Saturday, May 24
Shadow

মাগুরা ও ঝিনেদাহ ‘কোর্ট ভিজিট’ এ আমরা

তামান্না ইসলাম, শিক্ষার্থী, আল ফিকহ এন্ড লিগ্যাল স্টাডিজ বিভাগ, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় কুষ্টিয়া : “সকলের জন্য ন্যায়বিচার থাকলেই প্রকৃত শান্তি অর্জিত হতে পারে।” – ডেসমন্ড টুটুর এই উক্তির বাস্তবতা পরোক্ষ করতে আমরা ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের আল ফিকহ এন্ড লিগ্যাল স্টাডিজ বিভাগের এক ঝাঁক শিক্ষার্থী গিয়েছিলাম মাগুরা ও ঝিনেদাহ কোর্ট ভিজিটে। ফৌজদারি কার্যবিধি কোর্সের অংশ হিসেবে কোর্স টিচার প্রোফেসর ড. আলতাফ হোসেন স্যারের তত্তাবধানে আমরা ফৌজদারি বিচার প্রক্রিয়া সরেজমিনে দেখতে গত ৮ ই মে, বৃহস্পতিবার ২০২৫ মাগুরা ও ঝিনেদাহ কোর্ট ভিজিটে গিয়েছিলাম।

পূর্ব আকাশের বুক চিরে রক্তিম আভার ন্যায় সূর্য মামা উকি দেওয়ার আগেই আমরা জিয়া মোড়ে এসে উপস্থিত হই। ৬.৪৫ এ মেইন গেট থেকে গাড়ি ছাড়ার কথা থাকলেও অনিবার্য কারণবশত কিছুটা দেরি হয়ে গেল আমাদের গাড়ি ছাড়তে। আমরা বিশ্ববিদ্যালয়ের দুইটা গাড়ি নিয়েছিলাম। বাসগুলোর সাথে আমাদের আবেগ জড়িয়ে আছে। এই বাসে উঠবো বলে একদা কঠোর পরিশ্রম করেছি। আজ সেই স্বপ্নের বাসে উঠে বসেছি। আমরা মেইন গেট থেকে রউনা হলাম। পথিমধ্যে বসন্তপুর সংলগ্ন রাস্তার পাশে আমাদের দু’জন সহপাঠী অপেক্ষা করছিল। তাদের পেয়ে আমার ভীষণ খুশি। আমরা একে অপরের সাথে খোশগল্পে মেতে উঠেছি। কিন্তু আমাদের এই আনন্দের যাত্রা বেশিক্ষণ স্থায়ী হলো না। কিছু দূর যাওয়ার পর আমাদের বহনকারী বলাকা বাস টি পথিমধ্যে নষ্ট হয়ে গেল। পরবর্তীতে জানতে পারলাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অরন্যক নামক আরেকটি বাস পাঠানো হবে আমাদের জন্য। বাসটির জন্য আমরা অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছি। এই সময়ের মধ্যে আমারা আমাদের সকালের নাস্তা সেরে নিলাম। ঝিনেদাহ টার্মিনালে আমাদের সাথে কোর্স টিচার যুক্ত হলেন। সেখানে আমাদের জন্য আপেক্ষা করছিল আমাদের বন্ধু রাজু, মেজবা, সেবাসহ আরও অনেকে। আমাদের এই পুরোটা যাত্রায় রাজু মেডিকেল সাপোর্টের দায়িত্বে ছিল। আমি তার থেকে কিছু মেডিসিন সংগ্রহ করে নিলাম। ইতোমধ্যে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাঠানো বাসটি আমাদের নিকট এসে পৌছেছে। আমরা বিরতি শেষে পুনরায় আমাদের নিজ নিজ আসনে বসলাম। বাস সম্পূর্ণ গতিতে ছুটে চলেছে মাগুরার উদ্দেশ্যে। আমি লক্ষ্য করলাম রাস্তার দুপাশের সারি সারি গাছগুলো তীব্র গতিতে আমাদের পেছনে ছুটছে। বাসের তীব্র গতি আর ঝাঁকুনিতে আমি হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়েছিলাম।  নাজনীন, জান্নাত আমার অসুস্থতার কারণে ভীষণ টেনশন করছিল। বন্ধু রাজু’র থেকে সংগ্রহ করা মেডিসিন তারা আমাকে দিল। আমি মেডিসিন নিয়ে জান্নাতের কাধে মাথা রেখে চোখ বুঝলাম। কিছুটা সময় পর হঠাৎ করে সকলের আনন্দধ্বনি শুনতে পেলাম। চোখ মেলতেই দেখলাম আমরা মাগুরা কোর্টে এসে পৌছেছি।

