়েছেন। রেলের বিভিন্ন ট্রেনের খাবার সরবরাহ, হোটেল লিজ, এমনকি রেল স্টেশনের পার্কিং দখলেও তার সম্পৃক্ততা রয়েছে।

এইভাবে রেলওয়ের সম্পদে গড়ে উঠেছে এক ‘শাহ সাম্রাজ্য’, আর লোকসানে ডুবে যাচ্ছে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানটি।

২০১৮ সালের শেষের দিকে আইসফ্যাক্টরি রোডে শাহ আলম রেলের জমি লিজ নিয়েছেন ২ দশমিক ০৩ একর। তারপরও তার নজর সরেনি রেলের জমি থেকে। আশেপাশে আরো এক দশমিক ৬৮ একর জমি দখলে নিয়ে শক্ত স্থাপনায় গড়ে তুলেছেন মার্কেট। প্রতিটি দোকান দীর্ঘমেয়াদী চুক্তি করে বিক্রি করেছে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে বেশ কয়েকজন ব্যবসায়ী জানান, কোনটি ১৫ লাখ কোনটি ২০ লাখ আবার কোনটি ২৫ লাখ টাকায় দীর্ঘ মেয়াদী চুক্তিতে দোকান কিনেছেন ব্যবসায়ীরা।

অভিযোগ আছে, নিজেদের মালিকানাধীন ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ছাড়াও অন্যান্য প্রতিষ্ঠানকে কাজ বাগিয়ে দিতেও তারা সহযোগিতা করে। এক্ষেত্রে কাজ পেতে ১০ পার্সেন্ট কমিশন গুনতে হয় ঠিকাদারদের। এর মধ্যে কাজভেদে ২-৫ পার্সেন্ট প্রধান প্রকৌশলী, ২ পার্সেন্ট জেনারেল ম্যানেজার এবং ১ পার্সেন্ট অর্থ ডিএনকে (ডিভিশনাল চিফ) দিতে হয় বলে অভিযোগ আছে। বাকি অর্থ যায় সিন্ডিকেট হোতাদের পকেটে।

রেলওয়ের শুধু একটি ডিভিশনের (ডিএন-৩) সংশ্লিষ্ট দপ্তরের সঙ্গে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের চুক্তিপত্র পর্যালোচনা করে দেখা যায়, সিন্ডিকেটভুক্ত চট্টগ্রামের ছয়টি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান গত দুই বছরে ঢাকার অন্তত ১১টি কাজ বাগিয়ে নিয়েছে। এর মধ্যে রেলওয়ের শীর্ষ ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের একটি তমা কনস্ট্রাকশন রেল সচিবালয় ভবনের দুটি ফ্লোরের (৯ ও ১০ তলা) ১৭ কোটি ৪৮ লাখ টাকার এবং পদ্মা রেল লিংক প্রজেক্টের ১ কোটি ৬৪ লাখ টাকার কাজও বাগিয়ে নিয়েছে। সংশ্লিষ্টদের অভিযোগ, অসৎ কর্মকর্তাদের যোগসাজশে রেল ভবনের কাজের বরাদ্দ দ্বিগুণ বাড়িয়ে ৩৩ কোটি টাকা করার দুরভিসন্ধি চূড়ান্ত করা হয়েছে।

জানা যায়, ঢাকা-চট্টগ্রাম চলাচলকারী সুবর্ণা এক্সপ্রেস, তূর্ণা নিশিথা, চট্টগ্রাম-সিলেট চলাচলকারী পাহাড়িকা উদয়ন ও ঢাকা-মহনগঞ্জ রুটের হাওড় এক্সপ্রেসের অনবোর্ড ঠিকাদারি (ক্যাটারিং ও জনবল সরবরাহ) ১৪ বছরের বেশি সময় কবজায় রেখেছেন শাহ আলম।

জানা যায়, প্রতিবছর টেন্ডারের মাধ্যমে এ কাজের ঠিকাদার নির্ধারণ করার নিয়ম থাকলেও তা করা হচ্ছে না। রেলের অসৎ কর্মকর্তাদের ম্যানেজ করে গোপনে ইজারার মেয়াদ বাড়িয়ে নেন তিনি। কর্মকর্তাদের মনোরঞ্জন ও ঘুস লেনদেনের জন্য ৩৩ সেগুনবাগিচায় নাভানা বিল্ডিংয়ের ৪/৩ নম্বর ফ্ল্যাট কিনে রেখেছেন শাহ আলম।

এ সব অভিযোগের বিষয়ে মন্তব্য নিতে বেশ কয়েকবার ফোন করা হলেও ফোন রিসিভ করেননি শাহ আলম।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *