Sunday, July 27
Shadow

আমতলীতে ত্রিশ বছর পর ফিরেছে ইউনিয়ন পরিষদের সেবা

মোঃ রাজু, আমতলী বরগুনা : প্রায় ত্রিশ বছরের রেওয়াজ ভেঙ্গে হঠাৎ করেই বিলুপ্ত হয়েছে আমতলী উপজেলা শহরে গড়ে তোলা অস্থায়ী ইউনিয়ন পরিষদের কার্যালয়। চালু হয়েছে ইউনিয়ন পরিষদের কমপ্লেক্স ভবনে সেবা কার্যক্রম। মাত্র দেড় মাস সমযের মধ্যে আমতলী পৌরসভার হোল্ডিং ট্যাক্স, পানি, ট্রেডলাইসেন্স, নিজস্ব ওয়েব সাইট চালু, বিভিন্ন ধরনের সনদ প্রদানসহ ৪৫টি সেবা কার্যক্রম ডিজিটালের কাজ শরু করে তা বাস্তবায়ন করছেন। এসব দুঃসাহসী কার্যক্রম গ্রহণ করেছেন আমতলী উপজেলায় সদ্য যোগদান করা ইউএনও মো. রোকনুজ্জামান খান তিনি আমতলী পৌরসভা ও পরিষদের প্রশাসকও। 

ইউএনও রোকনুজ্জামান খান যোগদানের স্বল্প সময়ের মধ্যেই স্থাপন করেছেন অস্থায়ী ডাম্পিং স্টেশন, পৌর ভবনে ব্যাংক, চালু করেছেন- ইউনিফরমসহ পৌর পুলিশিং, পানি সরবরাহের অকেজো পাম্প ও অন্যান্য যন্ত্রাংশ মেরামত করে পানি সেবা নির্বিঘ্ন করেছেন এবং পানির স্থায়ী সমস্যা নিরসনে নতুন কূপ খনন ও পাম্প স্থাপনের জন্য টেন্ডার আহবান করেছেন। তিনি পরিত্যাক্ত শিশু পার্ককে চালু করার জন্য কার্যক্রম গ্রহণ ও জনগনের দোড় গোড়ায় সেবা সহজলভ্য করা ও উপজেলাকে সুন্দর করে সাজানোর জন্য একগুচ্ছ পরিকল্পনা গ্রহণ করেছেন। ৩৯৯ বর্গ কিলোমিটারের আমতলী উপজেলায় প্রায় সোয়া দুই লাখ মানুষের বসবাস যেখানে ৭টি ইউনিয়ন ও ১টি পৌরসভা রয়েছে। এসকল কার্যক্রমের জন্য ইতিমধ্যেই প্রশংসা কুড়িয়েছেন সদ্য যোগদান করা উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) মো. রোকনুজ্জামান খান। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইতিহাসে পাশ করা ৩৫তম ব্যাচের এই কর্মকর্তা নোয়াখালী জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট, জামালপুরের ইসলামপুরে এসি (ল্যান্ড), নেত্রকোণায় সিনিয়র সহকারী কমিশনার, পাথরঘাটায় উপজেলা নির্বাহী অফিসার হিসেবে অত্যন্ত বিচক্ষণতা ও সুনামের সাথে দায়িত্ব পালন করেন। ৫ আগস্ট ছাত্রজনতার বিপ্লবের মাধ্যমে সরকারের পতনের সময় পাথরঘাটাবাসীর জানমালের নিরাপত্তাসহ আইশৃঙ্খলা স্বাভাবিক রাখায় তিনি সেখানকার মানুষের মন জয় করেছিলেন। গত ১৩ মে ইউএনও মো. রোকনুজ্জামান খান পাথরঘাটা থেকে বদলী হয়ে আমতলী উপজেলায় যোগদান করেন। ইউএনও মো. রোকনুজ্জামান খান যোগদানের পর বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের সাথে মত বিনিময় করে পরবর্তী কার্যক্রমের লক্ষ নির্ধারণ করেন।