মাগুরার চীফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট মো: আব্দুল মতিন আমাদের ভার্সিটির আইনের প্রথম ব্যাচের ছাত্র ছিলেন। তিনার ব্যবহার ছিল অমায়িক। দারুণ আন্তরিকতার সাথে তিনি এবং আরো সবাই আমাদের গ্রহণ করে নিলেন। জনাব আব্দুল মতিন স্যারের রুম থেকে সরাসরি আমাদের সেমিনার রুমে নিয়ে গেলেন। সেখানে উপস্থিত ছিলেন আমাদের ভার্সিটি থেকে পড়ে যাওয়া আইন অনুষদের অনেক প্রাক্তন শিক্ষার্থী। যারা এখন সম্মানের সাথে মাগুরা কোর্ট আলোকিত করছে। কিছুক্ষণ পরেই আমাদের মাঝে উপস্থিত হলেন জেলা ও দায়রা জজ মিজানুর রহমান। তিনিও আমাদের ভার্সিটির আইনের প্রথম ব্যাচের শিক্ষার্থী ছিলেন। লাবিব এবং মাহফুজ ফুল দিয়ে তাদের বরণ করে নিলেন। তিনারা আমাদের পেয়ে যে কতটা আনন্দিত হয়েছিলেন তা আমরা তাদের আন্তরিকতা দেখেই বুঝতে পারতেছিলাম।

চীফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট (CJM) মো: আব্দুল মতিন স্যার আমাদের প্রথমেই খুবই সাবলীল ভাষায় জানালেন সাজা কেন দেওয়া হয়। তিনি বললেন, অপরাধীর অপরাধকে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য সাজা দেওয়া হয়। তিনি আমাদের জানালেন একজন ভালো আইনজীবীর বৈশিষ্ট্য কিরুপ। আমাদের কি কি করা উচিত সেব্যাপারে দিক নির্দেশনা দিলেন। তিনি বললেন, “সনদ, চেষ্টা, আত্মবিশ্বাস, প্রাকটিস, ধৈর্য, ক্ষমার গুণ, ম্যানার এন্ড এটিগেট এবং আত্মসমালোচনা। এই গুলো তোমার মাঝে থাকতে হবে। প্রথমেই সনদ নিতে হবে কেননা তুমি যতই প্রাকটিস করো না কেন সনদ ছাড়া তোমার কোনো ভ্যালিডিটি নাই। আসলে আমাদের মাঝে আত্মবিশ্বাসের বড় অভাব, এটা আগে অর্জন করতে হবে। তোমাকে চেষ্টা এবং প্রাকটিস এর মাঝে থাকতে হবে, ভালো মানুষ হতে হবে, অন্যকে সম্মান করতে হবে, বিশেষ করে নিজের শিক্ষককে কখনোই অপমান করো না যদিও তোমরা তাদের থেকে বেশিও জানো তবুও। নিজের আত্মসমালোচনা করবে নিজের ভুল নিজে চিহ্নিত করার চেষ্টা করবে। মনোযোগ সহকারে সিনিয়রদের কথা শুনবে, আমি আমার সিনিয়র উকিল দের কথা শুনতাম। খুব মনোযোগী ছিলাম এবং আমি সাথে সাথে লিখতাম।” তিনি আমাদের আছিয়া ধর্ষণ মামলার ব্যাপারেও অনেক কিছু বললেন। যা ওখানে না গেলে অনেক কিছুই জানতে পারতাম না। আবেগ দিয়ে যে আইন চলে না এটাও বুঝতে পারলাম। সব কিছুর ই একটি আইনগত প্রকৃয়া রয়েছে। তবে আছিয়া ইনশাআল্লাহ দ্রুত ন্যায় বিচার পাবে এব্যাপারে নিশ্চিত হওয়া গেল। ভালো লয়ারের জেরা তুলে সেটা স্টাডি করতে হবে তোমাদের। বিভিন্ন ধারা আছে যা তোমাদের জানা জরুরি। সেই ধারার কেট গুলো পড়বা। ১০ টা সিভিল মামলা ও ১০ টা ক্রিমিনাল মামলা দেখবা। একটি মামলার জেরা, জবানবন্দি থেকে শুরু করে সমস্ত কিছু থাকতে হবে তাতে।
জেলা ও দায়রা জজ মিজানুর রহমান আমাদের উদ্দেশ্যে বললেন, রেগুলার পড়াশোনা করতে হবে, Where Law is? ল টা আসলে কোথায় আছে জানতে হবে, মোরালিটি, নিজের আচার ব্যবহার সুন্দর করতে হবে, নৈতিকিতা ঠিক রাখবে, জ্ঞান আহরণ আর সব শেষে নিজের টার্গেট ঠিক রেখে আগিয়ে যেতে হবে। নিজের লক্ষ্য ঠিক রাখতে হবে। তিনি আমাদের সামারি ট্রায়েল সম্পর্কেও সুন্দর ধারণা দিলেন। এজলাসে উঠতে হবে সেই জন্য তিনি আমাদের তার মহা মূল্যবান সময় থেকে কিছু সময় দিয়ে চলে গেলেন। আর মাঝে আমাদের জন্য নাস্তা কফি সব দেওয়া হলো। কিছুক্ষণ পরেই আমাদের দণ্ডবিধি কোর্সের শিক্ষক প্রোফেসর ড. আমজাদ হোসেন স্যার এসে উপস্থিত হলেন। আমাদের অনেক প্রশ্নের উত্তর জজ সাহেব রা দিলেন। আমার ছোট বেলা থেকে জমানো একটি প্রশ্নের উত্তর আব্দুল মতিন স্যার এত সুন্দর করে দিলেন যে আমার মনে হচ্ছিল আমার এখানে আসা স্বার্থক। সেমিনার শেষে আমাদের এজলাসে যাওয়ার জন্য বললেন। সেখানে আমরা দেখলাম কিভাবে ট্রায়েল হয়, সাক্ষী গ্রহণ হয়, কিভাবে রেমিডি চাওয়া ও দেওয়া হয়।

