
— একজন ফিলিস্তিনির হৃদয়বিদারক অভিজ্ঞতা
গাজায় আজ মৃত্যু জীবনের প্রতিটি কোণে হাজির। এটি এখন আর চমকে দেওয়ার মতো কিছু নয়—বরং এক দৈনন্দিন নির্মম বাস্তবতা, যার সঙ্গে আমাদের বেঁচে থাকার জন্য মানিয়ে নিতে হয়েছে।
গাজায় মরার অনেক পথ আছে, কিন্তু বেছে নেওয়ার সুযোগ নেই।
একজন মানুষ বোমায় মারা যেতে পারে, অথবা স্নাইপারের গুলিতে যখন সে ক্ষুধা নিবারণের জন্য খাবার সংগ্রহ করতে যায়। কেউ মারা যাচ্ছে অনাহারে।
গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, অপুষ্টিতে ইতোমধ্যে ১১৬ জন মানুষ মারা গেছেন—যাদের মধ্যে বেশিরভাগই শিশু ও নবজাতক।
পানি এখানে একটি মারাত্মক জিনিসে পরিণত হয়েছে। শুধু পান করাই নয়, পানি সংগ্রহ করাও এখন বিপজ্জনক।
ইসরায়েলি বাহিনী ২০২৩ সালের শেষ দিক থেকে ধারাবাহিকভাবে গাজার পানি অবকাঠামো লক্ষ্য করে হামলা চালিয়ে যাচ্ছে। ৮৫ শতাংশের বেশি পানি ও স্যানিটেশন সুবিধা—যেমন পাইপলাইন, কূপ, পরিশোধন কেন্দ্র—নষ্ট হয়ে গেছে।
ইসরায়েল পানি সরবরাহের জন্য দরকারি যন্ত্রপাতি প্রবেশে বাধা দিচ্ছে। পানি সরবরাহকারী কর্তৃপক্ষের গুদামঘর ধ্বংস করে দিয়েছে, মজুদ যন্ত্রাংশ পুড়িয়ে ফেলেছে।
সবচেয়ে ভয়াবহ বিষয় হলো—পানির অবকাঠামো মেরামত করতে গিয়ে বহু কর্মী প্রাণ হারিয়েছেন। এখন গাজায় পানি সরবরাহ বা মেরামতের কাজ করা মানেই মৃত্যুকে ডেকে আনা।
সর্বশেষ, ২১ জুলাই, গাজা সিটির রিমাল এলাকায় একটি ডেসালিনেশন প্ল্যান্টে ইসরায়েলি হামলায় পাঁচজন নিহত হয়েছেন। এটি ছিল শহরের হাতে গোনা কয়েকটি সচল পানির কেন্দ্রের একটি।
গাজার মানুষ এখন প্রতিদিন পানির সন্ধানে বের হতে বাধ্য।
কিছু যুদ্ধ-সুযোগসন্ধানী ব্যবসায়ী বিশাল অর্থের বিনিময়ে পানি সরবরাহ করছে, যা বেশিরভাগ মানুষই বহন করতে পারে না।
এই অবস্থায় মানুষ জলের জার হাতে নিয়ে রোদের মধ্যে দীর্ঘ পথ পায়ে হেঁটে যাচ্ছে, পানির লাইনে ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করছে।
এই অপেক্ষাও প্রাণঘাতী হতে পারে।
১৩ জুলাই, নুসাইরাত শরণার্থী ক্যাম্পে পানির লাইনে দাঁড়িয়ে থাকা ১১ জন ফিলিস্তিনি—যাদের মধ্যে সাতজন শিশু—ইসরায়েলি ক্ষেপণাস্ত্র হামলায় নিহত হন, আহত হন আরও অনেকে। এই স্থানটি লেখকের বাড়ির কাছেই।
অনেক সময় পানি সরবরাহকারী গাড়ি না থাকায় মানুষ বাধ্য হয়ে দূষিত কূপের পানি খাচ্ছে, যা জীবাণু, রাসায়নিক ও নানা দূষণে ভরা।
এতে পানিবাহিত রোগ ছড়িয়ে পড়ছে।
লেখক নিজেও একবার দূষিত পানি খেয়ে হেপাটাইটিস-এ আক্রান্ত হন।