সরকারী নির্দেশনা ভঙ্গ করে ৭টি ইউনিয়ন পরিষদের মধ্যে কুকুয়া ইউনিয়ন ব্যতীত সকল ইউনিয়ন পরিষদের অস্থায়ী কার্যালয় ছিলো আমতলী উপজেলা শহরে। শহর থেকে ইউনিয়নের গড় দূরত্ব প্রায় ১৫ থেকে ২০ কিলোমিটার এবং উপজেলা সদর থেকে ইউনিয়নের শেষ সীমা ও গ্রামগুলোর দূরত্ব প্রায় ৩০ কিলোমিটার। গ্রাম ও ইউনিয়নের রাস্তাগুলো অবস্থা খুবই নাজুক। ইউনিয়ন পরিষদের সকল সেবা গ্রহণের জন্য দূর-দূরান্ত থেকে সেবা প্রত্যাশীদের আসতে হতো উপজেলা শহরে। একদিকে যেমন মূল্যবান সময়, অপরদিকে প্রায় ১০০-২৫০টাকা ব্যয় হয়ে যেতো। ইউনিয়ন পরিষদের এসব দূর্ভোগ ছিলো নিত্য দিনের এবং ইউনিয়ন ভেদে তা প্রায় ২৫-৪০বছরের। অপরদিকে ইউনিয়ন পরিষদের জন্য ইউনিয়ন পরিষদের জন্য স্থায়ী ভবন নির্মিত হলেও সেই সব ভবনে পরিচালিত হয়নি ইউনিয়ন পরিষদের কার্যক্রম। ফলশ্রুতিতে পরিষদের ভবনগুলো অযত্ন-অবহেলায় নষ্ট হতে থাকে। বর্তমান ইউএনও ইউনিয়ন পরিষদগুলোর সাথে আলোচনা, পত্র প্রদান ও পরিদর্শন করে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণের হুসিয়ারি দেওয়ার ফলে অবশেষে জুন মাসের ১৫-২৫তারিখের মধ্যে সকল ইউনিয়ন পরিষদ স্ব স্ব ইউনিয়নে স্থাপিত ইউনিয়ন পরিষদগুলোতে কার্যক্রম শুরু করেন।

অপরদিকে আমতলী পৌরসভার তথ্য ও সেবা ব্যবস্থাপনা নাজুক থাকায় হোল্ডিং ট্যাক্স বিল, পানি বিল, ট্রেডলাইসেন্স, বিভিন্ন ধরণের সনদের তথ্য অনলাইনে অন্তর্ভূক্ত করে সঠিক তথ্য ও ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে সেবা কার্যক্রম চালু করা হয়। এতে পৌরসভার সঠিক তথ্যগুলো স্থায়ীভাবে সংরক্ষিত হচ্ছে, নাগরিকগণ সহজে তাদের তথ্য ও সেবা গ্রহণ করছে, ব্যবস্থাপনায় সচ্ছতা ও আর্থিক সচ্ছতা বৃদ্ধি পেয়েছে। গ্রাহকের হিসাব ও বকেয়া আদায় সহজযোগ্য হয়েছে। সকল লেনদেন ও আর্থিক হিসাব অনলাইন ও পৌরসভায় স্থাপিত ব্যাংকিং সিস্টেমের মাধ্যমে পরিচালিত হওয়া পৌরসভার আর্থিক সচ্ছতা বৃদ্ধি পেয়েছে। চালু করা হয়েছে ওয়েব সাইট যা পৌরসভার বিভিন্ন তথ্য প্রদান ও অভিযোগ প্রতিকার ব্যবস্থা নিশ্চিত করছে। এডিপি’র ১৩টি প্রজেক্টের আওতায় উন্নয়ন প্রকল্পের কাজ শুরু করা হয়েছে। ইতোমধ্যে বরগুনা-আমতলী প্রজেক্টের আওতায় আমতলী পৌরসভাকে ১৮কোটি টাকার প্রকল্পে অন্তর্ভূক্ত করা হয়েছে। পৌরসভার প্রতিটি সেকশন এখন ডিজিটাল ও গোছানো রূপে সেজেছে। পৌরবাসীর দীর্ঘদিনের দাবি পূরণে পৌর কবরস্থান সংস্কার ও আধুনিয়কায়নের কার্যক্রম এগিয়ে চলছে। এসব ছাড়াও নানা পরিকল্পনায় পৌরবাসীর উন্নয়নে জনগণের চাহিদা ভিত্তিক প্রকল্প সংগ্রহ ও যাচাই-বাছাইয়ের কার্যক্রম চলমান।