সেখান থেকে এসে আমরা মাগুরার একটি রেস্তোরাঁয় খাবার খেলাম। আমাদের ডিপার্টমেন্ট এর বড় ভাইয়েরাও ছিলেন আমাদের সাথে। যারা মাগুরা কোর্টের আইনজীবী হিসেবে এখন কর্মরত। ভাইয়েরা আমাদের জন্য লিচু আনলেন। তুহিন আমাকে খাবারের ব্যাপারে সাবধান করে পানির বোতল হাতে ধরিয়ে রিক্সায় প্রান্ত দাদার সাথে বসে পড়লো। আমিও ওদের ছবি তুলে দিলাম। ফিরে আসার সময় আমি আশিককে ওর সিট থেকে উঠিয়ে আমি জানালার কোনায় বসলাম আর আমার পাশে জান্নাত বসলো। কারণ আমার অনেক শরীর খারাপ লাগছিল। এর পরে বাসে মাসুদ আমাদের সবাইকে ভাইদের দেওয়া লিচু সমান ভাবে ভাগ করে দিল। অবশেষে বেলা তিন টার দিকে বাস এসে ঝিনেদাহ কোর্টের সামনে এসে উপস্থিত হলো। সেখানে ফ্রেশ হয়ে নামায পড়ে নেওয়া হলো। এর পরে আমাদের ডিপার্টমেন্ট এর বড় ভাইয়েদের সাথে আমাদের আরেকটি সেমিনার হলো। তারা একে একে তাদের পরিচয় দিল ও আমাদের পরিচয় জানলো। তাদের আইনজীবী হওয়ার গল্প শোনালো। আমাদের সামনে ছিলেন ঝিনেদাহ জেলা বারের সিনিয়র আইনজীবী, যিনি ভাইদেন সিনিয়র। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পড়ে এসেছেন। তিনার মুখে ভাই দের নিয়ে এত প্রশংসা শুনে সত্যিই খুব আনন্দ লাগছিল। সব শেষে আলতাফ স্যারের বক্তব্যের মধ্য দিয়ে সেমিনার শেষ হলো। ভাইয়েরা আমাদের জন্য খাবারের আয়োজন করেছিলেন যা আমরা সবাই সাথে করে নিয়ে এসেছিলাম। অতি আনন্দে ‘কোর্ট ভিজিট’ শেষ হলো। এছাড়াও আমাদের এই কোর্সে স্যার আমাদের কিছুদিন আগে ইবি থানায় নিয়ে গিয়েছিলেন তদন্ত প্রকৃয়া হাতে কলমে দেখানোর জন্য। পড়ালেখার শেষ পর্যায়ে এসে এমন এক্সপ্রিয়েন্স আসলেই অন্যরকম একটি উদ্দিপনা সৃষ্টি করে তুলেছে আমাদের মাঝে। স্যারদের এমন অনুপ্রেরণা আমাদের ইচ্ছাশক্তিকে আরো আশাবাদী করে তুলেছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *