এক সময় কেবলমাত্র শিক্ষার একটি ধাপ হিসেবে বিবেচিত হতো উচ্চশিক্ষা। আজকের দিনে এসে উচ্চশিক্ষা মানেই যেন গবেষণার সঙ্গে এক অদৃশ্য বন্ধনে আবদ্ধ একটি অগ্রযাত্রা। শুধু স্নাতক বা স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করলেই চাকরি বা ক্যারিয়ারে সাফল্য আসবে—এই ধারণা এখন অনেকটাই পুরোনো। বর্তমানে, গবেষণাধর্মী শিক্ষা ও দক্ষতা অর্জনই হয়ে উঠেছে উন্নত ক্যারিয়ার গঠনের মূল চাবিকাঠি, দেশেই হোক বা বিদেশে।
বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে শিক্ষার মূল উদ্দেশ্য হওয়া উচিত জ্ঞান অর্জনের পাশাপাশি জ্ঞান সৃষ্টি ও তার প্রয়োগ। আর সেই প্রয়োগের সবচেয়ে কার্যকর মাধ্যম হলো গবেষণা। উন্নত বিশ্বে এমনকি আমাদের প্রতিবেশী অনেক দেশেও উচ্চশিক্ষা মানেই গবেষণাভিত্তিক শিক্ষার অনুশীলন। গবেষণা শুধুমাত্র নতুন জ্ঞান সৃষ্টি করে না, বরং একজন শিক্ষার্থীকে বিশ্লেষণ, সিদ্ধান্ত গ্রহণ এবং বাস্তব সমস্যা সমাধানে সক্ষম করে তোলে।
দেশে কিংবা বিদেশে ভালো চাকরি পেতে শুধু সার্টিফিকেট নয়, দরকার চিন্তা ও বিশ্লেষণের সক্ষমতা, প্রাসঙ্গিক জ্ঞান, এবং নতুন কিছু ভাবার ও করার ক্ষমতা। এই দক্ষতাগুলো গড়ে ওঠে গবেষণার মাধ্যমে। তাই উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করতে ইচ্ছুক শিক্ষার্থীদের জন্য গবেষণাভিত্তিক প্রস্তুতি অপরিহার্য।
বাংলাদেশে গবেষণা ও প্রকাশনার অন্যতম বড় চ্যালেঞ্জ হলো পর্যাপ্ত তহবিল ও অবকাঠামোগত সুবিধার অভাব। অধিকাংশ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে গবেষণার জন্য নির্ধারিত বাজেট সীমিত এবং গবেষকরা প্রয়োজনীয় ল্যাব, সফটওয়্যার বা ডেটাবেইস অ্যাক্সেস পান না। পাশাপাশি, আন্তর্জাতিক মানের গবেষণার জন্য যেসব প্রশিক্ষণ, পরামর্শ বা পিয়ার রিভিউ প্রক্রিয়া প্রয়োজন, সেগুলোর সুযোগও খুব সীমিত। অনেক সময় মেধাবী গবেষকরা ভালো আইডিয়া ও উদ্যোগ থাকা সত্ত্বেও উপযুক্ত নির্দেশনা ও মেন্টরশিপের অভাবে এগোতে পারেন না। অন্যদিকে, মানসম্মত জার্নালে গবেষণাপত্র প্রকাশে ইংরেজি ভাষার দুর্বলতা, প্রবন্ধ লেখার কৌশল না জানা এবং প্রক্রিয়াগত জটিলতাও অন্যতম বাধা হয়ে দাঁড়ায়। এসব কারণে নতুন ও প্রারম্ভিক পর্যায়ের গবেষকদের জন্য গবেষণা ও প্রকাশনা একটি দুরূহ কাজ হয়ে ওঠে। এই প্রেক্ষাপটে, দলভিত্তিক উদ্যোগ, মেন্টরশিপ, এবং পেশাদার প্রশিক্ষণ অত্যন্ত জরুরি।
এই প্রেক্ষাপটে একটি উল্লেখযোগ্য উদ্যোগ হচ্ছে MERNet—Monitoring, Evaluation and Research Network। এটি একটি গবেষণা-সহায়ক প্ল্যাটফর্ম, যা নবীন ও প্রারম্ভিক পর্যায়ের গবেষকদের একটি দলভিত্তিক পদ্ধতিতে গবেষণার সুযোগ করে দেয়। MERNet-এর গবেষণার ধরনটি ভিন্ন। এখানে একজন অভিজ্ঞ গবেষক বা মেন্টরের নেতৃত্বে একাধিক গবেষক একটি নির্দিষ্ট থিমের ওপর যৌথভাবে কাজ করেন। বিষয়ভিত্তিক নির্দেশনা, পেপার রিভিউ, প্রকাশযোগ্য মানে উন্নীতকরণ এবং উপযুক্ত জার্নালে প্রকাশ—সব কিছুতেই মেন্টরের সহযোগিতা পাওয়া যায়।
এই উদ্যোগের বিশেষত্ব হলো, এটি গবেষকদের শুধু গবেষণায় যুক্ত করে না, বরং তাদের একাডেমিক এবং পেশাগত পথনির্দেশনার একটি শক্ত ভিত গড়ে তোলে। অনেক তরুণ গবেষক MERNet-এর মাধ্যমে তাঁদের প্রথম গবেষণাপত্র প্রকাশ করেছেন, যা তাঁদের জন্য বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়ে স্কলারশিপ পাওয়ার ক্ষেত্রে সহায়ক হয়েছে।
বিদেশে গবেষণার সুযোগ পাওয়ার ক্ষেত্রেও অভিজ্ঞতা, প্রকাশনা, এবং একটি শক্তিশালী গবেষণা প্রস্তাব অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। MERNet-এর মতো প্ল্যাটফর্ম তরুণদের এ প্রস্তুতি নিতে সহায়তা করে। এটি শুধু একাডেমিক প্রস্তুতির ক্ষেত্রেই নয়, বরং আত্মবিশ্বাস, নেটওয়ার্কিং, এবং বাস্তব সমস্যা নিয়ে কাজ করার অভিজ্ঞতা প্রদান করে।
অতএব, উচ্চশিক্ষা যদি হয় কাঙ্ক্ষিত সাফল্যের দরজা, তবে গবেষণা সেই দরজার চাবি। দেশ কিংবা বিদেশে, ভালো চাকরি কিংবা উচ্চতর শিক্ষার জন্য গবেষণাকেন্দ্রিক প্রস্তুতির কোনো বিকল্প নেই। MERNet-এর মতো প্ল্যাটফর্মগুলো এ ক্ষেত্রে তরুণদের জন্য আলোর দিশা হতে পারে।
আজকের তরুণ গবেষকেরা যদি দলগতভাবে গবেষণায় যুক্ত হয়, মেন্টরদের সহায়তায় থিমভিত্তিক জ্ঞান সৃষ্টি করেন, তবে দেশীয় সমস্যার সমাধানে এবং আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে দেশের প্রতিনিধিত্বে তাঁরা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারবেন।
রাকিব হোসেন, পিএইচডি ফেলো
অর্থনীতি বিভাগ, খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়