অপরদিকে উপজেলা পরিষদের অভ্যন্তরে জাতীয় স্থাপনাগুলোর আদলে স্মৃতি সৌধ ও শহীদ মিনার নির্মাণের কার্যক্রম শুরু হয়েছে। একই সাথে মুক্ত মঞ্চ, পুকুরে ঘাটলা নির্মাণ, দীর্ঘদিনের বাতিল ঘোষিত স্থাপনাসমূহ নিলামের মাধ্যমে অপসারণ, পরিচ্ছন্নতা কার্যক্রম শুরু করেছেন। এতে আমতলী পৌরবাসীর মধ্যে এক ধরনের স্বস্থি ফিওে এসেছে।

আঠারগাছিয়া ইউনিয়ন পরিষদের সংরক্ষিত আসনের নারী সদস্য মুকুল বেগম বলেন, প্রায় ৩০বছর ধরে ইউনিয়ন পরিষদ উপজেলায় তার কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছে। নতুন ভবন হওয়ার পরেও তা ব্যবহার না হয়ে তালাবদ্ধ অবস্থায় অধিকাংশ ইউনিয়ন পরিষদ কমপ্লেক্স ভবনগুলো পরে ছিলো। ইউএনও রোকনুজ্জামান স্যার যোগদানের পর কমপ্লেক্স ভবনে চেয়ারম্যানদের অফিস করার আদেশ জারি মধ্যে দিয়ে আবার সচল হয়ে উঠেছে পরিষদগুলো। এজন্য স্যারকে অনেক ধন্যবাদ জানাই। কুকুয়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান বোরহান উদ্দিন আহম্মেদ মাসুম তালুকদার জানান, ইউনিয়ন পরিষদ কমপ্লেক্সে চেয়ারম্যান ও সদস্যদের অফিস করার আদেশ ইউএনও স্যারের একটি যুগান্তকারী সিদান্ত। এই আদেশের ফলে ইউনিয়ন পরিষদগুলো পূর্বের ন্যায় আবার সচল হয়ে উঠবে। এজন্য আমি রোকনুজ্জামান স্যারকে অনেক ধন্যবাদ ও অভিনন্দন জানাই। এছাড়া ইউএনও মো. রোকনুজ্জামান খান আমতলী পৌরসভার প্রশাসক হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার পর দেখেন এক বিশৃঙ্খল অবস্থা। পানির সংকট, ডাম্পিং ষ্টেশন না থাকায় বজের্যর বিষে নাকাল পৌরবাসী। সব মিলিয়ে নাগরিক সেবা থেকে বঞ্চিত পৌর ভবন সেবা বিমুখ মানুষকে অল্প সময়ের মধ্যে অস্থায় ফিরিয়ে এনে এক আধুনিক সেবার জায়গায় দার করিয়েছেন আমতলী পৌরসভাকে। ইউএনও রোকনুজ্জান পৌরসভার দায়িত্ব গ্রহনের অল্প দিনের মধ্যেই তিনি আমতলীর উরশিতলায় একটি জমি ভাড়া নিয়ে সেখানে অস্থায়ী ডাম্পিং স্টেশন নির্মান করায় পৌরবাসীর দীর্ঘদিনের একটি দাবী বাস্তবায়ন করেছেন। আমতলী পৌরসভায় পানির সমস্যা ছিল প্রকট। দিন রাত চাতক পাখির মত পানির জন্য পৌরবাসীকে তাকিয়ে থাকতে হত। সে সমস্যা দ্রুত সমাধান করায় এখন নিয়মিত ২৪ ঘন্টা পানি পাচ্ছে পৌরবাসী। তিনি পানি সমস্যা মোকাবেলা করার জন্য নতুন একটি পাম্প বসানোরও উদ্যোগ নেন। ইতোমধ্যে টেন্ডার আহবান করেছেন। নাগরিক, জন্ম-মৃত্যসহ নানা কাজের জন্য নাগরিকদেও দিনের পর দিন পৌরসভায় ঘুরতে হত মানুষকে। ইউএনও রোকনুজ্জামান খান মানুষের কষ্ট লাগবের জন্য জন্ম মৃত্যু ও নাগরিক সনদ, পৌরকর, পানির বিলসহ ৪৫টি নাগরিক সেবা আধুনিকায়কন করে ডিজিটাল ব্যবস্থা চালু করেছেন। এ ব্যবস্থায় একজন নাগরিক ঘরে বসেই আবেদন করে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে তার কাঙ্খিত সেবা পেয়ে থাকেন। পৌরনাগরিকদের বিভিন্ন পরিসেবার আর্থিক লেন দেনের সুবিধার জন্য পৌরভবনের নীচতলায় ইউসিবি ব্যাংকের একটি বুথ চালু করায় সেখানে বিল পরিশোধ করতে পারায় মানুষের কষ্ট লাঘব হয়েছে বহু গুন। তিনি পৌর পুলিশিং ব্যবস্থা সচল করেছেন। পরিবর্তন এনছেন পোশাকেও। ইতোমধ্যে তিনি পৌরসভার অভ্যন্তরে ১৩টি প্রকল্পের কাজ শুরু করেছেন। আমতলী উপজেলাবাসীর প্রানের দাবীর প্রতি নজর দিয়ে ইউএনও আমতলীতে যোগদানের পর এই প্রথম জাতীয় শহীদ মিনার এবং স্মৃতিসৌধের আদলে আমতলী উপজেলা পরিষদের অভ্যন্তরে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার, মুক্ত মঞ্চ ও স্মৃতিসৌদ নির্মানের উদ্যোগ নিয়েছেন। তিনি শিশুদের কথা বিবেচনা করে পরিত্যাক্ত শিশু পার্কটি সংস্কার করে শিশুদের খেলার যুগউপযোগী করার কাজ শুরু করেছেন। 