চোখ আর ত্বক হলুদ হয়ে যায়, প্রচণ্ড পেটব্যথা, জ্বর, বমি—সপ্তাহজুড়ে তিনি বিছানায়, একা যুদ্ধ করেছেন রোগের সঙ্গে।
চিকিৎসা কেন্দ্রে গিয়েও কোনো কার্যকর সহায়তা পাননি—শুধু একটি ব্যথানাশক ও “সালামতাক” (শুভ কামনা)।
তিনি বেঁচে গেছেন, কিন্তু অনেকেই পারেননি।
এখন গরমের দিনে ভাবা যায়, অন্তত সাগরের পানিতে নেমে একটু স্বস্তি মিলবে।
কিন্তু তা-ও নিষিদ্ধ।
ইসরায়েলি সেনাবাহিনী গাজার পুরো উপকূলকে “নিষিদ্ধ এলাকা” ঘোষণা করেছে।
কেউ সাগরের কাছাকাছি গেলেই গুলি করা হচ্ছে।
এর আগেও বহুবার মাছ ধরতে গিয়ে ফিলিস্তিনিরা ইসরায়েলি গুলিতে নিহত হয়েছেন।
জাতিসংঘের হিসাবে ২০২৪ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত অন্তত ২০০ জন জেলে নিহত হয়েছেন, এরপর আরও বহুজন প্রাণ হারিয়েছেন।
একই ভূমধ্যসাগরের পানি—যা গাজার মানুষের কাছে মৃত্যুর সমান, সেটিই কয়েক কিলোমিটার দূরে ইসরায়েলিদের জন্য আনন্দ-স্নানের জায়গা।
তারা সেখানে অবাধে সাঁতার কাটছে, রোদ পোহাচ্ছে, ঝরনার নিচে দাঁড়িয়ে দীর্ঘ সময় পানি ব্যবহার করছে।
তারা প্রতিদিন মাথাপিছু ২৪৭ লিটার পানি ব্যবহার করে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, একজন মানুষের দৈনিক কমপক্ষে ১০০ লিটার পানির দরকার। গাজায় এখন একজন মানুষ দিনে পাচ্ছে ২ থেকে ৯ লিটার মাত্র।
এটা শুধু পানির লড়াই নয়—গাজার মানুষের প্রতিদিনের প্রতিটি নিঃশ্বাসই এখন এক যুদ্ধ।
নেই খাবার, নেই ওষুধ, নেই বিদ্যুৎ, নেই নিরাপত্তা।
এই ২১শ শতাব্দীতে, যেখানে বিশ্বনেতারা সভা-সম্মেলনে মর্যাদা ও মানবাধিকারের বুলি কপচান, সেখানে গাজার লক্ষ লক্ষ মানুষ বেঁচে থাকার ন্যূনতম উপকরণ থেকেও বঞ্চিত।
২০২৪ সালের ডিসেম্বর মাসে হিউম্যান রাইটস ওয়াচ বলেছে, গাজায় ফিলিস্তিনিদের ওপর “গণহত্যা” চালানো হচ্ছে।
তারা বলেছে, “ইসরায়েলের পানি বঞ্চনার নীতিই এই গণহত্যার একটি প্রমাণ।”
২০২৪ সালের আগস্ট পর্যন্ত “হাজার হাজার মানুষ অপুষ্টি, পানির অভাব ও রোগে” মারা গেছেন।
এরপর এক বছর কেটে গেছে।
আজ কত মানুষ যে পানির অভাবে মারা গেছে—তার সঠিক হিসাব নেই। কারণ, স্বাস্থ্য কর্তৃপক্ষের সেই সামর্থ্য আর অবশিষ্ট নেই।
এই সত্য এখন আর লুকোনো নেই।
আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমে, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তা চোখের সামনে দৃশ্যমান।
তবু বিশ্ব নীরব—কোনো কার্যকর পদক্ষেপ নেই।
এ বিশ্বকে আজ একজন গাজাবাসীর শেষ বার্তা:
“তোমাদের নীরবতা আমাদের ওপর পড়া বোমার চেয়েও জোরে বাজে। এখনই কিছু করো—নাহলে ইতিহাসে জায়গা পাবে আমাদের গণহত্যার এক নীরব সহযাত্রী হিসেবে।”
সূত্র: আল জাজিরা