যোগদানের অল্প সময়ের মধ্যে ইউএনও’র নানামুখী উদ্যোগের সুফল পাচ্ছে পৌরবাসী। পৌরসভার ছয় নম্বর ওয়ার্ডের গৃহবধূ আলেয়া বেগম বলেন, রান্নাসহ যে কোন গৃহস্থলি কাজে পৌরসভার সাপ্লাইয়ের পানি পাওয়া যেত না। স্যারে আসার পর এখন সব সময় পানি পাওয়া যায়। আমরা ইউএনও মো. রোকনুজ্জামান খান স্যারের উপর অনেক খুশি। আমতলী পৌরসভার বাসিন্দা মানবাধিকার কর্মী আবু জিয়াদ বলেন, ইউএনও রোকনুজ্জামান খান স্যারে যোগদানের আগে আমরা খুব পানি সমস্যায় ভূগতাম। ময়লার দূর্গন্দেও থাকা যেত না। এখন সে সমস্যা নেই অল্প সময়ের মধ্যে তিনি পানি সমস্যা সমাধান এবং ডাম্পিং স্টেশন করায় পৌরবাসী স্যারের উপর দারুন খুশি। এছাড়া তিনি প্রথমবারের মত নাগরিক সনদ, জন্ম-মৃত্যু সনদসহ ৪৫টি সেবায় ডিজিটাল ব্যবস্থা চালু করায় পৌরসভার সেবা পেতে নাগরিকদের এখন আর ভোগান্তি পোহাতে হয় না। পৌর ভবনের নীচতলায় ব্যাংকের বুথ করায় পানিসহ নানা ধরনের বিলও সেখানে দেওয়ার ব্যবস্থা করায় উচ্ছসিত পৌরবাসী। 

আমতলী উপজেলা নির্বাহী অফিসার মো. রোকনুজ্জামান খান বলেন, কাজগুলোকে নিজস্ব ভাবলেই কেবল বুঝতে পারা যায় আমাদের কি করা প্রয়োজন এবং সেটা করতে পারলেই জনগণের কাঙ্খিত সেবা দোড় গোড়ায় পৌছানো সম্ভব। সরকারি বিধি মোতাবেক কাজ করলেই দায়িত্ব ও সেবা সহজলভ্য হয়। অনেক তরুণ আছেন যারা নিজের ইউনিয়নে ইউনিয়ন পরিষদ দেখে নাই, অথচ ইউনিয়নের সেবা স্ব ইউনিয়ন থেকে পাওয়াটি ছিলো তার অধিকার। আমাদের উচিত সেবাকে জনগনের দোড় গোড়ায় পৌঁছে দেওয়া।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *